দুর্নীতিচেষ্টার ভিত্তিহীন অভিযোগে বিশ্বব্যাংকসহ দাতাগোষ্ঠী পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে সরে যাওয়ার পর এই প্রকল্প বাস্তবায়নে সাহস জুগিয়েছে প্রবাসীদের পাঠানো কষ্টার্জিত বিদেশি মুদ্রা।
বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে দীর্ঘ টানাপোড়েনের পর ২০১২ সালের ৪ জুলাই জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেদিন তিনি বলেছিলেন, `পদ্মা সেতু করার জন্য দেশে আমাদের ১৬ কোটি মানুষ আছে, ৮০ লাখ প্রবাসী আছে। বাংলার মানুষ সারা জীবন কি অন্যের সাহায্যে চলবে? নিজের পায়ে দাঁড়াবে না? আত্মনির্ভরশীল হবে না? পদ্মা সেতু আমরা করবই।’
প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণার পর থেকেই প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সে ভিন্ন গতি পায়। প্রতি বছরই বাড়তে থাকে রেমিট্যান্স প্রবাহ। আর এর ওপর ভর করে বাড়তে থাকে বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ; রেকর্ডের পর রেকর্ড হতে থাকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, ২০১২ সালের ৪ জুলাই নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেয়ার আগের ২০১১-১২ অর্থবছরে ১২ দশমিক ৮৪ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। ২০১২-১৩ অর্থবছরে সেই রেমিট্যান্স বেড়ে দাঁড়ায় ১৪ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলারে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বছরে রেমিট্যান্স ১৫ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করে ১৫ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলারে ওঠে।
২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রবাসীরা পাঠান ১৬ দশমিক ৪২ বিলিয়ন ডলার। ২০১৯-২০ অর্থবছরে আসে ১৮ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার।
করোনা মহামারির মধ্যেও ২০২০-২১ অর্থবছরের পুরোটা সময়ে (২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের জুন) রেমিট্যান্সের উল্লম্ফন দেখা যায়। ওই অর্থবছরে অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ২ হাজার ৪৭৮ কোটি ডলার রেমিট্যান্স পাঠান প্রবাসীরা, যা ছিল আগের অর্থবছরের চেয়ে ৩৬ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি।
২০২১-২২ অর্থবছরের শুরু থেকে রেমিট্যান্সপ্রবাহে ভাটার টান লক্ষ্য করা গেলেও গত কয়েক মাস ধরে তা ফের বাড়ছে। ৩০ জুন শেষ হতে যাওয়া ২০২১-২২ অর্থবছরের ১১ মাসে অর্থাৎ জুলাই-মে সময়ে ১৯ দশমিক ১৯ বিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা, যা ২০২০-২১ অর্থবছরের চেয়ে ১৬ শতাংশ কম।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের তিন উৎস হচ্ছে রপ্তানি আয়, রেমিট্যান্স এবং বিদেশি ঋণসহায়তা। রপ্তানি আয়ের ৮২ শতাংশই আসে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে। এ খাতের কাঁচামালসহ অন্যান্য সরঞ্জাম আমদানিতে একটি বড় অংশ চলে যায়। বিদেশি ঋণসহায়তার অর্থ ব্যয় বিভিন্ন প্রকল্পে।
সে হিসাবে এই যে গত এক দশক ধরে রিজার্ভে রেকর্ডের পর রেকর্ড হয়েছে, তাতে সবচেয়ে বড় অবদান রেখেছে প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ বা রেমিট্যান্স। আর সেখান থেকেই পদ্মা সেতুর জন্য বিদেশি কেনাকাটায় যে খরচ হয়েছে সেই বিদেশি মুদ্রা অর্থাৎ ডলার জোগান দেয়া হয়েছে।
