করোনা মহামারির পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্ব অর্থনীতিকে ওলোট-পালট করে দিচ্ছে। যুদ্ধের কারণে খাদ্য ও জ্বালানির দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ায় বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিতে পারে বলে সতর্ক করেছেন বিশ্ব ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ডেভিড ম্যালপাস। একই কথা বলেছে আইএমএফ। তীব্র খাদ্য সংকটের আশঙ্কা করছে জাতিসংঘ।
বাংলাদেশেও নানা ক্ষেত্রে যুদ্ধের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। জ্বালানি তেল, খাদ্যপণ্যসহ সব ধরণের পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি এবং জাহাজ ভাড়া বাড়ার কারণে আমদানি খরচ অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে। যার ফলে বাজারে ডলারের সংকট দেখা দিয়েছে; অস্থির হয়ে উঠেছে মুদ্রাবাজার। বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ডলার ছেড়েও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না। চড়ছে মূল্যস্ফীতির পারদ।
এ পরিস্থিতিতে ৯ জুন বৃহস্পতিবার সংসদে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এটি দেশের ৫১তম, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের ২২তম এবং বর্তমান অর্থমন্ত্রীর চতুর্থ বাজেট।
নতুন বাজেট নিয়ে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মতামত নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করছে নিউজবাংলা। এ পর্বে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলামের সাক্ষাৎকার প্রকাশ করা হলো।
নিউজবাংলা: বাজেট ঘোষণার আগে দেশের অর্থনীতির হালচাল কেমন দেখছেন?
মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম: সার্বিকভাবে বলা যায়, বর্তমানে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কিছুটা উদ্বেগজনক, তবে হতাশাব্যঞ্জক নয়। দুই বছরের বেশি সময়ের মহামারি করোনা এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যেও চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ সন্তোষজনক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি (জিডিপি প্রবৃদ্ধি) অর্জন করতে চলেছে। সরকার বা পরিসংখ্যান ব্যুরো ৯ মাসের (জুলাই-মার্চ) তথ্য দিয়ে বলেছে, ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবিসহ বিভিন্ন দাতাসংস্থা বলছে, ৬ শতাংশের উপরে প্রবৃদ্ধি হবে।
এই কঠিন সময়ে ৬ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হলেও বেশ ভালো। পৃথিবীর অনেক দেশই এই প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারবে না। সে কারণেই আমি বলছি, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি খুব একটা উদ্বেগজনক না।
নিউজবাংলা: নতুন বাজেটে অর্থমন্ত্রীকে কোন বিষয়টিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে বলবেন আপনি?
মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম: বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এখন মূল্যস্ফীতি। অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচক বেড়েই যাচ্ছে। সরকারি হিসাবে এপ্রিলে মূল্যস্ফীতির হার ৬ দশমিক ২৯ শতাংশে উঠেছে। যদিও এই তথ্য নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন আছে; পরিসংখ্যান ব্যুরো বা বিবিএস মূল্যস্ফীতির যে তথ্য প্রকাশ করে, তা ১৭/১৮ বছর আগের ২০০৫-০৬ অর্থবছরকে ভিত্তিবছর ধরে। অথচ জিডিপি বা মাথাপিছু আয়ের তথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে ২০১৫-১৬ অর্থবছরকে ভিত্তিবছর ধরে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরকে ভিত্তিবছর ধরে যদি মূল্যস্ফীতির তথ্য প্রকাশ করা হতো, তাহলে হয়তো এই সূচক আরও বেশি হতো। সে কারণে মূল্যস্ফীতির সরকারি হিসাব নিয়ে যে প্রশ্ন উঠেছে, সেটাকে আমি যৌক্তিক বলে মনে করি।
তবে মূল্যস্ফীতির এই ঊর্ধ্বগতির জন্য আন্তর্জাতিক কারণও আছে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল, খাদ্যপণ্য সহ সব ধরনের জিনিসপত্রের দাম অনেক বেড়ে গেছে। যুদ্ধের কারণে রাশিয়া-ইউক্রেন থেকে গম আসছে না। ভারতও গত রপ্তানির উপর এক ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। ইন্দোনেশিয়া পামঅয়েল রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছিল। সব মিলিয়ে পণ্যমূল্য বেড়ে যাচ্ছে। যার ফলে বাড়ছে মূল্যস্ফীতি। আর এই মূল্যস্ফীতির চাপে সবচেয়ে বিপদে পড়েছে গরিব মানুষ, যারা দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে।
আমার বিবেচনায় এই অসহায় মানুষগুলোর জন্যই বাজেটে সবচেয়ে বেশি জোর দিতে হবে অর্থমন্ত্রীকে। সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় যে সব কর্মসূচি আছে, যেমন বয়স্ক ভাতা, বিধবা, স্বামী পরিত্যাক্ত, প্রতিবন্ধি ভাতাসহ সব ভাতার পরিমাণ এবং সুবিধাভোগীর সংখ্যা বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে এ সব ভাতার যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। অপব্যবহার বন্ধ করতে হবে। যাদের এই ভাতা পাওয়ার কথা, তারা সবাই যেন এই ভাতা পায়; আর যাদের সামর্থ্য আছে অর্থাৎ যাদের এ সব ভাতা পাওয়ার কথা নয়, তারা যেন না পায়, সেটা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। নিঃসন্দেহে এটা একটা চ্যালেঞ্জ। তবে এই কঠিন সময়ে এটা করতেই হবে।
নিউজবাংলা: বেশ কিছু দিন ধরে ডলারের বাজার অস্থির। ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমছেই। এতে অর্থনীতিতে কী ধরনের প্রভাব পড়ছে?
মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম: আমদানি অতিমাত্রায় বেড়ে যাওয়ায় এই সমস্যা হয়েছে। রপ্তানিও বেড়েছে। কিন্তু আমদানির তুলনায় কম। সে কারণে বিশাল বাণিজ্য ঘাটতির মুখে পড়েছে দেশ। ব্যালান্স অফ পেমেন্টও অনেক বেড়ে গেছে। আমদানি বাড়ায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। এখানে একটি বিষয় খুব তীক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে। আমদানির আড়ালে দেশ থেকে অর্থ পাচার হয়ে যাচ্ছে কি না, তা দেখতে হবে। যদি এটা হয়ে থাকে, তাহলে যে করেই হোক বন্ধ করতে হবে।
তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে যে করেই হোক আমদানি কমাতেই হবে। সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইতোমধ্যে বিলাসপণ্য আমদানির লাগাম টানতে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে, সেগুলো সঠিকভাবে পরিপালন হলে হয়ত আমদানি কিছুটা কমবে।
তবে ডলারের দাম বাড়ার কিন্তু ভালো দিকও আছে। রপ্তানিকারকরা লাভবান হন। প্রবাসীরাও বেশি রেমিট্যান্স পাঠাতে উৎসাহিত হন।
নিউজবাংলা: গত অর্থবছরে প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৩৬ শতাংশের বেশি। কিন্তু চলতি অর্থবছরে ১১ মাসের (জুলাই-মে) যে তথ্য পাওয়া গেছে, তাতে ১৬ শতাংশের মতো কম এসেছে। রেমিট্যান্সের এই নিম্মগতিকে কীভাবে দেখছেন?
মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম: রেমিট্যান্স কমাটা একটা উদ্বেগের বিষয়। তবে সাম্প্রতিককালে প্রচুর শ্রমিক কাজের জন্য বিভিন্ন দেশে গেছে। নভেম্বরে কাতারে বিশ্বকাপ ফুটবলকে কেন্দ্র করে কাতারসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর অর্থনীতি চাঙা হয়েছে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণেও ফুরফুরে মেজাজে আছে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর অর্থনীতি। আমাদের বিপুলসংখ্যক প্রবাসী এসব দেশে কাজ করেন। নতুন বাজেটে প্রণোদনার বাড়ানো হবে বলে শুনছি। সব মিলিয়ে আগামী দিনগুলোতে রেমিট্যান্স বাড়বে বলে আমার মনে হচ্ছে।
নিউজবাংলা: ব্যবসায়ী শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার সংগঠনের পক্ষ থেকে করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানোর দাবি উঠেছে। আপনার এ বিষয়ে মতামত কী?
মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম: আমি মনে করি, করমুক্ত আয়ের সীমা কিছুটা বাড়নো যেতে পারে। কেননা, মূল্যস্ফীতির বিষয়টি আমি আগেই বলেছি, সেটা বিবেচনায় নিলে এই সীমা বাড়ানো উচিৎ। দুই বছর করমুক্ত আয়ের সীমা একই আছে, ৩ লাখ টাকা। এবার সেটা একটু বাড়ানো যেতে পারে।
এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম
নিউজবাংলা: নতুন বাজেটে রাজস্ব আদায় বাড়াতে কী পদক্ষেপ নেয়া উচিৎ বলে আপনি মনে করেন?
মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম: বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের সরকারি ব্যয় বাড়াতে হবে। আর সেটা করতে হলে রাজস্ব আদায় বাড়াতেই হবে। কিন্তু দুঃখজনক হলো আমাদের ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত খুবই কম। এমনকি নেপালের চেয়েও কম। এই অনুপাত অবশ্যই বাড়াতে হবে। যাদের টিআইএন (কর শনাক্তকরণ নম্বর) আছে, তাদের সবাই যাতে কর দেয়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। আমি এখানে একটা কথা পরিষ্কার করে বলতে চাই, করের হার কমিয়েও কিন্তু রাজস্ব আদায় বাড়নো যায়। সে ক্ষেত্রে করের আওতা বাড়াতে হবে। যাদের সামর্থ্য আছে, তাদের সবার কাছ থেকে কর আদায় করতে হবে। নতুন নতুন খাতকে করের আওতায় নিয়ে আসতে হবে।
নিউজবাংলা: অনেকেই বাংলাদেশকে নিয়ে শ্রীলঙ্কা-পাকিস্তানের সঙ্গে তুলনা করছেন। এ বিষয়ে আপনার মতামত কী?
মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম: আমি আগেই বলেছি, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কিছুটা উদ্বেগজনক, তবে হতাশাব্যঞ্জক নয়। এখনও আমাদের অর্থনীতি শক্ত ভিত্তির উপর আছে। মূল্যস্ফীতির চ্যালেঞ্জ আছে। ডলারের বাজারে অস্থিরতা আছে ঠিক। কিন্তু অন্য সূচকগুলোর দিকে তাকালে স্বস্তির নিঃশ্বাসই ফেলতে হয়। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে ব্যাপক আমদানির পরও রিজার্ভ ৪২ বিলিয়ন ডলারের উপরে অবস্থান করছে, যা দিয়ে প্রায় ছয় মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। রপ্তানি আয়ে ধারাবাহিকভাবে বেশ কিছু দিন ধরে ভালো প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। তাই যারা শ্রীলঙ্কা-পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশকে তুলনা করছেন, তারা তথ্য-উপাত্ত নিয়ে কথা না বলে মনগড়া কথা বলছেন। অযথা ভয়-আতঙ্ক ছড়ানোর জন্য বলছেন।
যুদ্ধের প্রভাব বিশ্ব অর্থনীতিতে পড়ছে ঠিক। কিন্তু সেটা মন্দা ডেকে আনবে কিনা তা বলার সময় এখনও আসেনি। আর যদি মন্দা দেখাও দেয়, তার প্রভাব বাংলাদেশে পড়বে ঠিক। কিন্তু খুব বেশি সংকটের মধ্যে আমরা পড়ব না। কেননা, মন্দার জন্য প্রধানত খাদ্য সংকটকে দায়ি করা হচ্ছে। বাংলাদেশে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে যে খাদ্য মজুত আছে, চলতি বোরো মৌসুমে যে ধান উৎপাদন হচ্ছে, তা দিয়ে দুই-তিন বছর অনায়াসে চলে যাবে। এর মধ্যে যুদ্ধও স্থিমিত হয়ে আসবে আশা করি। তাই খুব বেশি ভয় পাওয়ার কোনো কারণ আমি দেখছি না।
নিউজবাংলা: নতুন বাজেট নিয়ে আপনার আর কোনো পরামর্শ আছে আছে কি?
মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম: নতুন বাজেটে আমি অর্থমন্ত্রীকে একটি বিষয় বিবেচনায় নিতে বলব। বাংলাদেশের বাস্তবতায় সাধারণত আমরা বাজেট ঘাটতি ৬ শতাংশের নিচে রাখতে চাই। আমি মনে করি, বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে নতুন বাজেটে বাজেট ঘাটতি সাড়ে ৬ শতাংশ হলেও কোনো সমস্যা নেই।
সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে বাস্তবায়ন। বাজেট বাস্তবায়নের দিক দিয়ে কিন্তু আমরা সব সময়ই পিছিয়ে থাকি। খুব বেশি হলে ৮০-৮৫ শতাংশ ব্যয় হয়। বাজেটে এমন দিকনির্দেশনা দিতে হবে যাতে বাজেটের পুরো অর্থই ব্যয় হয়। আর যে অর্থ ব্যয় হবে, তা যেন সঠিকভাবে-যথাযথভাবে হয়। কোনো ধরনের দুর্নীতি না হয়। সময়মতো প্রকল্পের কাজ শেষ হয়। দেশের মানুষ যাতে বাজেটের সুফল নির্ধারিত সময়ে পায়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।