মুদ্রাবাজার স্বাভাবিক রাখতে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করেই চলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সোমবারও ১০ কোটি ৫০ লাখ ডলার বিক্রি করা হয়েছে। এর ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ কমে ৪১ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে।
এই রিজার্ভ দেড় বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম। ২০২০ সালের নভেম্বরে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচকের পরিমাণ ছিল ৪১ দশমিক ২৬ বিলিয়ন ডলার।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারের বিপরীতে টাকার মান আরও ৫০ পয়সা কমিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সে হিসাবে আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলারের দর দাঁড়িয়েছে ৯২ টাকা ৫০ পয়সা। এই দরেই সোমবার ১০ কোটি ৫০ লাখ ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
আর এ নিয়ে সব মিলিয়ে চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের সাড়ে ১১ মাসে (২০২১ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২২ সালের ১৩ জুন) রিজার্ভ থেকে ৬৮০ কোটি ৫০ লাখ (৬.৮০ বিলিয়ন) ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর বিপরীতে বাজার থেকে ৬২ হাজার কোটি টাকার মতো তুলে নেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এত ডলার বাজারে ছাড়া হয়নি। এরপরও বাজারের অস্থিরতা কাটছে না। আমদানি অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় এই সংকট দেখা দিয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ব্যাংকগুলোর চাহিদা মেটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে দরে ডলার বিক্রি করে এবং ব্যাংকগুলো নিজেদের মধ্যে যে দামে লেনদেন করে সেটাকেই আন্তব্যাংক লেনদেন দর বলে। এই দরেই সোমবার ১০ কোটি ৫০ লাখ ডলার বিক্রি করা হয়েছে।’
সিরাজুর ইসলাম বলেন, ‘বাজারের চাহিদা মেটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ডলার বিক্রি করায় রিজার্ভ কিছুটা কমে এসেছে। আমদানি কমলে এবং রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্সপ্রবাহ বাড়লে রিজার্ভ ফের বাড়বে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ হাবিবুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়ায় আমদানির গতি কমতে শুরু করেছে। মার্চ-এপ্রিলের চেয়ে মে মাসে আমদানি কম হয়েছে। চলতি জুন মাসেও নেতিবাচক ধারায় আছে। আশা করছি, খুব শিগগিরই ডলারের বাজার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে। তখন রিজার্ভও বাড়বে।’
বাজারে চাহিদার তুলনায় ডলারের সরবরাহ কম। সে কারণে প্রতিদিনই কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে আন্তব্যাংক দরে ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
তবে ব্যাংকগুলো নিজেদের মধ্যে আন্তব্যাংক দরে ডলার কেনাবেচা করলেও আমদানিকারকদের কাছ থেকে প্রতি ডলারের জন্য ৯৫ টাকার বেশি দাম নিচ্ছে। আর প্রবাসী আয় আনছে ৯৩ থেকে ৯৪ টাকা দরে।
সাধারণ মানুষের কাছে নগদ ডলার বিক্রি করছে আরও বেশি দামে। রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক সোমবার ৯৪ টাকা ৬০ পয়সা দরে নগদ ডলার বিক্রি করেছে। জনতা ও অগ্রণী ব্যাংক থেকে ১ ডলার কিনতে লেগেছে ৯৪ টাকা ৫০ পয়সা।
বেসরকারি ইস্টার্ন ও প্রাইম ব্যাংক সোমবার ৯৬ টাকায় ডলার বিক্রি করেছে। আর খোলাবাজার বা কার্ব মার্কেটে প্রতি ডলার ৯৭ টাকার বেশি দরে বিক্রি হয়েছে।
করোনা মহামারির কারণে গত ২০২০-২১ অর্থবছর জুড়ে আমদানি বেশ কমে গিয়েছিল। কিন্তু প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ে উল্লম্ফন দেখা যায়। সে কারণে বাজারে ডলারের সরবরাহ বেড়ে যায়। সে পরিস্থিতিতে ডলারের দর ধরে রাখতে গত অর্থবছরে বাজার থেকে রেকর্ড প্রায় ৮ বিলিয়ন (৮০০ কোটি) ডলার কিনেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
তারই ধারাবাহিকতায় চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়েও ২০ কোটি ৫০ লাখ ডলার কেনা হয়।
