আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেট পাশের আগে আগে পুঁজিবাজারে লেনদেন বাড়ছে। সেই সঙ্গে টানা দুই দিন বাড়ল সাধারণ সূচকও।
চলতি সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবস রোববার ২৬ পয়েন্ট দরপতনের পাশাপাশি লেনদেন নেমে আসে ছয় শ কোটি টাকার নিচে। সেদিন পর্যন্ত টানা ছয় কর্মদিবস লেনদেন আগের দিনের চেয়ে কমে যায়। তবে সোমবার বিকেলে হঠাৎ করে যে ক্রয় চাপ দেখা দেয়, পর দিনও তা অব্যাহত থাকে।
মঙ্গলবার পুঁজিবাজারে লেনদেন ছাড়ায় ৮১৮ কোটি ৮২ লাখ ৬৪ হাজার টাকা আগের দিন যা ছিল ৭০০ কোটি ৭৬ লাখ ২৭ হাজার টাকা। অর্থাৎ দুই দিনেই লেনদেন বেড়েছে দুই শ কোটি টাকার বেশি।
দিন শেষে ১৯৯টি কোম্পানির দর বৃদ্ধির পর ডিএসইর সাধারণ সূচক ডিএসইএক্সে যোগ হয়েছে ২২ পয়েন্ট, আগের দিন বেড়েছিল ১৯ পয়েন্ট।
গত তিন সপ্তাহ ধরেই দুর্বল কোম্পানির দর বৃদ্ধির যে প্রবণতা দেখা গেছে, সেখান থেকে অবশ্য বের হতে পারেনি পুঁজিবাজার। সবচেয়ে বেশি দর বেড়েছে এমন ১০টি কোম্পানির মধ্যে পাঁচটিই লোকসানি, যেগুলোর লভ্যাংশের ইতিহাস কোনোভাবেই আশাপ্রদ নয়।
পুঁজিবাজারে গত সেপ্টেম্বর থেকে মন্দার মধ্যে গত ৯ জুন বাজেট প্রস্তাবের আগে আগে বাজারে শেয়ারদর ও সূচক এবং লেনদেন বাড়তে থাকে। গত সেপ্টেম্বরে শুরু হওয়া সংশোধন, এরপর ইউক্রেনে রুশ হামলা, শ্রীলঙ্কায় অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মনস্তাত্ত্বিক চাপ কাটিয়ে উঠার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তাকে ১৯ বছর পর বদলির খবর আসে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পুঁজিবাজার নিয়ে রক্ষণশীল নানা সিদ্ধান্তের পেছনে তার ভূমিকা রয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
তবে আগামী অর্থবছরের বাজেটে পুঁজিবাজারে অপ্রদর্শিত অর্থ বা কালোটাকা বিনিয়োগের সুযোগ না রাখার ঘটনায় ছড়ায় হতাশা। কমপক্ষে ১০ শতাংশ শেয়ার ছেড়েছে, এমন কোম্পানির করপোরেট কর ২ শতাংশ কমানো ছাড়া পুঁজিবাজার নিয়ে আর কোনো কথাই বলেননি অর্থমন্ত্রী। আবার এই সুবিধা ব্যাংক, বিমা, আর্থিক খাত, টেলিযোগাযোগ ও তামাক কোম্পানি পাবে না।
বাজেট পেশের পর টানা দরপতনের মধ্যেও ১৬ জুন পর্যন্ত লেনদেন বাড়ছিল। সেদিন একমাস পর লেনদেন হাজার কোটি টাকা ছাড়ায়।
কিন্তু দুই দিনের সাপ্তাহিক ছুটির পর পরের কর্মদিবস ১৯ জুন থেকে লেনদেনে ক্রমাগত ভাটা পড়তে থাকে। এর মথ্যে গত রোববার তা নেমে আসে ৫৯৪ কোটি ৩৭ লাখ ৯০ হাজারে। গত ২৬ মের পর এত কম লেনদেন কখনও হয়নি।
পর দিনই লেনদেনের গতি ছিল কম। তবে বেলা দুইটা থেকে হঠাৎ দেখা দেয় ক্রয়চাপ। শেষ আধা ঘণ্টায় দুই শ কোটি টাকার মতো শেয়ার হাতবদল হয়।
পরদিন দিনভর বাজার ছিল ইতিবাচক। প্রথম ১৮ মিনিটেই সূচক বাড়ে ৩০ পয়েন্ট। এরপর উঠানামা করতে করতে লেনদেন এগিয়ে যায়। লেনদেন শেষ হওয়ার একেবারে আগ মুহূর্তেও তা আগের দিনের চেয় ৩১ পয়েন্ট বেশি ছিল। তবে শেষ মুহূর্তের সমন্বয়ে সেখান থেকে কিছুটা কমে শেষ হয় লেনদেন।
মঙ্গলবার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে লেনদেনের চিত্র
মঙ্গলবারের লেনদেন নিয়ে ট্রেজার সিকিউরিটিদের চিফ অপারেটিং অফিসার মোস্তফা মাহবুব উল্লাহ নিউজবাংলাকে বলেন, 'জুনের এই সময়টাতে আমরা লক্ষ্য করে দেখেছি যে, অনেক ফান্ড ইনজেক্ট হয়। জুন ক্লোজিংকে টার্গেট করে বিনিয়োগকারীরা কিছু কোম্পানি বিনিয়োগের জন্য বেছে নেন। ফলে প্রতি বছরই কিছু ফান্ড ইনভেস্ট হয় পুঁজিবাজারে, যার কারণে লেনদেন বাড়ছে। তবে এই বছর তুলনামূলক ফান্ডের ইনজেকশন কম।'
