মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও সামগ্রিক অর্থনৈতিক চাপ মোকাবিলার কথা মাথায় রেখে আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নের কারণে পুঁজিবাজারের প্রতি কম মনোযোগ দেয়া হয়েছে বলে মনে করেন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) চেয়ারম্যান ইউনুসুর রহমান।
গত ৯ জুন বাজেট পেশের পর প্রস্তাবিত বাজেটকে স্বাগত জানিয়ে বিবৃতি দেয়ার দুই সপ্তাহ পর মঙ্গলবার বাংলাদেশ ইনস্টিটিটিউট অব ক্যাপিটাল মার্কেট-বিআইসিএমের এক সেমিনারে তিনি এমন মন্তব্য করেন। সেমিনারের বিষয় ছিল, ‘বাজেট ২০২২-২৩: ইমপ্লিকেশনস ফর দ্য ক্যাপিটাল মার্কেট।’
ডিএসই চেয়ারম্যান বলেন, ‘বাজেটের পরে সংবাদ সম্মেলনে আমরা জানিয়েছি, এ বছরের বাজেটে পুঁজিবাজারের ওপরে সরকার মনোযোগ কম দিয়েছে। এ রকমেরই একটা ধারণা দাঁড়ায়।’
পরক্ষণেই বাজেটে পুঁজিবাজারকে কম গুরুত্ব দেয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘এ বছরের মূল্যস্ফীতি আমদানিজনিত। যেসব দেশ গত ১০ বছরেও মূল্যস্ফীতি দেখে নাই, তারা মূল্যস্ফীতির চরম পর্যায়ে চলে গেছে। এগুলো আমাদের বাজেটপ্রণেতারা চিন্তা করেছেন। কীভাবে আমাদের স্বাস্থ্য খাত পুনরুদ্ধার করা যাবে, আমাদের কর্মসংস্থানের অবস্থা কী হবে, আমাদের সাবসিডির অবস্থা কী হবে- এসব বিষয় বাজেট প্রণয়নে গুরুত্ব পেয়েছে।
‘আমাদের জ্বালানি খাতে ব্যাপক ভর্তুকি দিতে হয়। আমি জ্বালানি কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলাম, তাই জানি। কৃষি খাতে, সার-বীজ এগুলোর দাম সহনীয় রাখতে ভর্তুকি যায়, বিদ্যুৎ খাতেও দিতে হয়। এরপরেই আমাদের সোশ্যাল সেফটি নেট প্রকল্প, যেগুলোর সাইজ প্রতি বছরই বাড়ে। এই জায়গাগুলোতে গুরুত্ব দিতে গিয়ে আমরা যে প্রত্যাশা করেছিলাম তার প্রতিফলন দেখতে পাইনি।’
পুঁজিবাজারের বিকাশে সরকারের ভূমিকাও স্মরণ করেন ডিএসই চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের ক্যাপিটাল মার্কেটের অনেক সমালোচনা রয়েছে। সমালোচনা থাকলেও পুঁজিবাজার আজকে যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, সেটি সরকারের নীতিসহায়তার সাহায্যেই আসতে পেরেছে।’
সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন বিআইসিএম নির্বাহী প্রেসিডেন্ট মাহমুদা আক্তার।
সেমিনারে মূল প্রবন্ধে বিআইসিএমের রিসার্চ ফেলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক সুবর্ণ বড়ুয়া বলেন, ‘পুঁজিবাজারকে নিরুৎসাহিত করার মতো কোনো বিষয় বাজেটে নেই। পুঁজিবাজারের জন্য সরকারের প্রণোদনাও কম। এখানে দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে।’
পুঁজিবাজারে লিস্টেড কোম্পানিগুলোর জন্য প্রস্তাবিত ২০ শতাংশ করহার শর্তহীন হওয়া উচিত বলেও মনে করেন তিনি। বলেন, ‘পুঁজিবাজারের মধ্যস্থতাকারীদের জন্য আর্থিক উদ্দীপনা থাকা উচিত, যাতে পুঁজিবাজারের উন্নয়নের জন্য তারা আরও সক্রিয়ভাবে কাজ করে।’
আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর করহার আড়াই শতাংশ কমিয়ে ২০ শতাংশ করার কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। তবে যেসব কোম্পানি তার মোট শেয়ারের কমপক্ষে ১০ শতাংশ বাজারে ছেড়েছে, তারাই এর সুফল পাবে।
আবার ব্যাংক, বিমা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, মোবাইল কোম্পানি, তামাক কোম্পানির করহার আগের মতোই সাড়ে ৩৭ থেকে ৪০ শতাংশ থাকবে।
পেনশন ফান্ডকে পেশাদার ফান্ড ম্যানেজারের মাধ্যমে বিনিয়োগ করাসহ আরও কিছু পরামর্শ দেন সুবর্ণ বড়ুয়া।
তার সঙ্গে যৌথভাবে মূল প্রবন্ধ তৈরি করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক সজীব হোসেন।
আলোচক হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও সিরডাপের রিসার্চ ডিরেক্টর হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘বাজেটে সরকার সঠিকভাবে বৈশ্বিক যে ফ্যাক্টরগুলো রয়েছে সেগুলোকে প্রাধান্য দিয়েছে। পরিস্থিতির বিবেচনায় সেক্টরগুলোকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘পুঁজিবাজারের ক্ষেত্রে আমার বক্তব্য হলো, পুঁজিবাজারে যেখানে ডিমান্ড চুপসে গেছে, সেখানে সাপ্লাই বাড়ানো উচিত নয়। বাজেটের যে বিষয়গুলো এসেছে, তা পুঁজিবাজারের জন্য পজিটিভ। কালো টাকা পুঁজিবাজারে আসার সুযোগ দেয়া এমন কোনো বিষয় নয়, যা পুঁজিবাজারকে প্রভাবিত করবে। অর্থনীতিতে বাইরের যে ঢেউ এসেছে সেটা সামলে নিতে হবে। বিএসইসির সাপ্লাই পলিসির দিকটিও ভাবা উচিত।’
বাংলাদেশ ব্যাংক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে পুঁজিবাজারের প্রতি পক্ষপাতমূলক আচরণ করে এমন অভিযোগ ঠিক নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক টার্গেট করে শেয়ার মার্কেট ডাউন করা পলিসি দিচ্ছে তা কিন্তু নয়। বাংলাদেশ ব্যাংককে পলিসি নিতে হয় সামগ্রিক অর্থনীতির কথা বিবেচনা করে।’
চিটাগং স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) চেয়ারম্যান আসিফ ইব্রাহিম, স্নেহাশিস মাহমুদ অ্যান্ড কোং-এর পার্টনার স্নেহাশিস বড়ুয়া, ক্যাপিটাল মার্কেট জার্নালিস্ট ফোরামের (সিএমজেএফ) সভাপতি জিয়াউর রহমানও সেমিনারে বক্তব্য রাখেন।