দেশে ২ কোটি ৮৬ লাখ ৯৫ হাজার ৭৬৩টি পরিবারে চিবোতে পারে এমন সকলের অভিন্ন খাবার মুড়ি। দেশে রয়েছে মুড়ির বিশাল বাজার ও চাহিদা। অথচ এটি এখনও এতই অনানুষ্ঠানিক একটি পণ্য হয়ে আছে যে অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় এটির ভ্যাট প্রত্যাহারের ঘোষণা না দিলে মুড়ি কারও দৃষ্টিতেই আসত না।
জাতিসংঘের পূর্বাভাস অনুযায়ী ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বিশ্ব এখন খাদ্য ঝুঁকিতে আছে। বাংলাদেশও এই বৈশ্বিক সংকটের বাইরে নেই। সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে মুড়িকে দেশের ভোক্তার কাছে সহজলভ্য করতে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে মুড়ির বাজারজাত পর্যায়ে থাকা ৫ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
পরিতাপের বিষয়, যে খাদ্যপণ্যটিকে ঘিরে অর্থমন্ত্রীর এই উদ্যোগ, দেশে সেই খাদ্যপণ্যের কোনো মর্যাদা নেই। দেশে সারা বছর কী পরিমাণে মুড়ি উৎপন্ন হয়, কতটুকু রপ্তানি হয় এবং মুড়িকে ঘিরে সারা বছর চলা বাণিজ্যের আকার কেমন– এ নিয়ে কারও কাছেই কোনো তথ্য নেই।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মুড়ির বিরাট চাহিদা থাকলেও সরকারিভাবে এর কদর কিংবা মর্যাদা কোনোটিই এখনও দেয়া হয়নি। দেশে ১৭ কোটি মানুষের জন্য মুড়ির চাহিদা কত তা দেশ স্বাধীন হওয়ার পর গত ৫১ বছরেও নিরূপণ করা হয়নি। খাদ্য মন্ত্রণালয়, কৃষি, শিল্প কিংবা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কারও কাছেই তথ্য নেই, মুড়ির উৎপাদনের পরিমাণ কত।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশে মুড়ি আমদানি হয় না। অভ্যন্তরীণ উৎপাদন দিয়েই চাহিদা পূরণ হয়। উদ্বৃত্ত কিছু মুড়ি প্রতি বছর বিদেশেও রপ্তানি হয়।
মুড়ি শুধু পারিবারিক চাহিদা পূরণেই উৎপাদন হয় না, এটা বাজারেও কিনতে পাওয়া যায়। কিন্তু দেশে ১ কোটি ৫১ লাখ ৮৩ হাজার ১৮৩টি কৃষি পরিবারের সবাই মুড়ি উৎপাদন করে না। তাহলে দেশে কৃষিবহির্ভূত ১ কোটি ৩৫ লাখ ১২ হাজার ৫৮০ পরিবারসহ বাকি যারা মুড়ি উৎপাদন করে না তাদের প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণ হচ্ছে কীভাবে?
সংশ্লিষ্টদের তথ্য মতে, সারা দেশে প্রত্যন্ত অঞ্চলে অনেক পরিবারই হাতে ভাজা মুড়ি উৎপাদন করে সংসার চালায়। এদের চেয়েও বড় চালানে ছোট পরিসরে কারখানায় মেশিনের সাহায্যে অসংখ্য ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা বাণিজ্যিকভাবে মুড়ি উৎপাদন করছেন। সম্প্রতি এ দুই স্তরকে ছাপিয়ে মুড়ির ব্যবসায় নেমেছে দেশের নামীদামি কয়েকটি করপোরেট প্রতিষ্ঠানও। এ তালিকায় প্রাণ, স্কয়ার, বসুন্ধরা, এসিআইসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান উল্লেখযোগ্য।
অর্থাৎ মুড়ি ভাজার গল্পটি সময়ের বদৌলতে এখন একটা শিল্পে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এই শিল্পে সারা দেশে কী পরিমাণ উদ্যোক্তা গড়ে উঠেছে, কতগুলো কারখানায় মুড়ি উৎপাদন হচ্ছে, এর বাইরে কতগুলো গ্রামে কতসংখ্যক পরিবার মুড়ি উৎপাদনে সম্পৃক্ত, এ খাতে কত শ্রমিক কাজ করছেন কিংবা কত লোক এ থেকে জীবিকা নির্বাহ করছেন– এসবের কোনো হিসাব নেই কোনো মন্ত্রণালয়, বিভাগ বা সংস্থার কাছে।
তবে দেশে পরিবেশ নিয়ে কাজ করা সংস্থা বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কৃষি প্রক্রিয়াকরণ সমিতি নিয়ে কাজ করছে দীর্ঘদিন ধরে। তাদের কিছু উদ্যোক্তা সদস্য দেশে মুড়ি উৎপাদন ও রপ্তানিতেও সম্পৃক্ত। বর্তমানে কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে বাপার কিছু সুপারিশকে গুরুত্ব দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)।
বাপার তথ্য মতে, সারা বছর দেশে মুড়ির সম্ভাব্য চাহিদা ৪১ হাজার ৭৮ টন, যার বাজারমূল্য ৯০ মিলিয়ন ডলার। এর বিপরীতে মুড়ি উৎপাদন হয় ২২ হাজার ৮২০ টন, যার বাজারমূল্য ৫০ মিলিয়ন ডলার।
২০১৮-১৯ অর্থবছরের তথ্য অনুযায়ী, ৭ হাজার ৬০৭ টন মুড়ি রপ্তানি হয়েছে, যার মূল্য ১২.০৩ মিলিয়ন ডলার। এ খাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ৬ লাখ মানুষ জড়িত। বর্তমানে বাপার সদস্যভুক্ত ৭৬টি নিবন্ধিত কোম্পানি মুড়ি উৎপাদনে সংশ্লিষ্ট আছে।
