নতুন বাজেটে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সূচক মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৬ শতাংশে আটকে রাখার যে লক্ষ্য ধরেছেন তা কোনোভাবেই সম্ভব নয় বলে মনে করে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ-সিপিডি।
বরাবরের মতো বাজেট ঘোষণার পরের দিন শুক্রবার রাজধানীর লেক শোর হোটেলে জাতীয় বাজেট ২০২২-২৩ পর্যালোচনা করেন সিপিডির গবেষকরা।
সেখানে সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘বর্তমান চড়া মূল্যের বাজরে অর্থমন্ত্রী মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৬ শতাংশে রাখার যে প্রাক্কলন করেছেন তা বাস্তবতার সঙ্গে কোনো মিল নেই। সরকারি হিসাবেই এপ্রিল মাসে মূল্যস্ফীতির হার ৬ দশমিক ২৯ শতাংশ। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল খাদ্যপণ্যসহ সব ধরনের জিনিসের দাম বাড়ছে। কোভিড পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করার পর থেকেই বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য বাড়ছে।
‘ফেব্রুয়ারি শেষে রাশিয়া-ইউক্রেনে হামলার পর তা আরও বেড়ে গেছে। অন্যদিকে চায়নায় সাম্প্রতিক লকডাউনের কারণে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। চীন বিশ্ববাজারে পণ্য জোগান দেয়ার একটি অন্যতম বড় দেশ। এ পরিস্থিতিতে পণ্য কোত্থেকে আসবে, সেটাও একটি বড় প্রশ্ন।’
তিনি বলেন, ‘এই সংকটকালে কীভাবে মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৬ শতাংশে আটকে রাখবেন অর্থমন্ত্রী আমাদের কাছে তা বোধগম্য নয়। তাহলে প্রশ্ন জাগে, অর্থমন্ত্রীর হাতে কি জাদুর কাঠি আছে, যার মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনবেন।’
ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘দুই বছরের বেশি সময়ের করোনা মহামারির পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় বর্তমানে জনজীবনের ওপর চাপ বেড়েছে। বাজেটে প্রত্যাশা ছিল নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষকে স্বস্তি দেয়া হবে, কিন্তু দেয়া হয়নি। উল্টো বিত্তবানদের কর কমানো হয়েছে।’
‘যেসব মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে, তারা কীভাবে আগের জায়গায় ফিরতে পারবে, তারও সুনির্দিষ্ট কোনো দিকনির্দেশনা নেই বাজেটে।’
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘বাজেট বক্তৃতায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণসহ ছয়টি চ্যালেঞ্জের কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী নিজেই। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে, অর্থমন্ত্রী রোগ চিহ্নিত করেছেন ঠিকই; কিন্তু সেই রোগ সারাতে ওষুধ ঠিকমতো হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘নতুন বাজেট যে লক্ষ্য নিয়ে প্রণয়ন করা হয়েছে তা পূরণে নেয়া পদক্ষেপগুলো পরিপূর্ণ নয়। নীতিকৌশলের ক্ষেত্রে পদক্ষেপ অসম্পূর্ণ এবং বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তা অপর্যাপ্ত।’
ফাহমিদা বলেন, ‘আমরা দেখেছি, বাজেটে মূল্যস্ফীতি কথাটি অনেকবার এলেও এটি নিয়ে অর্থমন্ত্রীর পদক্ষেপ পর্যাপ্ত নয়। কর কাঠামোতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে কর প্রত্যাহারের প্রস্তাবনা যথেষ্ট নয়। অনেক পণ্যেই কর রয়ে গেছে। বাজেটে গম ছাড়া নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক পণ্যে করছাড় নেই। বাড়ন্ত মূল্যস্ফীতির এই সময়ে করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো হয়নি, ভর্তুকি ও সামাজিক সুরক্ষার আওতাও ওই অর্থে বাড়েনি।’
‘তাহলে অর্থমন্ত্রী মূল্যস্ফীতির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করবেন কীভাবে?’ প্রশ্ন করেন ফাহমিদা।
বিদায়ী ২০২১-২২ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৩ শতাংশে বেঁধে রাখার ঘোষণা দিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী, তবে তাতে সফল হননি তিনি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সবশেষ তথ্য বলছে, এপ্রিলে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসওয়ারি বা মাসভিত্তিক) ৬ দশমিক ২৯ উঠেছে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচক, যা দেড় বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
