২০১২ সালের ৪ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন। এর পরই শুরু হয় স্বপ্নের এই সেতু নিমার্ণের কর্মযজ্ঞ। সেতু নির্মাণে বিদেশি কেনাকাটায় বিপুল অঙ্কের যে বিদেশি মুদ্রার প্রয়োজন, তা জোগানের আশ্বাস দেন সে সময়কার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান।
জরুরি প্রয়োজনে আতিউর রহমান বর্তমানে কানাডায় অবস্থান করছেন। সেখান থেকে বৃহস্পতিবার জুমে যুক্ত হয়ে নিউজবাংলা টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে পদ্মা সেতুতে বিদেশি মুদ্রা সরবরাহের গল্প শোনান তিনি। সেই সঙ্গে পদ্মা সেতু বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কী বিপ্লব আনবে, একজন অর্থনীতিবিদ হিসেবে সে বিষয়েও বিস্তারিত বলেছেন।
আতিউর বলেন, ‘আমরা সম্ভাব্যতার বড় জায়গাটায় না গেলাম, সর্বনিম্ন সমীক্ষাটিই যদি গ্রহণ করি, তাও তো জিডিপি বাড়ার হার ন্যূনতম এক শতাংশ হবে। এটাই হলো আমাদের পদ্মা সেতু, যা বাংলাদেশের সক্ষমতা, সমৃদ্ধি, অহংকার ও সাহসের প্রতীক, যার স্বপ্ন দেখিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।’
তিনি বলেন, ‘উত্তরবঙ্গে যমুনা নদীতে বঙ্গবন্ধু সেতু চালু হওয়ার হওয়ার পর দেশের অর্থনীতিতে বিরাট বিস্ফোরণ ঘটেছিল, যার ধারাবাহিকতা এখনও আছে। পদ্মা সেতু চালুর ফলে আগামীর অর্থনীতিতে তার চেয়েও বড় বিস্ফোরণ ঘটাতে যাচ্ছে।’
নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণের সাহস প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কীভাবে পেয়েছিলেন, এমন প্রশ্নের জবাবে আতিউর রহমান বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাহস কখনোই কম ছিল না। সেই সময়ও তিনি সাহসী ভূমিকা পালন করেছেন। বিশ্বব্যাংক যে নোংরামি করেছিল, তা আমাদের ক্ষুব্ধ করে। সেটা আমি খুব কাছে থেকে দেখেছি। আমার স্পষ্ট মনে আছে, আমরা বাজেট নিয়ে মিটিং করেছি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে।
‘মিটিং শেষ করার পর আমি ও প্রধানমন্ত্রী বসেছিলাম। সেখানে আমরা জানতে পেরেছিলাম, কী ধরনের নোংরামি বিশ্বব্যাংক শুরু করেছে। বিশ্বব্যাংকের ইন্টিগ্রিটি ডিপার্টমেন্ট থেকে বাংলাদেশ সম্পর্কে এমন অভিযোগ আনা হয়েছিল, যেটা আমাদের জন্য মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। সেই সময় প্রধানমন্ত্রী সাহস জুগিয়েছিলেন এটি বলে যে, আমরা কি পারব না এই পরিমাণ অর্থ জোগাড় করতে?’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক এ গভর্নর বলেন, ‘২০০৯ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যখন সরকার গঠন করেন, তখন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৭ বিলিয়ন ডলারের নিচে। পরের বছরই এটা আমরা ১০ বিলিয়নে নিয়ে গেলাম। তার পরের বছর থেকে এটা বাড়ছে। যখন আমরা পদ্মা সেতুর অর্থায়ন নিয়ে আলাপ করছি, তখন এটা ১৪ থেকে ১৫ বিলিয়ন হয়ে গেছে। সেই সময়ই প্রবাসী আয়, রপ্তানি আয় বাড়ছে।
