দুই বছরের বেশি সময়ের মহামারির মহাসংকটের পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় টালমাটাল অবস্থায় ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার যে বাজেট অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল দিয়েছেন, তার ৬২ শতাংশই খরচ হবে সরকার পরিচালন বাবদ।
৪ লাখ ১৮ হাজার ৪৪৭ কোটি টাকার এই পরিচালন ব্যয় বিদায়ী ২০২১-২২ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ১২ দশমিক ৬৩ শতাংশ বেশি।
আর এই টাকার প্রায় অর্ধেক, ১ লাখ ৮৫ হাজার ৬৭৮ কোটি টাকা খরচ হবে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, পেনশন এবং সুদ মেটাতে।
এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থ ৮০ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা চলে যাবে সুদ পরিশোধে, যা মোট রাজস্ব বাজেটের ১৯ দশমিক ২০ শতাংশ। এরমধ্যে ৭৩ হাজার ১৭৫ কোটি টাকা চলে যাবে অব্যন্তরীণ ঋণের সুদ পরিশোধে। বাকি ৭ হাজার ২০০ কোটি টাকা ব্যয় হবে বিদেশি ঋণের সুদ শোধে।
বিপুল বিদেশি ঋণের বোঝা নিয়ে এখন প্রায় সর্বস্বান্ত শ্রীলঙ্কা। শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণের মাঝেই বাংলাদেশে নতুন অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল। এই বাজেট বাস্তবায়নে বিশাল অঙ্কের বিদেশি ঋণ নেয়ার পরিকল্পনাও সাজিয়েছেন তিনি।
জাতীয় সংসদে বৃহস্পতিবার অর্থমন্ত্রী ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য যে প্রস্তাব উপস্থাপন করেছেন তার অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এবারই প্রথম রাজস্ব বা পরিচালন বাজেটের সবচেয়ে বেশি অর্থ সুদ পরিশোধের জন্য রাখা হয়েছে। ৩০ জুন শেষ হতে যাওয়া বিদায়ী ২০২১-২২ অর্থবছরের মূল বাজেটে সুদ পরিশোধ বাবদ ৬৮ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছিল। সংশোধিত বাজেটে তা বেড়ে ৭১ হাজার ২৪৪ কোটি টাকা দাঁড়িয়েছে
এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থমন্ত্রী সুদ পরিশোধ বাবদ বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ১৩ শতাংশ এবং মূল বাজেটের চেয়ে ১৭ দশমিক ১৮ শতাংশ বেশি বরাদ্দ রেখেছেন।
২০২০-২১ অর্থবছরে ৭০ হাজার ৬০৬ কোটি টাকার সুদ পরিশোধ করেছিল সরকার।
এতোদিন রাজস্ব বাজেটের সবচেয়ে বেশি অর্থ চলে যেতো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিদের বেতন-ভাতায়। কিন্তু এবারই প্রথম সুদ পরিশোধের জন্য বেশি অর্থ বরাদ্দ রেখেছেন অর্থমন্ত্রী।
বাজেট বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রস্তাবিত বাজেটে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিদের বেতন-ভাতা পরিশোধের জন্য ৭৪ হাজার ২৬৬ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। যা রাজস্ব বাজেটের ১৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ।
বিদায়ী অর্থবছরের মূল বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৬৯ হাজার ৭৪৬ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে তা আরও বেড়ে ৭১ হাজার ৭৩৭ কোটি টাকায় ঠেকেছে।
তার আগে ২০২০-২১ অর্থবছরে বেতন-ভাতার জন্য ৫৮ হাজার ৮৯১ কোটি টাকা খরচ করেছিল সরকার।
নতুন বাজেটে অবসরে যাওয়া সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেনশন বাবদ ব্যয় হবে ৩১ হাজার ৩৭ কোটি টাকা, যা বাজেটের ৭ দশমিক ৪ শতাংশ।
বিদায়ী ২০২১-২২ অর্থবছরের মূল্ বাজেটে এ খাতের জন্য ২৮ হাজার ২০৯ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছিল; সংশোধিত বাজেটে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৮ হাজার ৫৩৬ কোটি টাকা।
২০২০-২১ অর্থবছরে পেনশন বাবদ ১৮ হাজার ৭১১ কোটি টাকা খরচ হয়েছিল সরকারের।
শেখ হাসিনার টানা তৃতীয় মেয়াদের সরকারের চতুর্থ বাজেট বৃহস্পতিবার সংসদে পেশ করেন অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল। ৩০ জুন এই বাজেট পাস হবে। ১ জুলাই থেকে শুরু হবে নতুন অর্থবছর।
এমন একসময়ে এবার বাজেট দিতে হলো, যখন বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস মহামারির ধাক্কা যেতে না যেতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ডামাডোলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিও বড় ধরনের সংকটের মুখে পড়েছে। ফলে অর্থমন্ত্রীকে বাজেট সাজাতে গিয়ে বেশ হিমশিম খেতে হয়েছে।
সে কথা বাজেট বক্তৃতায় বার বার উল্লেখ করেছেন তিনি। বলেছেন, ‘সামনের দিনগুলোতে দারুন কৌশলী হতে হবে সরকারকে। যেকোন একটি সমস্যা ঠিকভাবে মোকাবেলা করতে না পারলে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা নষ্ট হওয়ার শঙ্কা আছে।’
কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাবদ সরকারের ব্যয় স্বাভাবিকভাবেই প্রতিবছর বাড়ে। অন্য অনেক খাতে বরাদ্দ কমানো গেলেও ঋণের সুদ পরিশোধ এবং বেতন-ভাতায় কাঁচি চালানোর সুযোগ থাকে না।
অর্থনীতিতে বাজেটকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। এর মধ্যে পরিচালন ব্যয় বা পরিচালন বাজেটকে বলে রাজস্ব বাজেট। আর উন্নয়ন বাজেট পরিচিত সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি-এডিপি হিসেবে।
২০২২-২৩ অর্থবছরের এই বাজেটে অর্থমন্ত্রী পৌনে ৭ লাখ টাকার বেশি ব্যয়ের পরিকল্পনা করেছেন। এর মধ্যে পরিচালন ব্যয় বা রাজস্ব বাজেট ৪ লাখ ১৮ হাজার ৪৪৭ কোটি টাকা।
নতুন বাজেটে সুদ পরিশোধে বেশি অর্থ ব্যয় ধরার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মুনাফার হার বেশি হওয়ায় গত কয়েক ধরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি অনেক বেড়েছে। সেই সুদ পরিশোধ করতে হচ্ছে সরকারকে। তাতে এ খাতে ব্যয় বেশি হচ্ছে। অন্যদিকে বিদেশি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে। তার সুদও শোধ করতে হবে।’
‘সরকারি কর্মকর্তাদের প্রতিবছর ইক্রিমেন্ট হয়; তার পেছনেও ব্যয় বাড়ে। অনেকের পদোন্নতি হওয়ায় বেতন বাড়ে। সে কারণে এ খাতেও সরকারের খরচ বাড়বে, এটাই স্বাভাবিক।’
‘এখানে একটা বিষয় লক্ষ্য করার মতো, এই যে দুই বছরের মহামারি গেলো, আবার যুদ্ধের ভয়াবহতার মাশুল দিতে হচ্ছে দেশের মানুষকে। করোনা মধ্যে অনেকেরই চাকরি চলে গেছে। অনেকের বেতন কমেছে। বিভিন্ন গবেষণায় বলা হচ্ছে, এই দুই সংকটে ৩ লাখের বেশি মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে। মোট কথা, দেশের বেশির ভাগ মানুষ খুবই কষ্টে আছে। শুধু বহাল তবিয়তে আছে সরকারি কর্মকর্তারা। তাদের আয় কমেনি; উল্টো ইক্রিমেন্টসহ নানান সুবিধার কারণে বেড়েছে।
‘সে কারণেই সরকারকে তাদের জন্য এই কঠিন সময়েও বেশি খরচ হচ্ছে’- বলেন ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান এইচ মনসুর।
মুস্তফা কামাল তার এবারের বাজেটে কর্মকর্তা-কর্মচারিদের বেতন ও ভাতা বাবদ যে বরাদ্দ রেখেছেন, তার মধ্যে ১১ হাজার ৯৫৮ কোটি টাকা কর্মকর্তাদের বেতনে খরচ করবেন। ২৭ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা খরচ করবেন কর্মচারীদের বেতনের জন্য। আর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভাতার জন্য রেখেছেন ৩৪ হাজার ৯৬৮ কোটি টাকা।
অন্যান্য ব্যয়
পণ্য সরবরাহ ও সেবা খাতের খরচের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২৮ হাজার ২৬৬ কোটি টাকা। মেরামত ও সংরক্ষণ বাবদ নতুন বাজেটে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১০ হাজার ৭৫১ কোটি টাকা।
২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি বাবদ ৫৬ হাজার ৫৩৫ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। প্রণোদনায় বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১৫ হাজার ২২৫ কোটি টাকা।
নতুন বাজেটে সরকারের ব্যয় নির্বাহের জন্য যে বাজেট প্রস্তাব অর্থমন্ত্রী জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করেছেন, সেখানে সামগ্রিক ঘাটতি দেখানো হয়েছে প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকা। ঘাটতির এই পরিমাণ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৫ দশমিক ৫ শতাংশ।
বড় ঘাটতি মেটাতেই সরকারকে দেশি ও বিদেশি উৎস থেকে ধার করতে হবে।
অর্থমন্ত্রী পরিকল্পনা করেছেন, এবার বৈদেশিক উৎস থেকে মোট ১ লাখ ১২ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা ঋণ নেবেন। সেখান থেকে ১৭ হাজার কোটি টাকা আগের ঋণের কিস্তি পরিশোধে খরচ করবেন। ফলে সরকারের নিট বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে ৯৫ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা।
ঘাটতির বাকি ১ লাখ ৪৬ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা নেয়া হবে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে। এর মধ্যে ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া হবে ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা, ব্যাংকবহির্ভূত উৎস থেকে নেয়া হবে ৪০ হাজার ১ কোটি টাকা, সঞ্চয়পত্র থেকে নেয়া হবে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। বাকি ৫ হাজার ১ কোটি টাকা অন্যান্য উৎস থেকে নেয়ার পরিকল্পনার ছক কষেছেন মুস্তফা কামাল।