আর তাই তো, পদ্মা সেতু নির্মাণ শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশবাসীর পাশাপাশি প্রবাসীদের ধন্যবাদ দিয়েছেন। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের কথা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী গত ১৬ জুন এক অনুষ্ঠানে বলেন, দুর্নীতিচেষ্টার মিথ্যা অভিযোগ এনে অর্থায়ন থেকে বিশ্বব্যাংক সরে গেলেও দেশের মানুষের অকুণ্ঠ সমর্থন ও অভূতপূর্ব সাড়া ছিল বলেই সব বাধা পেরিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণে দৃঢ়তা দেখানো সম্ভব হয়েছে।
রংপুরে পল্লী জনপদ এবং গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় বঙ্গবন্ধু দারিদ্র্য বিমোচন ও পল্লী উন্নয়ন অ্যাকাডেমির (বাপার্ড) উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যুক্ত হয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি ধন্যবাদ জানাই আমার দেশবাসীকে। প্রবাসী ভাই-বোনদের। আমি যখন ঘোষণা দিয়েছিলাম আমার দেশের টাকায় করব, তখন আমার দেশের মানুষ, তারা আমার পাশে দাঁড়িয়েছিল, বলেছিল যার যা আছে দেব, আমরা নিজের টাকায় করব। অনেকে আমাকে চেকও পাঠিয়েছে। যদিও আমি ভাঙি নাই, সেগুলো রেখে দিয়েছি।
‘এভাবে যে মানুষের অভূতপূর্ব সাড়া, এটা আমাকে সাহস জুগিয়েছিল। এটাই আমাকে শক্তি জুগিয়েছিল। কারণ মানুষের শক্তিতে আমি বিশ্বাস করি। আজকে আমরা সেই পদ্মা সেতু সম্পূর্ণ নিজেদের অর্থায়নে আমরা তৈরি করতে পেরেছি, এত বাধা বিঘ্ন অতিক্রম করে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলাম। আমরা এখানে দুর্নীতি করতে বসিনি। নিজের ভাগ্য গড়তে বসিনি। দেশের মানুষের ভাগ্য গড়তে এসেছি, দেশের উন্নয়ন করতে এসেছি। সেটাই আজ প্রমাণ করেছি।’
প্রধানমন্ত্রী যখন নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন তখন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ছিলেন আতিউর রহমান। এই মানুষটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সবচেয়ে বেশি অভয় দিয়েছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী গভর্নরকে ডেকে পদ্মা সেতুতে বিদেশি কেনাকাটার জন্য যে বিদেশি মুদ্রা ব্যয় হবে-তা কীভাবে জোগাড় হবে সে বিষয়ে জানতে চেয়েছিলেন। সে সময় আতিউর রহমান প্রধানমন্ত্রীকে বলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণে যত ডলার লাগবে তার পুরোটাই বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে দেওয়া সম্ভব হবে। এরপর প্রধানমন্ত্রীর সাহস আরও বেড়ে যায়। ঝাঁপিয়ে পড়েন পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য।
আতিউর রহমান সে সময় বিষয়টি নিয়ে পদ্মা সেতুর প্রকল্প পরিচালক শফিকুল ইসলামের সঙ্গেও বৈঠক করেন। তিনি সে সময় বলেছিলেন, ‘পদ্মা সেতুর জন্যে কোন মাসে কত ডলার লাগবে, সে তথ্য ইতোমধ্যে অগ্রণী ব্যাংকের কাছে চেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অগ্রণী ব্যাংক যখন যে পরিমাণ চাহিদা জানাবে, তখনই ওই পরিমাণ ডলার যোগান দেওয়ার নিশ্চয়তা দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক।‘