তবে বাপার এ তথ্যেরও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। কারণ দেশ মুড়ি রপ্তানি করছে। আমদানিও হচ্ছে না। এর মানে হচ্ছে চাহিদার সবটাই দেশে উৎপাদন হচ্ছে। ফলে চাহিদা ও উৎপাদনের মধ্যে সৃষ্ট ব্যবধানও প্রশ্নের উদ্রেক ঘটায়।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কৃষি মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা উইং-২-এর অতিরিক্ত সচিব রবীন্দ্র শ্রী বড়ুয়া নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কৃষি মন্ত্রণালয় দেখে মাঠ পর্যায়ের কৃষি ফলনের চিত্রটি। কিন্তু চালের প্রক্রিয়াজাত পণ্য মুড়ি বা চিড়ার মতো পণ্যগুলো কৃষি মন্ত্রণালয়ের হাতে থাকে না। তবে এটি হওয়া উচিত নয়। দেশে কী পরিমাণ মুড়ি উৎপাদন এবং ভোগ হয়, তার একটি সমীক্ষা তথ্য থাকা উচিত। এ খাতে কারা কীভাবে জড়িত বা শিল্পের সংখ্যাই কত, তা জানা জরুরি।
এ মন্ত্রণালয়ের আরেক অতিরিক্ত সচিব (পরিকল্পনা উইং) ড. মো. আবদুর রৌফ বলেন, ‘কৃষিপণ্যের উৎপাদনের পরে যেটা মূল্য সংযোজন হয়, যেমন চাল থেকে মুড়ি, গম থেকে আটা– এগুলো শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতায় পড়ে। এর হিসাব আমাদের কাছে থাকার কথা নয়।’
তিনি কৃষি বিপণন অধিদপ্তরে যোগাযোগের পরামর্শ দেন।
তবে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ও ওয়েসাইটে কর্মপরিধির পণ্য তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, কৃষি বিপণন অধিদপ্তরেও এ-সংক্রান্ত কোনো তথ্য নেই।
শিল্প মন্ত্রণালয়াধীন বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের পরিচালক (শিল্প উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ) মোহাম্মদ জাকির হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মুড়ির চাহিদা ও উৎপাদন এবং এ খাতে শিল্প সম্পর্কিত কোনো তথ্য আমরা সংরক্ষণ করি না। কাজও করি না।’
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল সূত্রের দাবি, তাদের কাজের পরিধি ধান-চাল ও গম নিয়ে। শুধু এগুলোর অভ্যন্তরীণ চাহিদা, উৎপাদন এবং ঘাটতির তথ্যগুলো তারা সংরক্ষণে রাখেন।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ভুক্ত রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) কমোডিটিস শাখার পরিচালক মোহাম্মদ শাহজালাল জানান, ‘আমরা শুধু মুড়ি রপ্তানি নিয়ে কাজ করি। বাংলাদেশের মুড়ি সৌদি আরব, দুবাই, আবুধাবিসহ বাঙালি কমিউনিটি যেখানে আছে, সেসব দেশে রপ্তানি হচ্ছে। কিন্তু যারা রপ্তানি করে তারা আলাদাভাবে মুড়ি রপ্তানিকারক হিসেবে আমাদের কাছে তালিকাভুক্ত হয়নি।’
ফলে কী পরিমাণ মুড়ি রপ্তানি হয়, সে সংক্রান্ত তথ্যও তাদের কাছে নেই।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মুড়ি বাজারজাতকারী অন্যতম করপোরেট প্রতিষ্ঠান প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক (মার্কেটিং) কামরুজ্জামান কামাল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এ বিষয়ে সরকার কেন উদাসীন, এটা সঠিক বলতে পারব না। হয়তো সরকার বেসিক নিয়েই কাজ করছে, তাই চাল, ডাল, তেল, গম এগুলোর হিসাব-নিকাশ থাকে। মুড়ি অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের মধ্যে পড়ে না বলেই হয়তো মুড়ি নিয়ে সরকারের এতো হিসাব-নিকাশ নাই। তা ছাড়া শুধু মুড়ি কেন, দেশে অনেক প্রয়োজনীয় পণ্য নিয়েই কোনো গবেষণা বা সমীক্ষা করা হয় না।
‘মুড়ি উৎপাদন নিয়ে বাপা যে তথ্য দিয়েছে, তা হয়ত তাদের সদস্যভুক্ত সদস্যদের উৎপাদন। এর বাইরেও তো সারা দেশে আরও প্রতিষ্ঠান মুড়ি উৎপাদন করে। তারপরও বাপার সমীক্ষাকে আমরা গ্রহণ করতে পারি। ’
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘মুড়ি ছিল গ্রাম বাংলার সবচেয়ে অপ্রাতিষ্ঠানিক একটি পণ্য। সেটিকে আমরা প্রাতিষ্ঠানিক স্তরে এনে বাণিজ্যিকভাবে বাজারজাত শুরু করি। এখন তো স্থানীয় মার্কেটে আমাদের উৎপাদিত মুড়ির একটা বড় বাজার তৈরি হয়ে গেছে। এর পাশাপাশি আমরা প্রচুর পরিমাণ মুড়ি রপ্তানিও করি। শুধু আমরাই নয়, অনেকেই এসেছে। তাই সময় এসেছে মুড়ি সম্পর্কিত তথ্য-উপাত্তের একটি প্রাতিষ্ঠানিকতার। তাহলে অভ্যন্তরীণ খাতটিও যেমন প্রাতিষ্ঠানিকতায় রূপ নেবে, তেমনি মুড়ির রপ্তানি ভলিউ্যমও বড় হবে।’