ডিজিটাল মুদ্রার প্রচলন শুরু করতে চায় সরকার। তবে তা বিটকয়েন, লাইটকয়েন, এথেরিয়াম, রিপলের মতো ক্রিপ্টোকারেন্সি নয়। এ ক্ষেত্রে দেশীয় মুদ্রা বা টাকা ডিজিটাল মুদ্রায় রূপান্তরিত করে ব্যবহার করা হবে।
প্রস্তাবিত ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে এমন ধারণা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। আগামীর চাহিদা বিবেচনা করে এমন উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা হবে। এ ক্ষেত্রে ‘ক্যাশলেস’ ব্যবস্থায় গুরুত্ব দেয়ার চিন্তা রয়েছে। অর্থাৎ বিনিময় মাধ্যম হিসেবে নগদ টাকার বিকল্প হবে এই ডিজিটাল মুদ্রা। তবে এই উদ্যোগ বাস্তবায়নে সময় প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন খোদ অর্থমন্ত্রী।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ডিজিটাল মুদ্রা মানে টাকার ফিজিক্যাল মুভমেন্টের প্রয়োজন হবে না। এখন যে মুদ্রা আছে, সেগুলোই ডিজিটালি ব্যবহার হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডিজিটাল কারেন্সি থাকবে। টাকার পরিবর্তে তখন ওটা ব্যবহার করে বিনিময় করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘বহির্বিশ্বে ক্রিপ্টোকারেন্সি বিটকয়েন রয়েছে। আমরা ওইদিকে যেতে চাই না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেমন টাকা ছাপাচ্ছে, তখন টাকা না ছাপিয়ে ডিজিটাল কারেন্সি ইস্যু করবে।”
ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সভাপতি জসিম উদ্দিন জানান, ‘লেনদেনের ক্ষেত্রে এটি একেবারেই নতুন ধারণা। সার্বিক দিক পর্যালোচনায় সময় দরকার।’
তিনি বলেন, ‘স্বল্প সময়ে এমন উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা যাবে না। কিন্তু নগদ টাকার লেনদেন কমিয়ে আনা দরকার। এতে নানান সুবিধা আছে।’
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক তৌফিক আহমদ চৌধুরী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এটা অত্যাধুনিক প্রযুক্তি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার যে মুদ্রা সররবাহ ব্যবস্থা আছে, সেখানে এটা অ্যাকোমোডেট করবে।’
ডিজিটাল মুদ্রা কী
ডিজিটাল মুদ্রার লেনদেন হবে ভার্চুয়ালি। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এটা নিয়ন্ত্রণ করবে।
বর্তমানে সারা বিশ্বে কাগজের মুদ্রা, ই-মানি (মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস), ক্রিপ্টোকারেন্সি (বিটকয়েনের মতো ভার্চুয়াল মুদ্রা) চালু রয়েছে। ক্রিপ্টোকারেন্সির বৈধতা বাংলাদেশে নেই। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেদের মুদ্রা ডিজিটাল ফরম্যাটে আনলে সেটি হবে বৈধ ডিজিটাল মুদ্রা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র বলেন, ‘আমরা এখন বিকাশ, নগদ, রকেটে ইলেকট্রনিক মানি ব্যবহার করি। তারা পুরো টাকার ব্যবহার করছে না। মোবাইলে ২০/৩০ হাজার টাকা থাকছে। এটা বিভিন্ন জায়গায় পাঠানো হচ্ছে। এখানে ফিজিক্যাল টাকা পাঠানো হচ্ছে না। এই যে পদ্ধতি এটাকে বলা ইলেকট্রনিক মানি। আর নতুন যে ধারণা আসছে, সেটা হবে “কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডিজিটাল মুদ্রা”। তখন টাকার পরিবর্তে ডিজিটাল মুদ্রা ব্যবহার করতে হবে, যেটা নগদ লেনদেন না করে অন্যভাবে লেনদেন করা হবে।’
বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ক্রিপ্টোকারেন্সি বা ভার্চুয়াল মুদ্রা চালু রয়েছে। ২০০৯ সালে প্রথম ভার্চুয়াল মুদ্রা হিসেবে এসেছিল বিটকয়েন। এরপর একে একে লাইটকয়েন, এথেরিয়াম, রিপলের মতো ভার্চুয়াল মুদ্রার লেনদেন হচ্ছে। এ মুদ্রা ধরা যায় না, ছোঁয়াও যায় না। তবে এ মুদ্রার কোনো নিয়ন্ত্রক নেই। সরকার কিংবা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নেই কোনো নিয়ন্ত্রণ। ডিজিটাল ক্যাশ সিস্টেমে এটি পরিচালনা করে কম্পিউটার নেটওয়ার্ক। যে কোনো জায়গা থেকে যে কোনো ব্যক্তি যে কোনো সময় এর লেনদেন করতে পারেন।
অর্থাৎ পুরো বিষয়টি হয় কোনো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। যদিও কোনো কোনো দেশ এখন খতিয়ে দেখছে যে ক্রিপ্টোকারেন্সিকে কীভাবে একটি মনিটরিংয়ের আওতায় আনা যায়।
বাংলাদেশে ডিজিটাল মুদ্রার অবস্থা