দুর্বল কোম্পানিগুলোর ধারাবাহিক দর বৃদ্ধির বিষয়ে তিনি বলেন, 'বাজারে মৌলভিত্তির শেয়ারগুলোর মুভমেন্ট কম হচ্ছে, যার কারণে দুর্বল কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দর বাড়ছে। মৌলভিত্তির শেয়ার যে সব বিনিয়োগকারী ধরে রেখেছেন, তাদের হয়তো প্রত্যাশা পূরণ হয়নি, আরও অপেক্ষা করতে চাচ্ছেন।'
বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বাজেট ভাবনা খুব একটা আছে বলেও মনে করেন না মাহবুব উল্লাহ। তিনি বলেন, ‘প্রতিবছরই পুঁজিবাজারের জন্য ভালো কিছু থাকে না। ফলে এ নিয়ে বিনিয়োগকারীরা খুব বেশি ভাবছেন বলে মনে হয় না।’
দরপতনের শীর্ষে আবার লোকসানি কোম্পানি
গত তিন সপ্তাহ ধরে লোকসানি কোম্পানির দর বৃদ্ধির যে চিত্র দেখা যাচ্ছে, তার আরও একটি নমুনা দেখা গেল এদিন।
সবচেয়ে বেশি ৯.৯৪ শতাংশ দর বেড়েছে নতুন তালিকাভুক্ত মেঘনা ইন্স্যুরেন্সের। লেনেদেন শুরুর পর থেকে প্রতিদিনই দর বেড়েছে সর্বোচ্চ পরিমাণ।
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৯.৮৭ শতাংশ দর বেড়েছে ২০১০ সালের পর থেকে কখনও লভ্যাংশ দিতে না পারা ইমাম বাটন।
সবচেয়ে বেশি দর বৃদ্ধি পাওয়া ১০টি কোম্পানির মধ্যে পাঁচটিই লোকসানি
লোকসানি খান ব্রাদার্সের দর ৯.৭৫ শতাংশ, বন্ধ থাকা কোম্পানি অ্যাপোলো ইস্পাত ৭.৯৫ শতাংশ, ইস্টার্ন ক্যাবলের দর ৬.০৭ শতাংশ এবং অলিম্পিক অ্যাকসেসোরিজের দর বেড়েছে ৫.৩৫ শতাংশ।
এর বাইরে ইয়ানিক পলিমারের দর ৯.৭৬ শতাংশ, দেশবন্ধু পলিমারের ৬.০১ শতাংশ, অ্যামবি ফার্মার দর ৫.৯৫ শতাংশ এবং রূপালী লাইফের দর বেড়েছে ৪.৯৮ শতাংশ।
খাতওয়ারি হিসাব করলে সবচেয়ে ভালো দিন গেছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে। এই খাতের ২৩টি কোম্পানির মধ্যে দর বেড়েছে ১৭টির, কমেছে চারটির আর দুটির দর ছিল অপরিবর্তিত।
ভালো দিন গেছে প্রকৌশল খাতেও। এই খাতের ৪২টি কোম্পানির মধ্যে দর বেড়েছে ৩০টির। কমেছে ৯টির আর অপরিবর্তিত ছিল ৩টির দর।
ওষুধ ও রসায়ন খাতে ৩১টি কোম্পানির মধ্যে দর বেড়েছে ২৩টির, কমেছে সাতটির আর অপরিবর্তিত থাকে একটির দর।
বস্ত্র খাতে দর বেড়েছে ৩২টি কোম্পানির, কমেছে ১৫টির, অপরিবর্তিত থাকে ১২টির।
ব্যাংক, আর্থিক ও খাদ্য খাতে দেখা গেছে মিশ্র প্রবণতা। আগের দিন সাধারণ বিমা খাত চাঙা থাকলেও এদিন এই খাতে দেখা গেছে নিম্নমুখি প্রবণতা।
সবচেয়ে বেশি দর বৃদ্ধি থেকে দর পতনের সর্বোচ্চ সীমায়
এই তালিকার শীর্ষে ছিল আর্থিক খাতের আইপিডিসি, যার দর কমেছে সর্বোচ্চ সীমা ২ শতাংশ। আগের দিন দর ছিল ৫৫ টাকা। কমার সুযোগ ছিল ১ টাকা ১০ পয়সা। কমেছে ততটাই।
কাশেম ইন্ডাস্ট্রিজ, সাভার রিফ্রাকটরিজ, এস আলম কোল্ডরোল স্টিল, নিউলাইন ক্লথিং, প্রগ্রেসিভ লাইফ, জনতা ইন্স্যুরেন্স, সিএপিএমআইবিবিএল মিউচ্যুয়াল ফান্ড, ফরচুন সুজ, ডেফোডিল কম্পিউটারস এবং গ্লোবাল হেভি ক্যামিকেলসের দরও কমেছে এক দিন যতটা কমা সম্ভব ততটাই।
এই ১০টির মধ্যে দুটি কয়েকটি কোম্পানি আগের দিন সর্বোচ্চ দর বৃদ্ধির তালিকায় ছিল। এর মধ্যে সিএপিএমআইবিবিএল মিউচ্যুয়াল ফান্ডের দর ৬.৮৯ সাভার রিফ্রাকটরিজের দর আগের দিন ৬.১৯ শতাংশ বেড়েছিল।
অন্যদিকে লোকসানি গ্লোবাল হেভি ক্যামিকেলসের দর গত কয়েক দিন ধরেই বাড়ছিল। গত ২১ জুন শেয়ারদর ছিল ৩১ টাকা ১০ পয়সা। তিন কর্মদিবসে বেড়ে ৩৭ টাকা ৭০ পয়সা হয়ে গিয়েছিল।