টানা দর হারাতে থাকা পুঁজিবাজারে দুর্বল ও লোকসানি কোম্পানিগুলো আবার তেজ দেখাতে শুরু করেছে। সবচেয়ে বেশি দাম বেড়েছে এমন কোম্পানিগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি উৎপাদনে নেই, লভ্যাংশ দিতে পারছে না বছরের পর বছর ধরে।
দেশের পুঁজিবাজারে মন্দাভাবের সময় এ বিষয়টি প্রায়ই দেখা যায়। লোকসানি, উৎপাদন বন্ধ- এমন সিংহভাগ কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন বেশ কম। শেয়ারসংখ্যা কম হওয়ার কারণে শেয়ারদর কৃত্রিমভাবে বাড়ানোর সুযোগ থাকে। প্রায়ই দেখা যায়, শেয়ারদর বাড়লে বিনিয়োগকারীরা সেই কোম্পানির শেয়ারেই বেশি আকৃষ্ট হন।
এমনিতেই দর সংশোধনে থাকা পুঁজিবাজারে ইউক্রেন যুদ্ধ, ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য হ্রাসসহ নানা ইস্যুতে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক চাপ প্রবল। তার ওপর বাজেটে প্রত্যাশিত কোনো ঘোষণা আসেনি। আশা ছিল, বাজেট পাসের সময় অন্তত কিছু পাওয়া যাবে, কিন্তু অর্থমন্ত্রী এখানেও কোনো সুখবর রাখেননি।
গত অর্থবছরের শুরুটা ঝলমলে থাকলেও সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহের শেষ দিন থেকে পুঁজিবাজারে টানা যে দর সংশোধন শুরু হয়, এরপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির মতভেদ, পরে বছর শেষের সমন্বয়, এরপর নতুন বছর শুরু হতে না হতেই আন্তর্জাতিক নানা ঘটনাপ্রবাহ, ইউক্রেন যুদ্ধ, শ্রীলঙ্কায় অর্থনৈতিক বিপর্যয়, ডলারের বিপরীতে টাকার দরপতন- পুঁজিবাজারে আস্থা তৈরি হওয়ার মতো যেন কোনো একটি ঘটনাও নেই।
পুঁজিবাজার বিশ্লেষকরা বলছিলেন, অর্থবছরের শেষে বিভিন্ন কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যা দেখে বিনিয়োগকারীরা নতুন বিনিয়োগের ছক আঁকেন। বাজারে নতুন ফান্ড ইনজেক্ট হয়। যার কারণে ইতিবাচক চাঞ্চল্য দেখা যায়। এতে সময় লাগবে।
গত বৃহস্পতিবার অর্থবছরের শেষ দিন শেষ বেলায় হঠাৎ করেই ক্রয়চাপ ও সূচক বাড়তে দেখা দিলেও নতুন অর্থবছরের প্রথম দুই কর্মদিবসেই পড়ল সূচক, শেয়ারদর। সেই সঙ্গে কমল লেনদেন।
বৃহস্পতিবার যেখানে ৯৩৭ কোটি টাকা ছাড়িয়ে লেনদেন হয়েছিল, রোববার তা দাঁড়ায় ৬৫৪ কোটি ৮৩ লাখ ৩৯ হাজার টাকায়। সেখান থেকে কিছুটা বেড়ে সোমবার হাতবদল হয়েছে ৬৩২ কোটি ৫০ লাখ ৮২ হাজার টাকা।
১৬২ কোম্পানির শেয়ারের দর বৃদ্ধির বিপরীতে হারিয়েছে ১৬৫টি, অপরিবর্তিত ছিল ৫৪টির দর।
সোমবার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে লেনদেনের চিত্র
লেনদেনের বিষয়ে মিয়া আব্দুর রশিদ সিকিউরিটিজের শীর্ষ কর্মকর্তা শেখ ওহিদুজ্জামান স্বাধীন বলেন, ‘ঈদের আগে নতুন করে শেয়ার কেনা থেকে বিরত রাখবেন বিনিয়োগকারীরা। এ ছাড়া মার্জিন লোন নিয়ে যারা ট্রেড করেন, তাদের ট্রেডিংও বন্ধ থাকবে। লেনদেন কমার এটি একটি কারণ।’
