রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কা, ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতিসহ নানা অনিশ্চয়তার মধ্যে বেড়েছে বৈদেশিক ঋণসহায়তা।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ-ইআরডি বৃহস্পতিবার জানিয়েছে, বিদেশি ঋণসহায়তা প্রাপ্তিতে রেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশ। বিদায়ী অর্থবছর শেষ হতে এক মাস (জুন) বাকি থাকতেই ৮০০ কোটি (৮ বিলিয়ন) ডলারের মাইলফলক ছাড়িয়েছে বিদেশি ঋণ।
৩০ জুন শেষ হওয়া ২০২১-২২ অর্থবছরের ১১ মাসে অর্থাৎ জুলাই-মে সময়ে বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে ৮৪১ কোটি ৬০ লাখ (৮.৪১ বিলিয়ন) ডলারের ঋণসহায়তা পেয়েছে বাংলাদেশ। বর্তমান বিনিময় হার হিসাবে (প্রতি ডলার ৯২ টাকা ৯৫ পয়সা) টাকার অঙ্কে এই অর্থের পরিমাণ ৭৮ হাজার ২২৭ কোটি; যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৪৭ শতাংশ বেশি। আর গত অর্থবছরের পুরো সময়ের চেয়ে বেশি ১৪ শতাংশ।
দেশের ইতিহাসে এর আগে কোনো অর্থবছরের পুরো সময়েও (১২ মাস) এত বেশি বিদেশি ঋণ আসেনি।
অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুর বলছেন, ‘দুই বছরের বেশি সময় ধরে চলা মহামারির ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে প্রত্যাশার চেয়েও বেশি ঋণসহায়তা পাওয়ায় এই উল্লম্ফন হয়েছে।’
অর্থবছর শেষে ঋণের অঙ্ক ৯ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলে প্রত্যাশা করছেন ইআরডি কর্মকর্তারা।
ইআরডির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত ২০২০-২১ অর্থবছরে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে ৭১০ কোটি (৭.১ বিলিয়ন) ডলার ঋণসহায়তা পেয়েছিল বাংলাদেশ।
তার আগে ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বিদেশি ঋণ আসে বাংলাদেশে। ওই বছর ৭৩৮ কোটি (৭.৩৮ বিলিয়ন) ডলার ঋণ পাওয়া গিয়েছিল।
বাংলাদেশে বিদেশি ঋণ বাড়তে থাকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে। ওই বছরই এক লাফে অর্থছাড় ৩০০ কোটি থেকে ৬৩৭ কোটি ডলারে উন্নীত হয়। তারপর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আসে ৬৫৪ কোটি ডলার।
শ্রীলঙ্কায় অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের পর বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ নিয়েও নানা কথা হচ্ছে। যদিও দুই দেশের তুলনা নাকচ করছেন অর্থনীতি বিশ্লেষকেরা। তারা বলছেন, বাংলাদেশের জিডিপির তুলনায় বৈদেশিক ঋণ এখনও ১৩ শতাংশের নিচে; আর শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রে তা ৫০ শতাংশের কাছাকাছি।
ইআরডি সচিব ফাতিমা ইয়াসমিন জোর দিয়ে বলেছেন, ‘বাংলাদেশের বিদেশি ঋণের সুদের হার খুবই কম। বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি খুবই ভালো অবস্থায় আছে; প্রতিটি সূচক ইতিবাচক। শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তান মিলিয়ে যা রিজার্ভ আছে, বাংলাদেশের তার দ্বিগুণেরও বেশি আছে। শ্রীলঙ্কার মতো একটি ভুলও করেনি বাংলাদেশ। তাই বিদেশি ঋণ নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। কম সুদের বিদেশি ঋণ যত বাড়বে, বাংলাদেশের উন্নয়ন ততই ত্বরান্বিত হবে।’
ইআরডি বৃহস্পতিবার বিদেশি ঋণসহায়তার প্রতিশ্রুতি ও ছাড়ের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই থেকে মে পর্যন্ত বাংলাদেশকে ৫৯১ কোটি (৫.৯১ বিলিয়ন) ডলার ছাড় করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল দাতারা। পাওয়া গেছে ৮৪১ কোটি ৬০ লাখ ডলার।
এ হিসাবে এই ১০ মাসে দাতারা বাংলাদেশকে যে ঋণ দিতে চেয়েছিল তার থেকেও ৪২ দশমিক ৪০ শতাংশ বেশি ছাড় করেছে। বিদেশি ঋণসহায়তা প্রাপ্তিতে এমনটা বিরল।
