যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারের বিপরীতে টাকার মান এক দিনে কমল দুই দফায়। এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক আনুষ্ঠানিকভাবে ১ টাকা ৬০ পয়সা কমায়। এরপর আরও ৪৫ পয়সা অবমূল্যায়ন হয়। তবে সেটি বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে এখনও আপডেট হয়নি।
করোনা পরিস্থিতির উন্নতির পর বিশ্ব যখন স্বাভাবিক অবস্থায় যাচ্ছে, সে সময় ইউক্রেনে রুশ হামলার প্রতিক্রিয়ায় নানা ঘটনাপ্রবাহে দেশে দেশে মুদ্রা যখন মান হারাচ্ছে, তখন এই ঘটনাটি ঘটল সোমবার।
দুপুরে টাকার মান ১ টাকা ৬০ পয়সা কমিয়ে ডলারের দর ৯১ টাকা ৫০ পয়সা নির্ধারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। পরে বাজারে ডলারের ব্যাপক চাহিদা থাকায় আরও ৪৫ পয়সা কমিয়ে ৯১ টাকা ৯৫ পয়সা দরে ডলার বিক্রি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
অর্থাৎ সোমবার সবশেষ আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলার প্রায় ৯২ টাকায় বিক্রি হয়েছে। অর্থাৎ ১ ডলারের জন্য গুনতে হয়েছে ৯২ টাকা।
ব্যাংকগুলোতে ডলারের একক হার বেঁধে দেয়ার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার পর তিন দফায় ডলারের দাম বাড়ল। আর মে মাসে চার দফা কমেছিল টাকার মান।
এক দিনে দুই দফা টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে কি না- এ প্রশ্নের উত্তরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বিষয়টা আসলে সে রকম নয়, আন্তব্যাংক লেনদেনের দর সব সময় নিয়মিতভাবে হালনাগাদ হয় না। সে কারণেই এমনটা মনে হচ্ছে।
‘রোববারই আসলে ডলারের দর ৯১ টাকা ৫০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছিল। সেটা আজ (সোমবার) ওয়েবসাইটে দেয়া হয়। সোমবার অর্থাৎ আজ ডলারের দর আরও ৪৫ পয়সা বাড়িয়ে ৯১ টাকা ৯৫ পয়সা করা হয়েছে। সেটা কাল (মঙ্গলবার) ওয়েবসাইটে দেয়া হবে।’
রোববার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওয়েবসাইটে ডলার-টাকার বিনিময় হার দেয়া ছিল ৮৯ টাকা ৯০ পয়সা।
এর আগে ডলারের দর বেঁধে দেয়ার নিয়ম তুলে দেয়ার দিন বৃহস্পতিবার দুই দফায় আগের দিনের চেয়ে বেশি দরে ডলার বিক্রি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে ওই দিনও দুবার টাকার মান কমে যায়।
বৃহস্পতিবার প্রথম দফায় ব্যাংকগুলোর কাছে ৮৯ টাকা ৯০ পয়সা দরে বিক্রি করা হয় সাড়ে ১৩ কোটি ডলার।
মুখপাত্র সিরাজুল জানান, ওইদিন দ্বিতীয় দফায় জরুরি চাহিদা মেটাতে আরও ৫০ লাখ ডলার বিক্রি করা হয় ৯১ টাকা ৫০ পয়সায়।
এতে ডলারের দর বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়ার দিনই টাকার মান কমে আড়াই টাকা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একদিনে টাকা এতটা দর হারায়নি। এর আগে দর কমেছিল একদিনে সর্বোচ্চ ১ টাকা ১০ পয়সা।
গত বুধবার সাম্প্রতিক সময়ে চাহিদা সংকটে অস্থির হয়ে ওঠা ডলারের বাজারে প্রধান এ বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় মূল্য নির্ধারণের অনুসরণ করে আসা ‘ম্যানেজড এক্সচেঞ্জ রেট’তুলে নেয়ার কথা ব্যাংকগুলোকে জানায় বাংলাদেশ ব্যাংক।
আমদানির ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় ডলারের চাহিদা বাড়ছে গত কয়েক মাস ধরে। রপ্তানি ও রেমিটেন্স থেকে আমদানি খরচ মেটানোর মত ডলার মিলছে না। এ কারণে ডলারের সরবরাহে টান পড়েছে, যা প্রধান এ বৈদেশিক মুদ্রার বাজারকে চড়া করে তোলে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, নতুন নিয়ম অনুযায়ী এখন থেকে ডলারের বিনিময় হার বাজারের চাহিদা অনুযায়ী নির্ধারিত হবে। তবে নিজেদের মধ্যে ডলার লেনদেনে ব্যাংকগুলোকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডলার বিক্রির দরকে ‘অনুসরণ’ করতে বলা হয়েছে।
এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘বাজারের চাহিদা ও সরবরাহে ভারসাম্য রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছে। সোমবার ব্যাংকগুলোকে সাপোর্ট দিতে এক কোটি ডলার বিক্রি করেছে।’