‘এ ছাড়া নতুন অর্থবছরের ফান্ড ইনজেক্ট হয়। অনেক প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী ইনভেস্ট করেন। কিন্তু ফান্ড জোগাড় করতে তাদের সময় লাগে। জুলাইয়ের অর্ধেক যাওয়ার পরে তারা হয়তো ফান্ড কালেক্ট করে নতুন বিনিয়োগ করবেন। এতে আশা করা যায় বাজার চাঙা হবে।’
দর বৃদ্ধির শীর্ষ ১০
দর বৃদ্ধির শীর্ষে রয়েছে লোকসানি জাহিদ স্পিনিং লিমিটেড। কোম্পানির দর দিনের সর্বোচ্চ অর্থাৎ ১০ শতাংশ বেড়ে সর্বশেষ দর দাঁড়িয়েছে ১২ টাকা ১০ পয়সায়।
পাঁচ বছরের মধ্যে বিগত দুই বছর শেয়ারপ্রতি মোটা অঙ্কের লোকসান দিয়েছে জাহিদ স্পিনিং। তবে তার আগের তিন বছর কিছুটা মুনাফায় ছিল কোম্পানি। তবে কোনোদিনই নগদ লভ্যাংশ পাননি এর বিনিয়োগকারীরা।
বুধবার গ্রামীণফোনের সিম বিক্রিতে বিটিআরসির নিষেধাজ্ঞার পর গ্রামীণফোনের দরপতনের বিপরীতে শেয়ারদর বাড়তে শুরু করে রবি আজিয়াটা লিমিটেডের।
পরপর তিন কর্মদিবস দর বাড়ল। ৯ দশমিক ৯৭ শতাংশ বেড়ে ৩৩ টাকা ১০ পয়সা থেকে ৩৬ টাকা ৪০ পয়সায় শেয়ার লেনদেন হয়েছে।
দর বৃদ্ধির তৃতীয় স্থানে রয়েছে আরেক লোকসানি কোম্পানি ইস্টার্ন ক্যাবলস। ৯ দশমিক ৯৭ শতাংশ বেড়ে সর্বশেষ দর দাঁড়িয়েছে ১৬১ টাকা ৫০ পয়সায়।
লেনদেন শুরুর পর ডিএসই জানায়, কোম্পানিটি অ্যালুমিনিয়াম তার সরবরাহের লক্ষ্যে চায়না ন্যাশনাল টেকনিক্যাল ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট করপোরেশনের সঙ্গে চুক্তি সই হয়েছে। এর পরেই দর বেড়ে যায়।
সবচেয়ে বেশি দর বৃদ্ধি পাওয়া ১০টি কোম্পানির মধ্যে বেশির ভাগই লোকসানি
২০১৭ সালে শেয়ারপ্রতি ১ টাকা ১৯ পয়সায় আয় হয়েছিল। এরপর টানা চার বছর লোকসানে রয়েছে কোম্পানি। বিগত দুই বছর লভ্যাংশ না দিলে ২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দিয়েছে ইস্টার্ন ক্যাবলস। এর মধ্যে ২০১৮ সালে ১০ শতাংশ ছাড়া সবই নগদ ছিল।
একই সমান দর বেড়েছে ব্যাপক লোকসানে থাকা শ্যামপুর সুগার মিলস লিমিটেডের। প্রতি বছরই লোকসান গুনলেও অজানা কারণে দাম চড়া রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিটির শেয়ারের।
লভ্যাংশ দিতে না পারায় ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে লেনদেন হচ্ছে শেয়ারটি। ২১ জুন থেকে ধারাবাহিক দর বাড়ছে। ওইদিন ৭৭ টাকা ১০ পয়সায় শেয়ার বেচাকেনা হয়েছিল। আজকে সর্বশেষ দর দাঁড়িয়েছে ১১৯ টাকা ৫০ পয়সায়। এই সময়ে দর বেড়েছে ৪২ টাকা ৪০ পয়সা।
ডিএসই থেকে অস্বাভাবিক দর বৃদ্ধির কারণ জানতে চাইলে কোনো মূল্য সংবেদনশীল তথ্য নেই বলে জানিয়েছে কোম্পানি।
