আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে মেগা প্রকল্পে বরাদ্দ কমিয়ে ভর্তুকি খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এই সম্মাননীয় ফেলো একই সঙ্গে রাজস্ব ব্যয়ের ক্ষেত্রে সামাজিক সুরক্ষায় বরাদ্দ বাড়াতে বলেছেন।
রোববার ‘জাতীয় বাজেট ২০২২-২৩: পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য কী আছে’ শীর্ষক মিডিয়া ব্রিফিংয়ে তিনি এ পরামর্শ দিয়েছেন।
রাজধানীর মহাখালীতে ব্র্যাক সেন্টারে এই ব্রিফিংয়ের আয়োজন করে এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম।
অনুষ্ঠানে মূল প্রতিবেদন উপস্থাপন করতে গিয়ে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য প্রস্তাবিত বাজেটে মানুষের প্রত্যাশা কতটা প্রতিফলিত হয়েছে, তা তিনটি পর্যায়ে পর্যালোচনা করে দেখান।
তিনি বলেন, ‘প্রথমত স্বাস্থ্যগত অতিমারির প্রভাব আমরা পার করে এলেও এর আর্থসামাজিক যে প্রভাব নিম্ন-মধ্যবিত্তদের ওপর পড়েছে, তা এখনও কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। দ্বিতীয়ত, গত ১০-১৫ বছরে সামষ্টিক অর্থনীতি এ রকম চাপে পড়েনি। তৃতীয়ত, বিশ্বে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে।
‘এই তিনটি বিষয়ের সঙ্গে যোগ হয়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এসব কিছু মোকাবিলা করার জন্য অনেক চিন্তা, দক্ষতা ও প্রতিশ্রুতি দিয়ে বাজেট বাস্তবায়ন করতে হবে।’
প্রস্তাবিত বাজেট পর্যবেক্ষণ করে ড. দেবপ্রিয় বলেন, ‘সামষ্টিক অর্থনীতি স্থিতিশীল করার জন্য মূল্যস্ফীতিকে মূল সূচক হিসেবে ধরতে হবে। একই সঙ্গে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে দ্বৈত বিনিময় হার ও সুদের হারে সমতা আনতে হবে। পাশাপাশি বাজেটে কৃষি খাতকে প্রাধান্য দিতে হবে এবং টিসিবিকে খাদ্যদ্রব্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে বিশেষ ভূমিকায় রাখতে হবে।
‘সাধারণত নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী অর্থনৈতিক অভিঘাতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে সংগতি রেখে তাদের আয় বাড়ে না। আগামী অর্থবছরে কীভাবে তাদের সুরক্ষা দেয়া যায়, তা বিবেচনা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে মেগা প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ কমিয়ে ভর্তুকি খাতে বরাদ্দ আরও বাড়ানোর সুযোগ রাখতে হবে। পাশাপাশি রাজস্ব ব্যয়ের ক্ষেত্রে সামাজিক সুরক্ষায় বরাদ্দ বেশি হতে হবে, যেটি এই অর্থবছরে কমে গেছে।’
‘প্রস্তাবিত বাজেট ব্যবসাবান্ধব ও প্রশাসনবান্ধব। যেখানে দুর্নীতি ও অনৈতিকতাকে প্রশ্রয় ও বৈধতা দেয়ার সুযোগ রয়েছে। বেআইনি পথে উপার্জনকারীদের সুবিধা দেয়া হচ্ছে। এই বাজেট সংবিধানবিরোধী।’
নাগরিক প্ল্যাটফর্মের কোর গ্রুপ সদস্য এবং ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘আমাদের প্রত্যাশা ছিল যে এবারের বাজেটে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রাখা হবে এবং আমরা একটি জনবান্ধব বাজেট পাব।
‘কিন্তু দেখলাম এবারের বাজেট হয়েছে ব্যবসাবান্ধব ও প্রশাসনবান্ধব। যেখানে দুর্নীতি ও অনৈতিকতাকে প্রশ্রয় ও বৈধতা দেয়ার সুযোগ রয়েছে। যারা বেআইনি পথে উপার্জন করছে তাদের সুবিধা দেয়া হচ্ছে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতায় আমরা এখনও অনেক পিছিয়ে। অর্থাৎ এই বাজেট সংবিধানবিরোধী বাজেট।’