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মন্ত্রিসভায় পেমেন্ট অ্যান্ড সেটেলমেন্ট আইনের সংশোধনী প্রস্তাব অনুমোদিত হয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিতে দেয়া হয়েছে। এটা নিয়ে আরও পর্যালোচনা করতে বলা হয়েছে। বিশেষ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডিজিটাল কারেন্সি ইস্যুর অনুমতি দিলে ক্রিপ্টোকারেন্সি উৎসাহিত হবে কিনা তা পর্যালোচনা করতে বলা হয়েছে।
লেনদেন কীভাবে
টাকার মতোই ডিজিটাল মুদ্রা সব কাজে সব জায়গায় পণ্য বা সেবা ক্রয়-বিক্রয়ে ব্যবহার করা যাবে। কাগজের নোটের মতো এটার ব্যবহার হবে, তবে পদ্ধতি হবে ডিজিটাল।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পদ্ধতি ঠিক করাটাই হবে ডিজিটাল মুদ্রায় লেনদেনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
বিআইবিএমের সাবেক মহাপরিচালক তৌফিক আহমদ চৌধুরী বলেন, ‘ডিজিটাল মুদ্রা চালুর উদ্যোগ ভালো। কিন্তু এটার জন্য যে টেকনোলজিক্যাল ইনফ্রাস্টাকচার, লোকবল প্রয়োজন সেটার সক্ষমতা বিষয়ে সন্দেহ আছে।’
তিনি বলেন, ‘এখনও অনেক মানুষ চেক-ই ব্যবহার করতে শেখেনি, সেখানে এ ধরণের কারেন্সি কীভাবে চলবে? আমাদের দেশে এখনও নগদ টাকার লেনদেন সবাই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। খোদ ব্যাংকাররা ৯৫ শতাংশ নগদ লেনদেন করে। ডেবিট, ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহারও কম।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ই-মানিই হলো ডিজিটাল মুদ্রা। বৈশ্বিক চাহিদার প্রেক্ষাপটে অনেক দেশ এখন “কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডিজিটাল মুদ্রা” ইস্যু করছে। বাংলাদেশও আইনে সুযোগ রাখার প্রস্তাব করেছে। এটা চালু হলে জীবনযাত্রা আরও সহজ হবে।’
ডিজিটাল মুদ্রার ঝুঁকি ও চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) এক গবেষণায় বলা হয়েছে, গত দুই বছরে বাংলাদেশের ৬৮ শতাংশ ব্যাংক ম্যালওয়্যার আক্রমণের শিকার হয়েছে। বিশেষ করে বিপজ্জনকভাবে র্যানসমওয়্যার আক্রমণও হয়েছে। এ ধরনের আক্রমণে ব্যাংকগুলো ব্যাপক তথ্য নিরাপত্তার ঝুঁকিতে থাকে। দেশের ৭২ শতাংশ ব্যাংকে সাইবার নিরাপত্তা দেয়ার মতো অভিজ্ঞ লোকের অভাব আছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়।
বিআইবিএমের সাবেক মহাপরিচালক তৌফিক আহমদ চৌধুরী বলেন, ‘ডিজিটাল মুদ্রার সবচেয়ে বড় হলো ঝুঁকির বিষয়টি। কতটুকু নিরাপত্তা দিতে পারবে ব্যাংকগুলো, সেটা বড় ব্যাপার।’
তিনি বলেন, ‘সাইবার হামলা মোকাবিলায় এখনও ব্যাংকগুলোর পর্যাপ্ত সক্ষমতা নেই। আগে প্রযুক্তির সক্ষমতা অর্জন করতে হবে।’
ডিজিটাল মুদ্রা অবশ্যই চালু হবে, কিন্তু তার আগে অর্থনীতিকে সেই পর্যায়ে উন্নীত করতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
ঝুঁকিগুলো সঠিকভাবে নিরূপণ করতে হবে বলে মত দেন তিনি। বলেন, ‘ডিজিটাল মুদ্রায় লেনদেনের বিষয়টি প্রযুক্তিগতভাবে দেখভাল করাটাও চ্যালেঞ্জের বিষয়। এগুলো নিয়ে সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন থাকতে হবে।’
কোন কোন দেশে ডিজিটাল মুদ্রা চালু হয়েছে
৯টি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইতিমধ্যে ডিজিটাল মুদ্রা ইস্যুর বৈধতা পেয়েছে।
চীন, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, দক্ষিণ কোরিয়াসহ ১৪টি দেশ পরীক্ষামূলকভাবে এটি শুরু করেছে। এর মধ্যে চীন পাইলট প্রজেক্ট শেষ করে সব প্রস্তুত করেছে। তবে এখনও ডিজিটাল মুদ্রা ইস্যু করেনি।
পরীক্ষামূলকভাবে চালুর পর্যায়ে রয়েছে ১৬টি দেশ। এগুলো হলো: ভারত, তুরস্ক, ব্রাজিল, কানাডা, থাইল্যান্ড ইত্যাদি।
আর ৪০টি দেশ ঘোষণা করেছে বিষয়টি নিয়ে তারা গবেষণা পর্যায়ে রয়েছে।
ডিজিটাল কারেন্সি নিয়ে সম্প্রতি এক ওয়েবিনার উপস্থাপনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের পেমেন্ট সিস্টেম ডিপার্টমেন্টের অতিরিক্ত পরিচালক শাহ মোহাম্মদ জিয়াউল হক জানান, ক্যারিবিয়ান দ্বীপ বাহামা ও নাইজেরিয়া ডিজিটাল মুদ্রা চালু করেছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের মতো কিছু দেশ ক্রিপ্টোকারেন্সিকে মুদ্রা হিসেবে স্বীকৃতি না দিলেও অ্যাসেট হিসেবে মর্যাদা দিয়েছে।
সুইডেন এ বিষয়ে পাইলট প্রকল্প সম্পন্ন করেছে কিন্তু চালু করেনি।
কানাডা পাইলট করে এখনই চালু না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং তারা নতুন করে এ নিয়ে গবেষণা করবে বলে জানিয়েছে।
তবে ইকুয়েডর ও সেনেগাল ঘোষণা দিয়েছে তারা ডিজিটাল মুদ্রা চালু করবে না।