প্রস্তাবিত ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে যেসব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে সেগুলো গ্রহণযোগ্য হলেও বাস্তবায়নের শঙ্কা রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি এম মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। তিনি বলেছেন, বাজেটে সমস্যাগুলো উল্লেখ করা হলেও সমাধান কিভাবে হবে সেটা বলা হয়নি।
শনিবার ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস অ্যান্ড এডুকেশন ফোরাম আয়োজিত পোস্ট বাজেট ডায়ালগে তিনি এসব কথা বলেন।
এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘বাজেটে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির যে লক্ষ্য দেয়া হয়েছে সেটা বাস্তবসম্মত নয়। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাও বলেছে যে প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের বেশি হবে না।’
বাজেট ৫ দশমিক ৫ ঘাটতি শতাংশ গ্রহণযোগ্য বলে মন্তব্য করেন মির্জ্জা আজিজ। তিনি বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতা বাড়ানো জরুরি। এর ফলে ঘাটতি বেড়ে ৬ শতাংশ হলেও সমস্যা নেই।’
সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘যারা এর আওতায় আসার কথা নয় তারাও বিভিন্ন রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যক্তির যোগসাজশে এর আওতাভুক্ত হয়। ফলে যাদের এটা পাওয়া উচিত তারা বঞ্চিত হয়। মূল্যস্ফীতির কারণে দরিদ্রের সংখ্যা আরও বেড়েছে। এই তহবিল যেন তছরুপ না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘বাজেট ঘাটতি মেটাতে বড় অংকের টাকা ব্যাংক থেকে নেয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে। সরকার এই খাত থেকে বেশি ঋণ নিলে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমে যাবে। সবশেষ মুদ্রানীতিতে বেসরকারি ঋণ যা নির্ধারণ করা হয়েছে সেটা অর্জিত হয়নি। সেক্ষেত্রে বিনিয়োগ কম হলে প্রবৃদ্ধি কমে যাবে। কারণ প্রবৃদ্ধি বাড়াতে বিনিয়োগ বাড়ানোর বিকল্প নেই।’
রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রাও বাস্তবসম্মত নয় বলে মন্তব্য করেন তিনি। বলেন, ‘চলতি বছর এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ছিল ৩ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে চলতি মার্চ পর্যন্ত আদায় হয়েছে ২ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। অর্থবছরের বাকি দুই মাসে বাকিটা আদায় করা সম্ভব নয়।’
রাজস্ব আদায়ে দুরবস্থা কাটাতে এনবিআরের কর কাঠামো সংস্কারের পরামর্শ দেন তিনি। বলেন, ‘এনবিআরের করের আওতা প্রসারিত করা দরকার। যারা কর দেয় তাদের করের বোঝা না বাড়িয়ে আওতা বাড়াতে হবে। এতে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জন হবে।’
বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বা এডিপির বরাদ্দ অর্থ ব্যয়ের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এডিপি বরাদ্দ ২ লাখ ৯ হাজার কোটি টাকার মধ্যে অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে ৬০ হাজার ৯৯০ কোটি ব্যয় হয়েছে। শেষদিকে ব্যয় বাড়ে। ফলে কাজের গুণগত মান ভালো হয় না।’
মির্জ্জা আজিজ বলেন, ‘পাচারের টাকা দেশে আনার যে সুযোগ দেয়া হয়েছে তাতে টাকা পাচার আরও বেড়ে যাবে। আগে কেউ বাইরে টাকা পাচার করার আগে চিন্তা-ভাবনা করত। কিন্তু এখন মনে করবে, টাকা তো ইচ্ছে করলেই ফেরত আনা যাবে। এই উদ্যোগের মাধ্যমে দুর্নীতিবাজদের উৎসাহ দেয়া হলো। আর সৎকরদাতাদের বঞ্চিত করা হলো।
‘অনেকেই বলে আমার সময়ে প্রথম এই সুযোগ দেয়া হয়েছিল৷ কিন্তু এটা ভুল। আমি সৎভাবে উপার্জিত অপ্রদর্শিত আয় দেশে আনার সুযোগ দিয়েছিলাম। তবে সেটাতে কিছু শর্ত দেয়া হয়েছিল। যে টাকা কর দিয়ে দেশে আনা যাবে তার ওপর আরও ১০ শতাংশ অতিরিক্ত কর দিতে হবে।’
রিজার্ভ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সম্প্রতি রপ্তানি বেড়েছে। কিন্তু আমদানির পরিমাণ তার থেকেও বেশি। ফলে রিজার্ভের মাত্রা কমে ৪২ বিলিয়ন হয়েছে। এক বছর আগে যা ছিল ৪৫ বিলিয়ন ডলার। এতে মুদ্রার ওপর চাপ পড়ছে, অবমূল্যায়ন হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজার ব্যবস্থার ওপর ডলারের দর ছেড়ে দিয়েছে। ফলে মুদ্রার আরও অবমূল্যায়ন হবে।’
মুদ্রার অবনমনের ফলে বাজেটের ৫ দশমিক ৬ শতাংশ মূল্যস্ফীতি কিভাবে হবে সেটা বোধগম্য নয় বলে মন্তব্য করেন তিনি।
আইপিডিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মমিনুল ইসলাম বলেন, ‘দেশের প্রথম বাজেট ছিল ৭৮৬ কোটি টাকা। নতুন বাজেট ৬ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা। সে হিসাবে বাজেটের আকার বেড়েছে ৫৬৩ গুণ। খুব চ্যালেঞ্জিং সময়ে এই বাজেট দেয়া হলো।
‘করোনা-পরবর্তী সময়ে ব্যবসা ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করলেও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধর প্রভাব সারা বিশ্বে পড়েছে। বিশ্ব জুড়ে মূল্যস্ফীতি। এর প্রভাব আমাদের দেশেও পড়েছে। তবে শ্রীলঙ্কা বা অন্য অনেক দেশের মতো খারাপ অবস্থা আমাদের হবে না। তবে বিশ্বের শীর্ষ নেতারা বসে বিশ্ব পরিস্থিতির সমাধান না করলে খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে।’
আইপিডিসির শীর্ষ এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘করপোরেট কর কমলেও ব্যক্তি আয়কর সীমা বাড়ানো হয়নি। নিম্ন-মধ্যবিত্তদের করের বোঝা কমাতে আয়কর সীমা বাড়ানো দরকার ছিল।
‘এই বাজেটকে ব্যবসাবান্ধব বলা হচ্ছে। কিন্তু সরকারের লক্ষ্য প্রান্তিক জনগণের জন্য কাজ করা। কোভিডের কারণে অনেকে কাজ হারিয়েছে। এজন্য কর্মসংস্থান আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ।’