এর পরই দর বেড়েছে প্রাইম টেক্সটাইল, ইন্ট্রাকো রি-ফুয়েলিং স্টেশন, জুট স্পিনার্স, সাভার রিফ্যাক্টরিজ, খান ব্রাদার্স বিপি ওভেন ব্যাগ ইন্ডাস্ট্রিজ ও এমএল ডায়িং।
এর মধ্যে জুট স্পিনার্স ও সাভার রিফ্রাকটরিজ লোকসানের কারণে কখনও লভ্যাংশ দিতে পারেনি।
দর পতনের শীর্ষ ১০
সবচেয়ে বেশি ১ দশমিক ৯৯ শতাংশ দর কমেছে প্রগ্রেসিভ লাইফ ইন্স্যুরেন্সের। ২০১৫ সাল বাদে আর কোনো বছর নগদ লভ্যাংশ দিতে পারেনি কোম্পানিটি।
গতকাল ৮০ টাকা ১০ পয়সায় লেনদেন হওয়া শেয়ার আজ হাতবদল হয়েছে ৭৮ টাকা ৫০ পয়সায়।
প্রায় একই সমান দর কমেছে মনস্পুল পেপারের। ২০ ফেব্রুয়ারি ২৭২ টাকা ৯০ পয়সায় লেনদেন হওয়ার পর ক্রমাগত দরপতন দেখা গেছে। আজ সর্বশেষ দর দাঁড়িয়েছে ১৬২ টাকা ৭০ পয়সায়।
তৃতীয় অবস্থানে থাকা অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের দর ১ দশমিক ৯৮ শতাংশ কমে ২৬৭ টাকা ২০ পয়সায় শেয়ার লেনদেন হয়েছে।
এ ছাড়া দরপতনের তালিকার দশে রয়েছে যথাক্রমে পূরবী জেনারেল ইন্স্যুরেন্স, নাভানা সিএনজি, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্রামীণফোন, পেপার প্রসেসিং, ফার্স্ট ফিন্যান্স ও অ্যাপেক্স ট্যানারি।
সূচক কমাল যারা
সবচেয়ে বেশি ১২৩ দশমিক ৩৭ পয়েন্ট সূচক কমেছে গ্রামীণফোনের কারণে। কোম্পানিটির দর কমেছে ১ দশমিক ৯৮ শতাংশ।
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৪৩ দশমিক ৭ পয়েন্ট কমিয়েছে ওয়ালটন হাইটেক। কোম্পানির শেয়ারের দাম কমেছে শূন্য দশমিক ৪৩ শতাংশ।
এর পরই বেক্সিমকোর দর ১ দশমিক ৬ শতাংশ কমার কারণে সূচক কমেছে ২৯ দশমিক ৫ পয়েন্ট।
এ ছাড়া বার্জার পেইন্টস, ব্র্যাক ব্যাংক, ইউনাইটেড পাওয়ার, বিকন ফার্মা, বেক্সিমকো ফার্মা, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো ও বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবলসের দরপতনে সূচক কমেছে।
সব মিলিয়ে এই ১০ কোম্পানি কমিয়েছে ২৮৩ দশমিক শূন্য ৯ পয়েন্ট।
বিপরীতে রবি একাই পেয়ে ২৭৭ দশমিক শূন্য ৭ পয়েন্ট সূচক বাড়িয়েছে। এদিন কোম্পানিটির দর ৯ দশমিক ৯৭ শতাংশ বেড়েছে। আগের দুই কর্মদিবসেও সর্বোচ্চ সূচক বাড়িয়েছিল কোম্পানিটি।
সূচকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পয়েন্ট যোগ করেছে লাফার্জ হোলসিম বাংলাদেশ। দর ২ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ বাড়ায় সূচক বেড়েছে ২৬ দশমিক শূন্য ৬ পয়েন্ট।
আইসিবি সূচকে যোগ করেছে ১১ দশমিক ৬৩ পয়েন্ট। কোম্পানির দর বেড়েছে শূন্য দশমিক ৯ শতাংশ।
এ ছাড়া স্কয়ার ফার্মা, রেনাটা, ইস্টার্ন ক্যাবলস, এমএল ডায়িং, ইউসিবি, বাংলাদেশ স্টিল রি-রোলিং মিলস লিমিটেড ও শাইনপুকুর সিরামিকস সূচকে পয়েন্ট যোগ করেছে।
সব মিলিয়ে এই ১০টি কোম্পানি সূচক বাড়িয়েছে ৩৫৩ দশমিক ৫৬ পয়েন্ট।