প্রস্তাবিত বাজেটকে ‘বাস্তবতা বর্জিত’ অভিহিত করে বিএনপি একে ‘ডলার পাচারকারী ও অর্থ লুটেরাদের’ বাজেট বলে অ্যাখ্যা দিয়েছে।
সেই সঙ্গে বাজেটটি কেবলমাত্র সরকারের আশীর্বাদপুষ্টদের জন্য করা হয়েছে বলে দাবি করেছে দলটি।
শনিবার সন্ধ্যায় রাজধানীর গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে আনুষ্ঠানিক বাজেট প্রতিক্রিয়ায় এমন কথা বলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
গত বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপনের এক দিন পর এই প্রতিক্রিয়া দিয়েছে দলটি।
অর্থমন্ত্রী আগামী অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করেন।
আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানানোর সংবাদ সম্মেলনে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘এই বাজেট কোনো অর্থেই সাধারণ মানুষের বাজেট নয়, এটা স্রেফ ডলার পাচারকারী ও অর্থ লুটেরাদের বাজেট।
‘এবারের বাজেট বর্তমান কঠিন সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে সম্পূর্ণ বাস্তবতা বর্জিত একটি বাজেট, এটি কেবল সরকারের আশীর্বাদপুষ্টদের জন্যই করা হয়েছে।’
এ সময় ‘ডলার পাচারকারী ও অর্থ লুটেরাদের’ ব্যাখ্যাও দেন মির্জা ফখরুল। তিনি বলেন, ‘পাচারকারীরদের অর্থকে নিরাপদে দেশে ফিরিয়ে আনা কিংবা বিদেশে ভোগ করার বৈধতাতেই এবারের বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছে। আরও পরিষ্কার অর্থে বললে, সরকারের লুটেরা মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও সুবিধাভোগী ব্যবসায়ী স্বজনদের অর্থ পাচার করার সুযোগ করে দিতেই এটা করা হয়েছে।
‘অথচ সাধারণ মানুষের নিত্য ব্যবহৃত চাল, ডাল, লবন, চিনি, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির মূল্য হ্রাসের কোনো কার্যকরী কৌশল না নিয়ে শুধুমাত্র নিজেদের বিত্ত বৈভব বৃদ্ধির লক্ষ্যে এই বাজেট প্রণীত হয়েছে।’
পাচারকৃত অর্থ ফেরাতে কর ছাড় বাতিল চায় বিএনপি
পাচার করা অর্থ দেশে ফেরাতে কর ছাড়ের যে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে বাজেটে সেটাকে আইনের পরিপন্থি বলে অভিহিত করে বিএনপি। মির্জা ফখরুল বলেন, ‘এই প্রস্তাব কেবল অনৈতিক নয়, এটা রীতিমতো আইনের সাথে সাংঘর্ষিক এবং দুর্নীতি ও অর্থ পাচারকে ক্ষমা ঘোষণার শামিল।
‘এতে বর্তমানে চলমান অর্থ পাচারের মামলাগুলোর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। অর্থ পাচারকারীরা আরও উৎসাহিত হবে, টাকা আরও পাচার হওয়ার প্রবণতা তৈরি হবে। এটা অন্যায়, অপরিনামদর্শী ও আত্মঘাতী পদক্ষেপ।’
তিনি বলেন, ‘যেখানে পাচারকারীদের শাস্তির আওতায় আনা এবং তাদের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে পাচারকৃত অর্থ দেশে ফেরত আনাই আইনগতভাবে প্রত্যাশিত, সেখানে পাচারকারীদের উৎসাহিত করা হচ্ছে। আমরা মনে করি, এটা দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের তথাকথিত জিরো টলারেন্স নীতির সাথে সাংঘর্ষিক এবং অসাংবিধানিক।’
মির্জা ফখরুল অভিযোগ করেন, গত ১৪ বছরে সরকারের ঘনিষ্ট লোকজনই বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার করে নিয়েছে। এখন এই ঘোষণার মাধ্যমে সরকার ওইসব পাচারকারীদের অবৈধ অর্থ বৈধ করার ঢালাও সুযোগ দিলো, যা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নৈতিক যেকোনো মানদণ্ডে অগ্রহণযোগ্য।
বিএনপি পাচারকৃত অর্থ বৈধ করার যে ঘোষণা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী তার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। সেই সঙ্গে সিদ্ধান্তটি বাতিলেরও দাবি জানায়।
একই সঙ্গে ‘অবিলম্বে পাচারকারীদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ ও তাদের অর্জিত সম্পদ বাজেয়াপ্ত এবং পাচারকারীদের অর্থ ফেরত আনার ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান বিএনপি মহাসচিব।
ব্যবসায়ীদের বাজেট, সাধারণের নয়
প্রস্তাবিত বাজেটের নানা দিকের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘এই বাজেট হচ্ছে অব দ্য বিজনেস ম্যান, বাই দ্যা বিজসেন ম্যান এবং ফর দ্যা বিজনেস ম্যান। অর্থাৎ এটি ব্যবসায়ীবান্ধব বাজেট। জনকল্যাণের কোনো কথা এতে স্থান পায়নি।
‘মূল্যস্ফীতিতে জনমানুষের যখন নাভিশ্বাস, তাদেরকে স্বস্তি দেয়ার কোনো কিছু নেই। করমুক্ত আয়সীমা বাড়েনি, স্বস্তি পায়নি মধ্যবিত্তরা। বাজেটে যেসব পণ্যের আমদানি কর বাড়ানো হয়েছে সেগুলোর ভোক্তা মূলত মধ্যবিত্তরাই।’
