পদ্মা সেতু ঘিরে সোনালি দিনের স্বপ্ন বুনছেন শরীয়তপুরের গবাদিপশু খামারিরা। উন্নত যোগাযোগ আর বিপণনব্যবস্থা নিশ্চিত হওয়ায় বাড়ছে এই খাতে বিনিয়োগকারীর সংখ্যা। এবারের কোরবানির ঈদ সামনে রেখে লাভের হিসাব কষতে বসেছেন তারা।
জেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, শরীয়তপুরে ছোট-বড় মিলিয়ে ১৪ হাজার ২৪৮টি খামার আছে। সেখানে লালনপালন করা হচ্ছে ২ লাখ ৯৯ হাজার ৮৭৫টি গরু, ২ হাজার ১৩০টি মহিষ, ১ লাখ ২০ হাজার ৭টি ছাগল ও ২ হাজার ৩৬টি ভেড়া।
এসব গবাদিপশু থেকে বছরে উৎপাদন হয় ৮১ হাজার টন মাংস ও ১ লাখ ৫ হাজার টন দুধ। জেলার চাহিদা মিটিয়ে ৪২ হাজার টন মাংস ও ৩২ হাজার টন দুধ উদ্বৃত্ত থেকে যায়।
উদ্যোক্তা ও খামারিরা জানান, রাজধানী ঢাকা থেকে মাত্র ৭০ কিলোমিটার দূরের জেলা হলেও এতদিন ফেরিঘাটের ভোগান্তির কারণে উদ্বৃত্ত এসব মাংস ও দুধ ঢাকায় বিক্রি করা যায়নি। তুলনামূলক কম দামে এসব দুধ ও মাংস স্থানীয় বাজার ও আশপাশের জেলায় বিক্রি করতে হয়েছে।
এখন সেতু চালু হলে মাত্র ২ ঘণ্টায় ঢাকায় পৌঁছাবে দুধ ও মাংস।
কোরবানির ঈদ সামনে রেখে শরীয়তপুর জেলা শহরের আঙ্গারিয়া এলাকায় ২২টি গরু ও ৭৫টি ছাগল মোটাতাজা করেছেন লিয়েন তালুকদার।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘গত বছর কোরবানির সময় ঢাকা নেয়ার পথে ফেরিঘাটে ট্রাকে মারা গেছে একটি গরু। দীর্ঘ সময় ট্রাকে আটকা থাকায় অসুস্থ হয়ে পড়ে বেশ কিছু গরু। এতে আমার প্রায় দেড় লাখ টাকার লোকসান হয়েছে।
‘সারা বছরের পরিশ্রমের ফল ঘরে তুলতে পারিনি। পদ্মা সেতু চালু হলে এবার ফেরিঘাটের ভোগান্তির অবসান ঘটবে। অল্প সময়ে নিরাপদে আমরা আমাদের পশু ঢাকার বাজারে নিয়ে যেতে পারব।’
ধানুকা এলাকার গরু খামারি ওবায়দুর রহমান বলেন, ‘ফেরিঘাটের ভোগান্তির কারণে এখানে ঢাকা থেকে কোনো পাইকার আসত না। আমরাও আমাদের মোটাতাজা করা পশু ঢাকায় পাঠাতে ভোগান্তিতে পড়তাম।
‘অনেক সময় ঘাটে আটকা থেকে পশু মারা যেত। অনলাইনে পশু বিক্রি করেও ডেলিভারি সুবিধা অপ্রতুল থাকায় অর্ডার বাতিল হয়ে যেত। পদ্মা সেতুই আমাদের সব হিসাব পাল্টে দিয়েছে। এখন আমরা এই শিল্পকে ঘিরে স্বপ্ন দেখি।’
পালং এলাকার রহমান ডেইরি ফার্মের ব্যবস্থাপক মো. সোহেল রানা জানালেন, ঢাকার চেয়ে প্রায় অর্ধেক দামে স্থানীয় বাজারে দুধ বিক্রি করছেন তিনি। ঘাটে ভোগান্তির কারণে এতদিন ঢাকার বাজার ধরতে পারেননি।
তিনি বলেন, ‘আমাদের ফার্মে প্রতিদিন ২০০ থেকে ২৫০ লিটার দুধ উৎপাদন হয়। স্থানীয় বাজারে ৪০-৪৫ টাকা দরে দুধ বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছি। অথচ ঢাকায় দুধের দাম প্রায় দ্বিগুণ।
‘ফেরিঘাটে দীর্ঘ সময় লাগার কারণে এতদিন ঢাকায় দুধ পাঠানো সম্ভব হয়নি। এখন ঢাকা থেকে দুধ প্রক্রিয়াজাতকরণ কোম্পানি সহজেই এখানে গাড়ি নিয়ে এসে দুধ সংগ্রহ করতে পারবে।’
পদ্মা সেতু চালুর পর এবারের কোরবানি ঈদে ঢাকার বাজার ধরতে স্থানীয় অনেক খামারি আগ্রহ দেখাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ডেইরি ফার্ম অ্যাসোসিয়েশন শরীয়তপুর শাখার সভাপতি ইমরান ব্যাপারী।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘একমাত্র ফেরিঘাটের ভোগান্তির কারণে শরীয়তপুরে অ্যাগ্রো ও ডেইরি ফার্মের তেমন একটা প্রসার ঘটেনি। যোগাযোগব্যবস্থার কারণে আমাদের উৎপাদিত পণ্য ঢাকা পাঠানো সম্ভব হতো না।
‘পদ্মা সেতু চালু হলে এবার কোরবানির ঈদে সহজেই ঢাকার বাজারে পশু বিক্রির সুযোগ পাব। সেতু উদ্বোধনের খবরে নতুন অনেক উদ্যোক্তা খামার করার দিকে আগ্রহী হচ্ছেন।’
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা সুবোধ কুমার দাস নিউজবাংলাকে বলেন, ‘শরীয়তপুরে চাহিদার চেয়ে মাংসের উৎপাদন প্রায় দ্বিগুণ। এ ছাড়া দুধ উৎপাদনও রয়েছে চাহিদার চেয়ে অনেক ওপরে। একমাত্র যোগাযোগব্যবস্থার জন্য খামারিরা এতদিন ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।
‘পদ্মা সেতু চালুর পর সব সমস্যা কেটে যাবে। সেতু চালুর ঘোষণার পর থেকেই এই অঞ্চলে ডেইরি, অ্যাগ্রো ও পোলট্রি সেক্টরে বিনিয়োগ বাড়তে শুরু করেছে। স্থানীয় ও অন্য জেলার উদ্যোক্তারা যোগাযোগ করছেন। প্রাণিসম্পদ বিভাগের পক্ষ থেকে তাদের সব ধরনের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।’