‘প্রধানমন্ত্রীর সাহসের বড় জায়গা হলো যে, তিনি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ গ্রোথ (অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি) দেখতে পেয়েছিলেন। বাংলাদেশে যে এত দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাবে, এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে গতিশীল দেশ হবে এবং সেখানে যে এমন এক সময় আসবে, যখন বাংলাদেশের এক্সপোর্ট দ্রুত এগিয়ে যাবে, এগুলো তিনি অনুধাবন করেছিলেন বলে সাহস করেছিলেন।
‘প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একাত্মতা জানিয়ে আমরাও বলেছিলাম অবশ্যই সম্ভব। এক দিনেই তো এই পরিমাণ ডলার লাগবে না। ১.৪ বিলিয়ন ডলারের কথা বলা হচ্ছে; সেটা তো একবারেই লাগছে না। কোনো বছরে হয়তো ২০০ মিলিয়ন ডলার, কোনো বছরে হয়তো ৫০০ মিলিয়ন ডলার লাগবে। এভাবে ভেঙে ভেঙে আমরা ফরেন এক্সচেঞ্জ দিতে পারব।
‘আমরা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কথা দিয়েছিলাম, একটা কমফোর্ট লেটার দিতে হয় যে কনসালট্যান্ট কাজ করবে তাকে। অগ্রণী ব্যাংক কমফোর্ট লেটার দেয়ার কাজটা করেছে। আমার মনে আছে, ২০১৪ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকে পদ্মা সেতুর প্রকল্পের কর্মকর্তা, বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেন এক্সচেঞ্জ বিভাগের কর্মকর্তা আর অগ্রণী ব্যাংকের কর্মকর্তারা মিলে আমরা একটা সভা করেছিলাম। সে সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছিল, অগ্রণী ব্যাংক তার তহবিল থেকে ফরেন এক্সচেঞ্জ দেবে। বাজারে কিনতে পাওয়া গেলে কিনবে এবং না পেলে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সমর্থন দেয়া হবে।
‘এর বাইরেও আলোচনা হয়েছিল ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানিকে কমফোর্ট লেটার অগ্রণী ব্যাংক দেবে। খুব দ্রুত সময়ে যাতে অনুমোদন দিতে পারে, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে তার ব্যবস্থা করেছিলাম। যখনই ফরেন এক্সচেঞ্জ কোথাও পাঠাতে হয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্ব অনুমোদন লাগে। আমরা বলেছি, যতবার লাগবে ততবার দেবার প্রয়োজন নেই। একবারে আমরা দিয়ে দেব। পদ্মা সেতুর যত খরচ লাগে, বছরের শুরুতে একবারে আমরা সেই অনুমোদন দিয়ে দেব। এ রকম একটা সুবিধা আমরা করেছিলাম।’
সে সময়কার পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর বলেন, ‘আরেকটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। চিঠিতে রিকুয়েস্ট আসবে না বাংলাদেশ ব্যাংকে। সরাসরি আমাদের সংশ্লিষ্ট জেনারেল ম্যানেজারের কাছে আসবে অগ্রণী ব্যাংক বা অন্য যেকোনো ব্যাংক থেকে এবং সরাসরি সেখানে অনুমোদন দিয়ে দেয়া হবে।
