যে সরকার অর্থনীতিতে কম ব্যয় করে, কম আয় করে, সে সরকারই উত্তম। এমনটিই ভাবা হতো ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগেও। পরে দিন যত এগিয়েছে, সরকারি অর্থ ব্যবস্থাপনার সেই ধারণা ততটাই বদলেছে। এখনকার প্রবণতা হচ্ছে- যে সরকার বেশি আয়-ব্যয় করে, সেই সরকারই উন্নয়নবান্ধব।
এ কারণে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ এখন ঘাটতি বাজেট করে থাকে, যেখানে সরকার আয়ের চেয়ে ব্যয় অনেক বেশি করে। তবে তার পরিমাণ সীমাহীন নয়। এর একটা মাত্রা থাকা উচিত। উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রেক্ষাপটে তা জিডিপির ৫ শতাংশের বেশি নয়।
জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বিশাল ব্যয়ের বাজেট ঘোষণা করেছেন, যা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১৫ দশমিক ২ শতাংশ।
আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের বিরাট ঘাটতি, যার পরিমাণ অনুদান ছাড়া ২ লাখ ৪৫ হাজার ৬৪ কোটি টাকা এবং অনুদানসহ ২ লাখ ৪১ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। বাজেটের আকার অনুযায়ী এটি যথাক্রমে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) শতকরা ৫ দশমিক ৫ ও ৫ দশমিক ৪ ভাগ, যা ঘাটতি বাজেটের সহনীয় মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। তবে এই ঘাটতির পরিমাণ ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে ছিল জিডিপির ৬ দশমিক ২ শতাংশ।
বিগত বছরগুলোয় বাংলাদেশের ঘাটতি বাজেট ৫ শতাংশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। তবে করোনার কারণে গত দুই (২০২০-২১ ও ২০২১-২২) অর্থবছরে সেটি ৬ দশমিক ২ শতাংশের সীমাও ছাড়িয়ে যায়। সেটিকেও অর্থনীতিবিদরা সময়ের বাস্তবতা বলে মনে করেছেন।
এবার সেই অভিঘাত কিছুটা কমে এলেও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধাবস্থার কারণে বিশ্বে নতুন করে শুরু হয়েছে অর্থনৈতিক অস্থিরতা। তার প্রভাবও পড়েছে বাংলাদেশে। ফলে দেশের মানুষের খাদ্যনিরাপত্তার ঝুঁকি এবং উচ্চ মূল্যস্ফীতি থেকে সুরক্ষা দেয়ার পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ উৎপাদন, কর্মসংস্থান ও আয়বর্ধক উদ্দীপক কর্মসূচি নেয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। তাই ঘাটতি বাজেটের উদ্দেশ্য স্পষ্ট হয়েছে অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তব্যের বিভিন্ন অংশের আলোচনায়।
অর্থমন্ত্রী আশা করছেন, প্রস্তাবিত বাজেটের ঘাটতি মেটাতে চ্যালেঞ্জ থাকলেও বাস্তবায়ন পর্যায়ে তিনি তা সমন্বয় করতে সক্ষম হবেন।
যদি সরকারের ব্যয়ের চেয়ে আয় কম হয়, তাহলে তাকে ঘাটতি বাজেট বলে। সরকারি ব্যয় ও আয় সমান থাকলে সেটি সুষম বাজেট এবং ব্যয়ের চেয়ে আয় বেশি হলে তাকে উদ্বৃত্ত বাজেট বলে। অর্থনীতিবিদরা এই ঘাটতি বাজেটকে ‘সময়ের বাস্তবতা’ বলে উল্লেখ করেছেন।
এ কারণে বাজেট প্রণয়নে সংশ্লিষ্ট অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারাও ঘাটতি বাজেটের পক্ষে জোরালো যুক্তিতর্ক খোঁজেন। এ-বিষয়ক আলোচনায় নিউজবাংলার কাছে একাধিক কর্মকর্তা দাবি করেছেন, উদ্বৃত্ত বাজেট দেয়ার পর্যায়ে দেশ পৌঁছেনি। আবার সুষম বাজেট দিয়ে বর্তমান বিশ্বে টিকে থাকা সম্ভব নয়। তাই জনগণের জীবনযাত্রার মান ও মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি করতে হলে অর্থাৎ অর্থনৈতিক উন্নয়ন করতে হলে ঘাটতি বাজেটই শ্রেয়। উন্নয়নশীল দেশগুলোর ক্ষেত্রে সেটি আরও বেশি প্রযোজ্য।
ঘাটতি বাজেটের মাধ্যমে দেশের রাজস্ব নীতির লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়িত হয়। বাণিজ্য চক্রের উত্থান-পতনের সঙ্গে সঙ্গে এ বাজেট প্রণয়ন করে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা করা যায়। এ ছাড়া মূলধন গঠনের জন্য এ বাজেটের কোনো বিকল্প নেই। তা ছাড়া বিশ্বব্যাপী এখন মূল্যস্ফীতির ঝুঁকিতে আছে। ঘাটতি বাজেটে দেশের অব্যবহৃত সম্পদ ব্যবহৃত হয় এবং উৎপাদন ও নিয়োগ বৃদ্ধি পায়, যা মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার সেই সম্ভাবনাকে একটা স্তর পর্যন্ত প্রশমিত রাখতে পারে।