সেভ দ্য চিলড্রেন বাংলাদেশের প্রোগ্রাম ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কোয়ালিটি পরিচালক রিফাত বিন সাত্তার বলেন, ‘শিশুদের ওপর বিভিন্ন ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার প্রভাব পড়ে। যেমন পারিবারিক ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ায় পুষ্টিহীনতা ও বাল্যবিয়ে বৃদ্ধি পায়। এ কারণে এসব ঝরে পড়া শিশু ভবিষ্যতের মানবসম্পদ হিসেবে তৈরি হতে পারে না।
‘শিশুদের ওপর নির্যাতন বাড়ার বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে না। সে ক্ষেত্রে শিশুদের একটি আলাদা অধিদপ্তর করার প্রস্তাব বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। অর্থনৈতিক বৈষম্যের প্রভাব শিশুদের ওপর পড়ছে। বাজেটে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে যে প্রকল্প আছে তা বাস্তবায়ন করতে হবে।’
বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির সভাপ্রধান তাসলিমা আখতার বলেন, ‘শ্রমজীবী মানুষ এ দেশের বড় একটি অংশ, যাদের ক্রয়ক্ষমতার সঙ্গে পণ্যমূল্যের সামঞ্জস্য নেই। অতিমারিকালে বেশির ভাগ শ্রমিকের বেতন কমে যায়। কার্যাদেশ বাতিল হয় এবং অনেকে কর্মহীন হয়ে পড়ে।’
প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, এই সময়ে উদ্যোক্তাদের যদি সরকারি সুবিধা দেয়া হয়, তাহলে শ্রমিকদের ক্রয়ক্ষমতা কেন বাড়ে না। শ্রমজীবীদের জন্য বাজার নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা বাজেটে নেই। মালিকপক্ষ উন্নতির ভাগীদার হয়, আর ক্ষতির ভাগীদার হয় শ্রমিক। এর জন্য সরকারের পক্ষ থেকে জবাবদিহিতা বাড়াতে হবে।’
প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের পরিচালক (গার্লস রাইটস) কাশফিয়া ফিরোজ বলেন, ‘প্রস্তাবিত বাজেটে অনেক ক্ষেত্রে লিঙ্গভিত্তিক খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে- যেমন নারীদের কর্মসংস্থান, উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি। কিন্তু নারীর প্রতি সহিংসতা রোধের ক্ষেত্রে বাজেটে কোনো বরাদ্দ দেখা যায়নি। ‘অতিমারিকালে সহিংসতা অনেক বেড়েছে। সেখানে সামাজিক সুরক্ষার বাজেটে সহিংসতার বিরুদ্ধে কোনো বরাদ্দ নেই। এ সময়ে স্কুল থেকে ঝরে পড়া মেয়েশিশু ও বাল্যবিয়ের শিকারদের স্কুলে ফিরিয়ে আনার কোনো কার্যক্রম সম্পর্কে বাজেটে উল্লেখ নেই। এসব বিষয় যেসব আইনে লিখিত আছে, সেগুলো বাস্তবায়নে বাজেটে বরাদ্দ রাখতে হবে।’
অভিযানের নির্বাহী পরিচালক বনানী বিশ্বাস বলেন, ‘সরকার নিম্নআয়ের মানুষের জন্য গৃহ নির্মাণসহ আরও অনেক উন্নয়ন প্রকল্প নিয়েছে। কিন্তু এসব প্রকল্পের সুফল দলিতরা ভোগ করতে পারে না। দলিত এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর কথা সুনির্দিষ্টভাবে বাজেটে উল্লেখ করা হয় না। দলিতদের সুবিধার্থে সরকারের পক্ষ থেকে একটি আলাদা শাখা থাকা উচিত।
‘এখন থেকে ২০৩০ সাল পর্যন্ত প্রতিটি অর্থবছরের বাজেট এসডিজিকেন্দ্রিক হতে হবে এবং দলিতদের প্রতি বাজেটে সংবেদনশীল হওয়ার সদিচ্ছা সরকারের থাকতে হবে।’
নাগরিক প্ল্যাটফর্মের সমন্বয়ক আনিসাতুল ফাতেমা ইউসুফ বলেন, ‘২০৩০ সালের এসডিজি এজেন্ডা যত এগিয়ে আসছে, বাজেট আলোচনা তত গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে। নাগরিক প্ল্যাটফর্ম ইতোমধ্যে বাজেটসংক্রান্ত অনেক কার্যক্রম চালিয়েছে, যেখানে বাজেটের প্রতি জনমানুষের প্রত্যাশা তুলে ধরা হয়েছে। এই প্রত্যাশাগুলো কতখানি পূরণ হয়েছে, সেটি বিবেচনা করাই এই ব্রিফিংয়ের মূল উদ্দেশ্য।’