‘এ রকম অনেকগুলো সিদ্ধান্ত নেয়ার ফলে যেটাকে বলে রেগুলেটরি কমফোর্ট, সেটা আমরা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে দিতে সমর্থ হয়েছিলাম। আমাদের এই ব্যবস্থাটা খুব কাজে লেগেছিল। এ রকম সংকটকালে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে উন্নয়নমুখী পদক্ষেপ নিতে পেরেছিল, তার প্রশংসা করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, এর জন্য তার কাছে আমরা কৃতজ্ঞ।’
তিনি বলেন, ‘কোভিডকালে উন্নয়নমুখী পদক্ষেপে বাংলাদেশ ব্যাংক ভূমিকা রাখতে পেরেছিল। এটা সম্ভব হয়েছিল আমাদের প্রবাসীদের কারণে। প্রবাসীরা এমনই অনুপ্রাণিত ছিল পদ্মা সেতুর ব্যাপারে। সেই সময় আমরা শত শত ইমেইল ও এসএমএস পেয়েছি। তারা জানতে চেয়েছিলেন, কোথায় কীভাবে ডলার পাঠাবেন। আমরা তাদের আশ্বস্ত করেছিলাম, যখন আমাদের দরকার হবে, তখন আমরা চাইব।’
পদ্মা সেতু কোথায় নিয়ে যাবে বাংলাদেশকে এমন প্রশ্নের জবাবে আতিউর বলেন, “পদ্মা সেতু শুধু একটি সেতু নয়। পদ্মা সেতু আমাদের আত্মমর্যাদার প্রতীক, সক্ষমতার স্মারক। পদ্মা সেতুর কারণে আমাদের জাতীয় মননে ‘আমরাও পারি’ সংস্কৃতিটি বেশ জোরদার হয়েছে।
‘প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যার, যিনি এই পদ্মা সেতুর কারিগরি কমিটির প্রধান ছিলেন, তিনি আমাকে ব্যক্তিগতভাবে এবং একটি অনুষ্ঠানে বলছিলেন, বিশ্বব্যাংক যে অন্যায় অভিযোগ এনেছে, তার কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই। এই পদ্মা সেতু আমরা করতে পারি এবং করব। এর ফলে আমাদের যে সক্ষমতা তৈরি হবে, তাতে আমরা এ রকম আরও ১০টি সেতু ভবিষ্যতে তৈরি করতে পারব। আমাদের প্রকৌশলীরা, কন্ট্রাক্টররা, ব্যবস্থাপকরা এই পদ্মা সেতুতে এমনভাবে হাত পাকাবে যে ভবিষ্যতে আমরা এর চেয়ে বড় বড় সেতু তৈরি করব।’
আতিউর রহমান বলেন, ‘এটি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের দিক থেকে চ্যালেঞ্জিং সেতু। পৃথিবীর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ খরস্রোতা নদী হলো পদ্মা। ১২৮ মিটার গভীর পিলারের ওপরে সেতু বসাতে হয়েছে। এটি কঠিন বাস্তবতার মধ্যে বসাতে হয়েছে। আমাদের জাতীয় অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর নেতৃত্বে কারিগরি টিম এটাকে গাইড করেছে। সেনাবাহিনীর প্রকৌশলী, আব্দুল মোনেম গ্রুপ এবং বিদেশিরা একসঙ্গে মিলে এখানে আমরা কাজ করেছি। এর ফলে এ রকম মেগা প্রকল্প আমরা করতে পারব। এই সক্ষমতার বীজ প্রধানমন্ত্রী আমাদের মধ্যে বুনে দিলেন। এটা প্রথম অর্জন।
‘দ্বিতীয়ত, পদ্মা সেতুর কারণে দক্ষিণ বাংলার সঙ্গে সারা বাংলাদেশের একটা সংযোগ বেড়ে গেল। কানেকটিভিটি আরও বাড়বে, যখন রেল চালু হবে। আমরা হিসাব করে দেখেছি, সেতু চালু হওয়ার পরে আমাদের জাতীয় আয়ে বছরে আরও ১.২৬ শতাংশ যুক্ত হবে। ওই ২১টি জেলার যে জিডিপি, সেখানে সাড়ে ৩ শতাংশ হারে বাড়তি জিডিপি যুক্ত হবে। যতই দিন যাবে ততই তা বাড়তে থাকবে।