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক সোমবার সবশেষ আন্তব্যাংক লেনদেনে ব্যাংকগুলোর কাছে ৯১ টাকা ৯৫ পয়সায় ডলার বিক্রি করলেও ব্যাংকগুলো সাধারণ গ্রাহকদের কাছে ৩ থেকে ৪ টাকা বেশি দরে নগদ ডলার বিক্রি করেছে।
রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক ৯৪ টাকা ৫০ পয়সায় নগদ ডলার বিক্রি করেছে। জনতা ব্যাংক বিক্রি করেছে ৯৩ টাকা ৯০ পয়সায়। অগ্রণী ব্যাংক থেকে ডলার কিনতে লেগেছে ৯৪ টাকা ৫০ পয়সা।
অন্যদিকে বেসরকারি ইস্টার্ন ও প্রাইম ব্যাংক ৯৬ টাকা দরে নগদ ডলার বিক্রি করেছে।
কার্ব মার্কে বা খোলাবাজারে সোমবার ৯৬ টাকা ৭০ পয়সা থেকে ৯৬ টাকা ৮০ পয়সায় ডলার বিক্রি হয়েছে।
আমদানি অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় বাজারে ডলারের চাহিদা বেড়ে যায়। চাহিদা সংকটে ঊর্ধ্বমুখী ডলারের দামের অস্থিরতা কমাতে বেশ কিছুদিন থেকেই টাকার মান অবমূল্যায়ন করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত মে মাসেই চার দফায় ডলারের দাম বাড়ানো হয়েছে।
মে মাসে প্রথম দফায় দর বাড়ানো হয়েছিল ৯ মে। সেদিন ডলারের বিনিময়মূল্য ২৫ পয়সা বাড়িয়ে ৮৬ টাকা ৭০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়। এর আগে এ বিনিময় হার ছিল ৮৬ টাকা ৪৫ পয়সা।
আর গত ২৩ মে তৃতীয়বারের মতো ডলারের বিপরীতে টাকার দর ৪০ পয়সা বাড়িয়ে আন্তব্যাংক লেনদেনে নির্ধারণ করা হয় ৮৭ টাকা ৯০ পয়সা, যা রোববার পর্যন্ত কার্যকর ছিল।
এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, চলতি বছর ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে সাতবার।
গত জানুয়ারির শুরুতে ডলারের বিনিময়মূল্য ২০ পয়সা বাড়িয়ে ৮৬ টাকা করেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ২৩ মার্চ তা আবার ২০ পয়সা বাড়িয়ে ৮৬ টাকা ২০ পয়সা করা হয়। ২৭ এপ্রিল বাড়ানো হয় আরও ২৫ পয়সা। তখন ১ ডলারের বিনিময়মূল্য দাঁড়ায় ৮৬ টাকা ৪৫ পয়সা।
করোনা মহামারির কারণে গত ২০২০-২১ অর্থবছরজুড়ে আমদানি বেশ কমে গিয়েছিল। তখন প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ে উল্লম্ফন দেখা যায়। সে কারণে বাজারে ডলারের সরবরাহ বেড়ে যায়। সে পরিস্থিতিতে ডলারের দর ধরে রাখতে গত অর্থবছরে রেকর্ড প্রায় ৮ বিলিয়ন (৮০০ কোটি) ডলার কিনেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তারই ধারাবাহিকতায় চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়েও ২০ কোটি ৫০ লাখ ডলার কেনা হয়।
কিন্তু আগস্ট মাস থেকে দেখা যায় উল্টোচিত্র। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করায় লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে শুরু করে আমদানি। রপ্তানি বাড়লেও কমতে থাকে রেমিট্যান্স। বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভও কমতে থাকে। বাজারে ডলারের চাহিদা বেড়ে যায়; বাড়তে থাকে দাম। বাজার স্থিতিশীল রাখতে আগস্ট থেকে ডলার বিক্রি শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক, যা এখনও অব্যাহত রয়েছে।
সব মিলিয়ে চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের সোমবার পর্যন্ত ১১ মাস ৬ দিন (২০২১ সালের ১ জুলাই থেকে ৬ জুন পর্যন্ত) ৬১৫ কোটি (৬.১৫ বিলিয়ন) ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপরও বাজারের অস্থিরতা কাটছে না।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, গত বছরের ৫ আগস্ট আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলার ৮৪ টাকা ৮০ পয়সায় বিক্রি হয়। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে এই একই জায়গায় ‘স্থির’ ছিল ডলারের দর। এরপর থেকেই বাড়তে থাকে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রার দর।
হিসাব করে দেখা যাচ্ছে, এই ১০ মাসে বাংলাদেশি মুদ্রা টাকার বিপরীতে ডলারের দর বেড়েছে ৮ দশমিক ৪২ শতাংশ।