বিএনপি নেতা বলেন, ‘মেডিটেশনের উপরও ৫ শতাংশ কর আরোপ করা হয়েছে। অতিদরিদ্রদের কাছে ১০ টাকা দরে যে সামান্য কিছু চাল বিক্রি হতো, তার দাম ১৫ টাকা বাড়ানো হয়েছে। সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে সয়াবিন তেল এখন সরকারই নির্ধারণ করে দিল ২০৫ টাকা। ৩৫ দিনের মাথায় এ নিয়ে দুই দফা সয়াবিন তেলের দাম বাড়ল।’
সামাজিক নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষিখাতে ব্যয় বরাদ্দ যথেষ্ট নয় বলে মন্তব্য করেন বিএনপি মহাসচিব।
ব্যাংক খাত নিয়ে নিশ্চুপ অর্থমন্ত্রী
ডিজিটাল মুদ্রা চালুর বিষয়ে অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তব্যের প্রসঙ্গ টেনে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘এটি একান্তই রেগুলেটরি ব্যাংক, তথা বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতির বিষয়। অর্থমন্ত্রী কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রেগুলেটরি এখতিয়ারে হাত দিতে পারেন না।
‘অথচ দুষ্ট চক্রের কবলে বন্দি ব্যাংক খাত নিয়ে অর্থমন্ত্রী কোনো কথা বাজেট বক্তৃতায় বলেননি। মুদ্রাস্ফীতির কথা স্বীকার করলেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাজেটে কোনো সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব নেই।’
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘বলা হচ্ছে, দুই বছরে করোনার প্রেক্ষিতে লক্ষ হাজার টাকার ওপরে প্রণোদনা দেয়া হয়েছিল। আমাদের প্রশ্ন সে টাকা গেল কই? তার মধ্যে একটা টাকাও কী পরিশোধ হয়েছে, জনগণ জানতে চায়। শুনি রপ্তানি নাকি হু হু করে বাড়ছে। তাহলে প্রণোদনার টাকা পরিশোধ হচ্ছে না কেন?
‘কারা কারা প্রণোদনা পেয়েছে এবং এই পর্যন্ত কী পরিমাণ টাকা পরিশোধ করেছে তার উপরে সরকারের শ্বেতপত্র চায় জনগণ।’
স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ গতানুগতিক
বিএনপির সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী, দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেনও বক্তব্য দেন সংবাদ সম্মেলনে। তিনি বলেন, ‘প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ গতানুগতিক। করোনাকালে এই খাতে যেসব দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে, সেগুলো পূরণের জন্য কোনো ধরনের পদক্ষেপ বাজেটে দিক নির্দেশনা নেই।
‘করোনাকালে সরকারের মন্ত্রীরা যেসব প্রতিশ্রুতির কথা শুনিয়েছিলেন, বাজেটে তার প্রতিফলন হয়নি। আমরা মনে করি, বাজেটে স্বাস্থ্য সেক্টরকে চরমভাবে অবহেলা করা হয়েছে। স্বাস্থ্য সেক্টরে বরাদ্দ কমেছে। গত বছর বরাদ্দ ছিল ৩২ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা। আর এই বছরে বাজেটে দেখানো হয়েছে ৩৬ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা। সামনের অর্থ বছরে বাড়ানো হয়েছে ৪ হাজার ১৩২ কোটি টাকা। যেটা আসলে সঠিক নয়।
‘কারণ ৩৬ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকার মধ্যে করোনা মোকাবিলার জন্য রাখা হয়েছিল ৫ হাজার কোটি টাকা। তাহলে ৫ হাজার কোটি বাদ দিলে দেখা যাবে যে, প্রকৃতপক্ষে ৩১ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা বরাদ্দ ঘোষণা করা হয়েছে। এটা জনগণের সাথে প্রতারণা।’
আওয়ামী মডেলের অর্থনীতি
সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘এই মুহূর্তে বাংলাদেশে মুক্তবাজার অর্থনীতি কাজ করছে না। এখন কাজ করছে আওয়ামী ইকোনমিক মডেল, তাদের উপকার করার জন্য, তাদের দুর্নীতির জন্য, তাদের পকেটে টাকা নেয়ার জন্য, তারা রাষ্ট্রের প্যাট্রোনাইজেশনের ব্যবসা করার জন্য। এভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতিটা চলছে।
‘আমার মনে হয়, বাংলাদেশে প্রকৃত অর্থে এক রোল ইকোনমি প্রসেস মডেল চলছে। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কাছ থেকে টাকাগুলো নিচ্ছে, সব কিছুর দাম বাড়িয়ে। এই টাকাগুলো থেকে তারা (ক্ষমতাসীনরা) কীভাবে সুবিধা নেবে তা মাথায় রেখে একটা অর্থনৈতিক মডেল তারা তৈরি করেছে, সেই মডেলের ভিত্তিতে আজকের বাজেটটা তৈরি করা হয়েছে।’
সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, নজরুল ইসলাম খান, সেলিমা রহমান ও ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মশিউর রহমান ও নাসের রহমান উপস্থিত ছিলেন।