‘বঙ্গবন্ধু সেতু যেটি রয়েছে, সেটির আলোকে বলছি। সেখানে প্রায় ২ শতাংশ নতুন জিডিপি যুক্ত হয়েছে বছরে। আমাদের এখানেও যুক্ত হবে। আমরা আরেকটি হিসাব করে দেখেছি, পদ্মা সেতুর কারণে অর্থনীতির যে বিস্ফোরণ ঘটবে, দক্ষিণ বাংলায় তার প্রভাবে কলকারখানা, স্মল ও মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজ, রিসোর্টে হবে। ট্যুরিজমের সুযোগ বাড়বে। বরিশাল, খুলনায় জাহাজ শিল্প গড়ে উঠবে। পায়রা ও মোংলা বন্দরের ক্যাপাসিটি অনেক বাড়বে।
‘রেলে ও সড়কে কলকাতা যেতে সময় অর্ধেক হয়ে যাবে। এর কারণে এই অঞ্চলে ভুটান, নেপাল, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম–এসব জায়গাতে আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য বেড়ে যাবে। একই সঙ্গে এর মাধ্যমে আমরা ট্রান্স এশিয়ান হাইওয়ে ও রেলের সঙ্গে যুক্ত হব। দক্ষিণ বাংলায় অনেক রাস্তাঘাট রয়েছে, যেগুলো ব্যবহার হয় না। এই কানেকটিভিটির কারণে এগুলোর ব্যবহার বেড়ে যাবে এবং সক্ষমতা বেড়ে যাবে।’
পদ্মা সেতু দারিদ্র্য কমাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করে আতিউর বলেন, ‘প্রতি বছর পদ্মা সেতুর কারণেই ১.০২ শতাংশ দারিদ্র্য কমবে। এই ২১ জেলার যে দারিদ্র্য, তা আমাদের দেশের গড় দারিদ্র্যের চেয়ে ৫ শতাংশ বেশি। অথচ পদ্মা সেতু হওয়ার পরই আরও ১ শতাংশের বেশি করে দারিদ্র্যের হার কমতে থাকবে।
‘যে কর্মসংস্থান হবে, তাতে টোটাল লেবার ফোর্সের ১.২ শতাংশ করে কর্মীর বাড়তি কর্মসংস্থান হবে। সেটা হিসাব করলে দেখা যায়, ২ লাখেরও বেশি মানুষের নতুন করে কর্মসংস্থান হবে। এটা বাড়তেই থাকবে। ৫ বছরের মধ্যে এটা ১০ লাখ ছাড়িয়ে যাবে।’
কৃষকরা কী সুফল পাবেন, তা নিয়ে আতিউর রহমান বলেন, ‘কৃষকরা যারা পণ্য উৎপাদন করেন, তারা কিন্তু ঢাকার বাজার ধরতে পারছিলেন না। তারা ঘাটে এসে বসে থাকতেন; ট্রাক বসে থাকত, মাল পচে যেত, সেগুলো এখন দ্রুত চলে আসবে।
‘এ ছাড়া ছোট ব্যবসায়ী, যাদের কাঁচামাল নরসিংদী থেকে বা ঢাকা থেকে নিতে কষ্ট হত, এগুলো এখন সহজেই চলে যাবে। সুতরাং পণ্য ও মানুষের এই চলাচলের ফলে অর্থনীতিতে চাঙা ভাব চলে আসবে। আরেকটি ঘটনা ঘটবে, জামিলুর রেজা স্যারই বলেছিলেন। পদ্মা সেতু এমন সম্ভাবনা তৈরি করবে যে, সেতুর ওই পারে আমরা সাংহাইয়ের মতো নতুন শহর তৈরি করতে পারব। আমরা সেই দিকেই যাচ্ছি। সেখানে নতুন বিমানবন্দর হতে পারে। সেখানে ইতোমধ্যে বেশ কিছু অবকাঠামো শুরু হয়েছে। একটি তাঁতপল্লি হচ্ছে জাজিরাতে।’
ফরিদপুরের সম্ভাবনা নিয়ে আতিউর রহমান বলেন, ‘ফরিদপুর একটা বড় সেন্টার হিসেবে গড়ে উঠবে। ভাঙ্গা একটি নতুন স্মার্ট শহর হয়ে যাবে। শরীয়তপুর, মাদারীপুর এসব জায়গায় নতুন নতুন শহর গড়ে উঠবে। সুতরাং আমার মনে হয় যে, পদ্মা সেতু আমাদের অর্থনীতির জন্য নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিচ্ছে।’