আগস্ট মাস থেকে দেখা যায় উল্টো চিত্র। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করায় লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে শুরু করে আমদানি। রপ্তানি বাড়লেও কমতে থাকে রেমিট্যান্স। বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভও কমতে থাকে। বাজারে ডলারের চাহিদা বেড়ে যায়; বাড়তে থাকে দাম। বাজার স্থিতিশীল রাখতে আগস্ট থেকে ডলার বিক্রি শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক, যা এখনও অব্যাহত রয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, গত বছরের ৫ আগস্ট আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলার ৮৪ টাকা ৮০ পয়সায় বিক্রি হয়। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে এই একই জায়গায় ‘স্থির’ ছিল ডলারের দর। এরপর থেকেই বাড়তে থাকে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রার দর।
হিসাব করে দেখা যাচ্ছে, এই ১০ মাসে বাংলাদেশি মুদ্রা টাকার বিপরীতে ডলারের দর বেড়েছে ৯ শতাংশের বেশি।
আমদানির আড়ালে ডলার পাচার নিয়ে সংশ্রয়
অর্থনীতির গবেষক বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) জ্যেষ্ঠ গবেষক মঞ্জুর হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, চাহিদা বাড়ায় রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করে ঠিক কাজটিই করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ হস্তক্ষেপকে সময়োপযোগী একটা পদক্ষেপ হিসেবে অভিহিত করেন এই অর্থনীতিবিদ।
তিনি বলেন, ‘আমদানি বাড়ায় বাজারে ডলারের চাহিদা বেড়েছে। স্বাভাবিক নিয়মেই বেড়েছে দর। কিন্তু এখন আমদানির লাগাম টেনে ধরতে হবে; যে করেই হোক আমদানি কমাতে হবে। ইতোমধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কয়েকটি ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অতি প্রয়োজনীয় পণ্য ছাড়া অন্য সব পণ্য আমদানিতে এলসি মার্জিন ৭৫ শতাংশ রাখার নির্দেশ দিয়েছে।
‘সরকারি কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকারদের বিদেশ সফর বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। আমদানিনির্ভর উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর কাজ আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে। বেশ কিছু বিলাস পণ্যের আমদানিতে অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। আমি মনে করি, এসব পদক্ষেপের ফলে আমদানির লাগাম কিছুটা কমবে।’
‘তবে আরেকটি বিষয় খুব তীক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে, পণ্য আমদানির আড়ালে বিদেশে টাকা পাচার হচ্ছে কি না, সেটাও খতিয়ে দেখতে হবে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘করোনার পর দেশে বিনিয়োগের অনুকুল পরিবেশ ফিরে আসায় শিল্পের কাঁচামাল, মূলধনি যন্ত্রপাতিসহ সব ধরনের পণ্যের আমদানি বেড়ে গিয়েছিল। এ ছাড়া বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল, খাদ্যপণ্যসহ সব পণের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণেও আমদানি খরচ বাড়ছিল।’
তিনি বলেন, ‘আমদানি কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। সরকারও কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। আশা করছি, এখন আমদানি ধীরে ধীরে কমে আসবে। মুদ্রাবাজারও স্বাভাবিক হয়ে আসবে।’
‘কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারের চাহিদা অনুযায়ী এখন ডলার বিক্রি করছে। গত অর্থবছরজুড়ে বাজার স্থিতিশীল রাখতে ডলার কেনা হয়েছিল। এখন সেই একই কারণে বিক্রি করা হচ্ছে। এই কাজটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক সব সময়ই করে থাকে। যখন যেটা প্রয়োজন, সেটাই করা হয়,’ বলেন সিরাজুল ইসলাম।
রিজার্ভ দিয়ে ৫ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যাবে
আমদানি বাড়ায় রিজার্ভেও টান পড়েছে। বেশ কিছুদিন ধরেই কমছে রিজার্ভ। সোমবার দিন শেষে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪১ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন ডলার।
এপ্রিল ও মার্চ মাসে ৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি আমদানি ব্যয়ের হিসাবে বর্তমানের এই রিজার্ভ দিয়ে পাঁচ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।
অথচ গত বছরের আগস্টে রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করেছিল, যা ছিল অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। ওই সময়ে প্রতি মাসে সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার আমদানি খরচ হিসেবে ১০ মাসের বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানোর রিজার্ভ ছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংকে।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রার মজুত থাকতে হয়।