বিষয়টি নিয়ে ২০১৬ সালের ১৬ মার্চ সমকালে একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন কিছুদিন আগে প্রয়াত সাংবাদিক-কলামিস্ট আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী। সেই লেখায় তিনি আতিউর রহমানের সাহসিকতার ভূয়সী প্রশংসা করেন। তিনি লিখেছিলেন, ‘বিশ্বব্যাংকের অনিভিপ্রেত আচারণের পর একজন গভর্নর যেভাবে প্রধানমন্ত্রীকে সাহস ভুগিয়েছেন, নিজস্ব অর্থায়নে দেশের মঙ্গলাকাঙ্ক্ষায় সংকল্প ব্যক্ত করেছেন তা বিরল।’
বিষয়টি নিয়ে সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমার কয়েক দফা বৈঠক হয়েছে। তবে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক ছিল প্রথমটি। তিনি আমাকে সরাসরি প্রশ্ন করেছিলেন, পদ্মা সেতুর জন্য যে বিদেশি মুদ্রার প্রয়োজন হবে, তা জোগান দেয়া সম্ভব হবে কিনা?’ আমি বলেছিলাম অবশ্যই সম্ভব হবে। কীভাবে হবে, তার একটি রূপরেখাও দিয়েছিলাম আমি।
‘তখন প্রতি মাসেই রিজার্ভ বাড়ছিল। রেকর্ডের পর রেকর্ড হচ্ছিল। প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে বেশি বেশি অর্থ দেশে পাঠাচ্ছিলেন। এক পর্যায়ে রিজার্ভ ৩০ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করে। তখন নিশ্চিত ছিলাম, পদ্মা সেতুর জন্য যে বিদেশি মুদ্রার প্রয়োজন তাতে রিজার্ভের ওপর কোনো চাপ পড়বে না। সেটাই কিন্তু হয়েছে; আজ সব ইতিহাস।
‘তবে এ সব কিছুই সম্ভব হয়েছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশপ্রেম-দুরদর্শিতা আর সাহসের কারণে।’
কীভাবে পদ্মায় বিদেশি মুদ্রা ব্যয় হয়েছে
পদ্মা সেতু নির্মাণ নিয়ে অচলাবস্থার সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেক্স রিজার্ভ অ্যান্ড ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের মহাব্যবস্থাপকের দায়িত্ব পালন করছিলেন কাজী ছাইদুর রহমান। আতিউর রহমানের নির্দেশনায় পদ্মা সেতুতে বিদেশি অর্থ জোগানোর পুরো বিষয়টি দেখভাল করেন তিনি।
কাজী ছাইদুর রহমান এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নরের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মূলত প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের ওপর ভর করেই সে সময় রিজার্ভ সন্তোষজনক অবস্থায় পৌঁছেছিল। আর রিজার্ভ ভালো অবস্থায় থাকায় সরকার নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণের সাহস পেয়েছিল।’
তিনি বলেন, ‘পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য যে ডলার প্রয়োজন হতো সরকার রিজার্ভ থেকে স্থানীয় মুদ্রায় (টাকা) তা কিনে নিয়ে এফসি অ্যাকাউন্টে রাখত; সেখান থেকে প্রয়োজনীয় খরচ করত।
‘এখানে একটি বিষয় মনে রাখতে হবে, সরকার ইচ্ছে করলেই রিজার্ভ থেকে ডলার নিতে পারত না। টাকা দিয়ে কিনতে হয়েছে। সরকারের হাতে ডলার কেনার মতো প্রয়োজনীয় টাকা না থাকলে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে টাকা ঋণ নিয়ে ডলার কিনতে হতো।’
২০১০ সালের অগাস্টে বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে ১০০ কোটি ডলারের যে ঋণচুক্তি করে, তার মধ্যে অনুদান হিসেবে দেয়া হয় ২০ কোটি ডলার। ভারতের অনুদানের এই অর্থ পদ্মা সেতু নির্মাণে ব্যয় করা হয়েছে।
ওই ২০ কোটি ডলার এফসি অ্যাকাউন্টে যোগ হয়েছিল; সেখান থেকেই খরচ করা হয়েছে।
পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন নিয়ে টানাপড়েনের মধ্যে ২০১৩ সালের ৩১ জানুয়ারি এ প্রকল্পের প্রধান ঋণদাতা বিশ্বব্যাংকের অর্থ না নেয়ার সিদ্ধান্ত জানায় সরকার। ২৯১ কোটি ডলারের এ প্রকল্পে ১২০ কোটি ডলার ঋণ দেয়ার জন্য চুক্তি করেছিল বিশ্বব্যাংক।