জাতীয় সংসদে ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে ৪ হাজার ১৩২ কোটি টাকা বরাদ্দ বেড়েছে। সামগ্রিক ব্যয় বৃদ্ধি বিবেচনায় স্বাস্থ্যে বৃদ্ধির এই হার কম। তবে একইসঙ্গে প্রশ্ন উঠেছে এই খাতে ব্যয়ের সক্ষমতা নিয়ে।
করোনা মহামারি দেশে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার সংকটগুলো চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেও আগামী অর্থবছরের বাজেট বরাদ্দ ব্যয়ে স্বাস্থ্য খাত ঢেলে সাজাতে সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ নেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের। গত বছর স্বাস্থ্য খাতে যে বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল তার মাত্র ৪১ শতাংশ ব্যয় করতে পেরেছে মন্ত্রণালয়। বাকি ৫৯ শতাংশই ফেরত দেয়া হয়েছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জাতীয় সংসদে প্রস্তাবিত বাজেটে ৪ হাজার ১৩২ কোটি টাকা বরাদ্দ বেড়েছে। দেশে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়নে এই খাতে বরাদ্দ আরও বাড়ানো দরকার। একইসঙ্গে ব্যয়ের সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং জনবল দক্ষ করে তুলতে নানামুখী পরিকল্পনা নেয়া জরুরি।
স্বাস্থ্য খাতকে ঢেলে সাজাতে বাজেটে নতুনত্ব নেই বলে মন্তব্য করেছেন তারা। এমনকি মেগা পরিকল্পনা না থাকায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সক্ষমতা নিয়েও তারা প্রশ্ন তুলেছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ দেয়ার ক্ষেত্রে আগামীতে করোনাভাইরাস ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই বিনিয়োগের বিষয়টি বাজেটে যথাযথভাবে গুরুত্ব পায়নি।
স্বাস্থ্য খাতের বর্তমান বরাদ্দের মাধ্যমে শুধু স্বল্পমেয়াদি ও তাৎক্ষণিক প্রয়োজনগুলো মেটানো সম্ভব হবে। প্রতিবছর আগের অর্থবছরের তুলনায় টাকার অঙ্ক কিছুটা বাড়িয়ে বাজেটে বরাদ্দ দেয়া হয়। এবারও সেটি করা হয়েছে। তবে করোনার এই দুর্যোগে বাজেটে স্বাস্থ্য খাত সর্বোচ্চ গুরুত্ব পাওয়ার যে প্রত্যাশা ছিল তা হয়নি। বরাবরের মতোই এবারও স্বাস্থ্য খাতকে উপেক্ষা করা হয়েছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের বার্ষিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশের বেশি হওয়া সত্ত্বেও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ এখনও জিডিপির ১ শতাংশ। করোনা মহামারির মতো সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত জিডিপির ৫ শতাংশ হওয়া জরুরি। স্বাস্থ্যশিক্ষা ও বিজ্ঞান প্রযুক্তি খাতের গবেষণা উন্নয়নে চলতি অর্থবছরের মতো আগামীতেও ১০০ কোটি টাকার একটি সমন্বিত স্বাস্থ্য বিজ্ঞান গবেষণা ও উন্নয়ন তহবিল গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে।
বাজেট পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে ৪ হাজার ১৩২ কোটি টাকা বরাদ্দ বেড়েছে। গত অর্থবছরে (২০২১-২০২২) এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৩২ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা। এবার তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৬ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা।
গত বছরের তুলনায় সামগ্রিক বাজেট বেড়েছে ১৪ দশমিক ২৪ শতাংশ। তবে স্বাস্থ্য বাজেট বেড়েছে ১২ দশমিক ৬২ শতাংশ। অর্থাৎ মূল বাজেটের চেয়ে স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দ কম। স্বাস্থ্যে বরাদ্দ ৫ দশমিক ২ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেন, ‘কিছু প্রকল্প সম্প্রসারণ ছাড়া স্বাস্থ্য বাজেটে নতুনত্ব নেই। বরাদ্দের বৃদ্ধি মূলত ক্রমবর্ধমান ব্যয় এবং মুদ্রাস্ফীতির ব্যবস্থা মেটাবে। স্বাস্থ্য খাত ঢেলে সাজাতে বাজেটে নতুন চমকও নেই। করোনার মতো মহামারি মোকাবিলায় প্রস্তুতি ও সক্ষমতা বাড়াতে বাজেটে বরাদ্দ নেই।
‘আগের বছরের বাজেটের চেয়ে ৫ থেকে ১০ শতাংশ বাড়িয়ে পরের বছরের বাজেট তৈরি করেন। অনেক খাতে বরাদ্দ বাড়লেও ব্যয়ের সক্ষমতা ও দক্ষতা নেই। এ কারণে বাজেট অব্যবহৃত থেকে যায়। এসব বিষয় সরকারকে বিবেচনায় নিতে হবে।’
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই মাহবুব বলেন, ‘করোনা সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। অন্যথায় জনগণের যথাযথ স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত সম্ভব নয়। একইসঙ্গে নীতি ও পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। অন্যথায় স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হলেও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে না।’
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় অঞ্চলের সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, ‘দেশে বর্তমান ও বিগত বছরগুলোর স্বাস্থ্য বাজেট বরাদ্দ একমাত্র আফগানিস্তান ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম। আরেকটি খারাপ দিক হলো, স্বাস্থ্য খাতে যে বাজেটই দেয়া হয়েছে, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালায় তা খরচ করতে ব্যর্থ হয়েছে। এতে জনগণ স্বাস্থ্য খাতে যে উপকার পাওয়ার কথা তা থেকে বঞ্চিত হয়। এছাড়া যে বরাদ্দই দেয়া হয় সেটি ব্যবহারে অপচয় ও দুর্নীতি হয়। এসব বন্ধ করা গেলে জনসাধারণ কিছুটা হলেও উপকৃত হবে।
‘এবার বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ কিছুটা বাড়লেও মুদ্রা স্ফীতির কারণে তা আগের চেয়ে কমে যাবে। সুতরাং দুর্নীতি ও অপচয় রোধ এবং ব্যয়ের সক্ষমতা বাড়াতে না পারলে মানুষ উপকৃত হবে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘আপৎকালীন ব্যবস্থা হিসেবে করোনার জন্য পৃথক বাজেট থাকা দরকার। কারণ যে কোনো সময় করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট বা ঢেউ আসতে পারে। এখন মাঙ্কিপক্স আসছে। এভাবে নতুন নতুন রোগব্যাধি আসতেই পারে। ফলে আপৎকালীন বা থোক বরাদ্দ আরও বেশি হওয়া উচিত ছিল।’