এর অর্থ হলো, ২০২১ সালের এপ্রিলে যে পণ্য বা সেবার জন্য ১০০ টাকা খরচ করতে হতো, ২০২২ সালের এপ্রিলে সেই পণ্য বা সেবার জন্য ১০৬ টাকা ২৯ পয়সা খরচ করতে হয়েছে। এই মাসে খাদ্যের মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৬ দশমিক ২৪ শতাংশ। আর খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৬ দশমিক ৩৯ শতাংশ।
আগের মাস মার্চে এই হার ছিল ৬ দশমিক ২২ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে ছিল ৬ দশমিক ১৭ শতাংশ।
চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে টানা ছয় মাস বাড়ার পর জানুয়ারিতে কমেছিল এই সূচক। ফেব্রুয়ারি থেকে তা আবার চড়ছে।
১২ মাসের গড় হিসাবে এপ্রিল শেষে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৮১ শতাংশ, যা সরকারের লক্ষ্যের চেয়ে বেশ খানিকটা ওপরে।
তবে সরকার বা বিবিএসের দেয়া হিসাবের চেয়ে মূল্যস্ফীতির হার বাস্তবে অনেক বেশি বলে অনেক দিন ধরেই প্রশ্ন তুলে আসছেন অর্থনীতিবিদরা।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) বলছে, দেশে মূল্যস্ফীতির প্রকৃত হার বিবিএসের চেয়ে দ্বিগুণের চেয়ে বেশি।
গত ৩ মার্চ ‘মূল্যস্ফীতি: সরকারি পরিসংখ্যান বনাম প্রান্তিক মানুষের বাস্তবতা’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে সানেম। এতে বলা হয়েছে, শহর এলাকায় সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার এখন ১২ দশমিক ৪৭ শতাংশ। আর গ্রামে এই হার ১২ দশমিক ১০ শতাংশ।
প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেছিলেন, ‘পণ্যমূল্য নিয়ে সরকারি সংস্থা বিবিএস যে তথ্য দিচ্ছে, তা বাস্তবের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। এ ক্ষেত্রে যদি সঠিক তথ্য তুলে আনা না হয়, তবে পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া টেকসই হবে না।’
নানা তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেছিলেন, ‘বিবিএস পুরোনো ভিত্তি বছর ধরে মূল্যস্ফীতির হিসাব করছে, যা বর্তমান সময়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।’
সেলিম রায়হান বলেন, ‘নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষ খুবই চাপে আছে। ভাত না খেয়ে অন্য কিছু খেয়ে ক্ষুধা নিবারণ করছে অনেক মানুষ।’
একই কথা বলেছিলেন গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। গত ১৬ মে রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম আয়োজিত ‘বর্তমান আর্থসামাজিক পরিস্থিতি, জাতীয় বাজেট ও অসুবিধাগ্রস্ত মানুষের প্রত্যাশা’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘বিবিএসের মূল্যস্ফীতির হিসাব বাস্তবসম্মত ও বিজ্ঞানসম্মত নয়। বাজারের যে অবস্থা তাতে মূল্যস্ফীতি এখন ১২ শতাংশ হওয়া অসম্ভব কিছু নয়।’
তিনি বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি নিয়ে সরকারের হিসাবের সঙ্গে বাস্তবতার বিস্তর ফারাক। বিবিএস ২০০৫–০৬ সালের ভোক্তাদের মাথায় রেখে মূল্যস্ফীতির হিসাব করে। ১৭ বছর পর সেই মানুষদের পরিবর্তনকে তারা ধরছে না। গ্রামে মূল্যস্ফীতি শহরের চেয়ে বেশি।’
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বাজেট ঘোষণার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বৃহস্পতিবার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সরকারের মূল্যস্ফীতির তথ্য নিয়ে প্রশ্ন আছে। আর প্রশ্ন থাকাটাই স্বাভাবিক। কেননা বাজারের পণ্যমূল্যের সঙ্গে বিবিএসের তথ্যে মিল খুঁজে পাওয়া যায় না।
‘তার পরও বিবিএসের তথ্যকে মেনে নিয়ে যদি বলি, তাহলেও বলতে হয় একটা উদ্বেগজনক পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছি আমরা। কয়েক মাস ধরেই কিন্তু মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। এতে অবশ্য বৈশ্বিক বাজারেরও একটা প্রভাব আছে। বিশ্ববাজারে সব জিনিসের দামই বেশ বেড়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আরও বাড়বে বলে মনে হচ্ছে। তার প্রভাব আমাদের এখানেও পড়বে।
‘সে পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৬ শতাংশের মধ্যে রাখা কোনোভাবেই সম্ভব নয় বলে আমি মনে করি।’