বাজেট পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এবার ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা ব্যয়ের বাজেট বাস্তবায়ন করতে আয়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৩৬ হাজার ২৭১ কোটি টাকা। ফলে ঘাটতি বাজেট (অনুদানসহ) হবে ২ লাখ ৪১ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। আর অনুদান ছাড়া ঘাটতির অঙ্ক দাঁড়াবে ২ লাখ ৪৫ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। এ বছর বৈদেশিক অনুদান পাওয়ার আশা করা হচ্ছে ৩ হাজার ২৭১ কোটি টাকা। বৈদেশিক অনুদান পরিশোধ করতে হয় না। এ জন্য এটি সরকারের আয় মনে করা হয়।
এই ঘাটতি মেটাতে অর্থমন্ত্রী ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা এবং সঞ্চয়পত্র থেকে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। বিদেশ থেকে ঋণ গ্রহণ করা হবে ৯৫ হাজার ৮৪৫ কোটি টাকা। অন্যান্য খাত থেকে ঋণ নেওয়া হবে ৫ হাজার ১ কোটি টাকা।
বিদায়ী ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা ব্যয়ের বাজেটে আয়-ব্যয়ের মধ্যে ঘাটতি রাখা হয় অনুদানসহ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৬ দশমিক ১ শতাংশ, যা টাকার অঙ্কে ছিল মোট ২ লাখ ১১ হাজার ১৯১ কোটি টাকা। এ ক্ষেত্রে অনুদান ব্যতীত এই ঘাটতি রাখা হয় মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৬ দশমিক ২ শতাংশ, যা টাকার অঙ্কে ছিল মোট ২ লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে মোট ব্যয়ের আকার কাটছাঁট করে ৫ লাখ ৯৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকায়। এতে করে শেষ পর্যন্ত বাজেট বাস্তবায়নে ঘাটতির আকারও কমে আসে। অনুদানসহ নতুন ঘাটতি দাঁড়ায় ২ লাখ ১ হাজার ৩০৮ কোটি টাকা, যা জিডিপির শতকরা হিসাবে এর ৫ দশমিক ১ শতাংশ এবং অনুদান ছাড়া ২ লাখ ৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, যা জিডিপির শতকরা হিসাবে এর ৫ দশমিক ১ শতাংশ।
২০২০-২১ অর্থবছরে ৪ লাখ ৬০ হাজার ১৬০ কোটি টাকার প্রস্তাবিত বাজেটে মোট ঘাটতির পরিমাণ ছিল অনুদানসহ ১ লাখ ২৯ হাজার ১৪৭ কোটি টাকা বা জিডিপির শতকরা হিসাবে ৪ দশমিক ২ ভাগ। অনুদান ছাড়া ঘাটতি প্রাক্বলন করা হয় ১ লাখ ৩১ হাজার ৪৯৫ কোটি টাকা, যা জিডিপির শতকরা হিসাবে ৪ দশমিক ৩ ভাগ।
এ প্রসঙ্গে সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ঘাটতি বেশি হওয়া নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ দেখছি না আমি। এখন আমাদের বেশি বেশি খরচ করতে হবে। তবে বৈশ্বিক অস্থির পরিস্থিতিতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সুরক্ষিত রাখা জরুরি হয়ে পড়েছে। এই অবস্থায় যতটা সম্ভব বিদেশি ঋণ কম নিয়ে বিদেশি অনুদান আনার চেষ্টা বেশি করতে হবে। একই সঙ্গে বাজেটের টাকা সঠিকভাবে ব্যয় করতে হবে সামাজিক সুরক্ষামূলক বিভিন্ন খাতে। বাড়তি বিনিয়োগ করতে হবে উৎপাদন বৃদ্ধি, মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং জরুরি শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ অবকাঠামো খাতে। এর ফলে মানুষের সক্ষমতা বাড়বে এবং নতুন নতুন কাজের সুযোগ সৃষ্টি হবে।’
একইভাবে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আরেক অর্থ উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ ড. আকবর আলি খান মনে করেন, ‘ঘাটতি বাজেট শুধু দায় সৃষ্টি করে না, ঘাটতি দিয়ে যদি সক্ষমতা বাড়ানো যায় এবং অবকাঠামো খাতে ব্যয় করা হয়, তা হলে আয়ও সৃষ্টি করতে পারে।’
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফল পলিসি ডায়ালগের সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য মনে করেন, বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় গরিব মানুষকে সুরক্ষা দেওয়ার কথা চিন্তা করলে বাজেট ঘাটতি বড় বিষয় নয়। এই শ্রেণির মানুষের জন্য প্রত্যক্ষ অর্থসহায়তা ও খাদ্যসহায়তার ব্যবস্থা রাখা দরকার। তাদের সুরক্ষা প্রতিষেধক হলো টিসিবির কার্যক্রম বিস্তৃত করা, খাদ্যমূল্য কমানো, এক কোটি পরিবারকে সহায়তা দেওয়া।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মুঈদ রহমান বলেন, ‘আমাদের মতো অর্থনীতির জন্য ঘাটতি বাজেটই কার্যকর ও উপযুক্ত। এ ঘাটতির কারণে অব্যবহৃত সম্পদ ব্যবহারের ওপর চাপ থাকে এবং অর্থনীতিতে উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়।’