ছাড় করা ঋণের মধ্যে ৮২২ কোটি ৭৫ লাখ ডলার পাওয়া গেছে প্রকল্প সাহায্য হিসেবে। ১৮ কোটি ৮৫ লাখ ৪০ হাজার ডলার পাওয়া গেছে অনুদান। এর মধ্যে ২৫ লাখ ৩০ হাজার ডলার খাদ্য অনুদান এবং ১৮ কোটি ৬০ লাখ ১০ হাজার ডলার প্রকল্প অনুদান হিসেবে পাওয়া গেছে।
২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ে ৫৭২ কোটি ৬০ লাখ ৭০ হাজার ডলার ছাড় করেছিল দাতারা।
সে হিসাবেই এই ১০ মাসে বিদেশি ঋণসহায়তা বেড়েছে ৪৭ শতাংশ।
প্রতিশ্রুতি বেড়েছে ১০.২০ শতাংশ
ইআরডির তথ্য বলছে, ২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ে ৫৩৬ কোটি ২৭ লাখ ডলারের ঋণসহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল দাতারা। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে সেই প্রতিশ্রুতির চেয়ে ১০ দশমিক ২০ শতাংশ বাড়িয়ে ৫৯১ কোটি ডলার করেছে।
সুদ পরিশোধ বেড়েছে ১০ শতাংশ
এই ১১ মাস আগে নেয়া ঋণের আসল ও সুদ পরিশোধের পরিমাণ বেড়েছে ১০ শতাংশ। এ সময়ে সরকার আসল ও সুদ বাবদ উন্নয়ন সহযোগীদের ১৮৮ কোটি ৬৭ লাখ ডলার শোধ করেছে। গত অর্থবছরে একই সময়ে এই অঙ্ক ছিল ১৭১ কোটি ৫৬ লাখ ডলার।
‘শ্রীলঙ্কা হবে না বাংলাদেশ’
ইআরডি সচিব ফাতিমা ইয়াসমিন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কম সুদের বিদেশি ঋণসহায়তা বাংলাদেশের উন্নয়নে বরাবরই অবদান রেখে চলেছে। অনেকে না বুঝেই এ বিষয়ে কথা বলছেন। এসবের কোনো ভিত্তি নেই। দুই-আড়াই বছরের মহামারির পর এখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ গোটা বিশ্ব অর্থনীতিকেই পাল্টে দিয়েছে। এরপরও আমরা বেশ ভালো অবস্থায় আছি। এই ঋণ আমাদের অর্থনীতির গতি ইতিবাচক ধারায় রাখতে অবদান রাখছে।’
বাংলাদেশে কেন শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি নেই তা ব্যাখ্যা করে নতুন অর্থসচিব হিসেবে নিয়োগ পাওয়া ফাতিমা ইয়াসমিন বলেন, ‘মহামারি করোনার ধাক্কা দ্রুত কাটিয়ে উঠছি আমরা। পৃথিবীর অনেক দেশই তা পারেনি। গত অর্থবছরে আমরা ৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। বিদায়ী অর্থবছরে ৭ দশমিক ২৫ শতাংশের বেশি অর্জিত হবে। রপ্তানি আয় বেড়েছে ৩৫ শতাংশের বেশি। রাজস্ব আদায়ে ১৫ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বেড়ে ১২ শতাংশ ছাড়িয়েছে।
‘সব মিলিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি শক্ত মজবুত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থায় আছে আমাদের অর্থনীতি।’
ফাতিমা ইয়াসমিন বলেন, ‘আমাদের বিদেশি ঋণ জিডিপির ১২ শতাংশ; আর শ্রীলঙ্কার ৪৮ শতাংশ। আমাদের ঋণের সুদের হার মাত্র ১ দশমিক ৪ শতাংশ; শ্রীলঙ্কার ১২ শতাংশ। শ্রীলঙ্কার বিদেশি ঋণের পরিমাণ ৩৫ বিলিয়ন ডলার; আমাদের ৫০ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশের ঋণ ঝুঁকিমুক্ত। শ্রীলঙ্কাকে প্রতি বছর সুদ-আসল বাবদ ৭ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতে হয়। আমাদের করতে হয় দুই-আড়াই বিলিয়ন ডলার।
‘আমাদের কোনো সভরেন বন্ড ঋণ নেই, বাণিজ্যিক ঋণও নেই। আমাদের ঋণ পরিশোধ নিয়ে কোনো ঝুঁকি নেই। আগামী ১০ বছর ঋণ পরিশোধে কোনো সমস্যা নেই বাংলাদেশের। অথচ শ্রীলঙ্কার এক কিস্তি শোধ করারও ক্ষমতা নেই।’
তবে বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে সার্বিক বিষয় বিবেচনায় নিয়ে আত্মতুষ্টিতে না ভুগে সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদ পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘দেশের প্রয়োজনে কম গুরুত্বপূর্ণ অনেক মেগা প্রকল্পও নেয়া হচ্ছে। তবে এসব প্রকল্পে করা বিনিয়োগ দ্রুত সময়ে ফেরত না এলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সংকট দেখা দিতে পারে।
‘আমাদের অনেকগুলো মেগা প্রকল্প হচ্ছে, যেগুলোর প্রয়োজন আছে। তবে এমন অনেকগুলো আছে, যেগুলোর এই মুহূর্তে আসলে কোনো উপযোগিতা বা প্রয়োজন নেই। পদ্মা সেতু আমাদের অবশ্যই দরকার আছে। এটা চালু হলে প্রথম দিন থেকেই রিটার্ন আসবে।‘