রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় নানা অনিশ্চয়তার মধ্যে অর্থনীতিতে একটি সুখবর দিয়েছে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ-ইআরডি। সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিভাগটি জানিয়েছে, বিদেশি ঋণসহায়তা প্রাপ্তিতে রেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশ। চলতি অর্থবছরের ১০ মাসেই (জুলাই-এপ্রিল) বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে ৭৭০ কোটি ৮৫ লাখ (৭.৭১ বিলিয়ন) ডলারের ঋণসহায়তা পেয়েছে বাংলাদেশ।
দেশের ইতিহাসে এর আগে কোনো অর্থবছরের পুরো সময়েও (১২ মাস) এত বেশি বিদেশি ঋণসহায়তা আসেনি।
অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুর বলছেন, ‘দুই বছরের বেশি সময় ধরে চলা মহামারির ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে প্রত্যাশার চেয়েও বেশি সহায়তা পাওয়ায় এই উল্লম্ফন হয়েছে।’
জুলাই-এপ্রিল সময়ে দাতারা যে অর্থ ছাড় করেছে বর্তমান বিনিময় হার হিসাবে (প্রতি ডলার ৮৯ টাকা ৯০ পয়সা), টাকার অঙ্কে তার পরিমাণ ৬৯ হাজার ৩০০ কোটি; যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ৫৯ শতাংশ বেশি।
ইআরডির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত ২০২০-২১ অর্থবছরে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে ৭১০ কোটি (৭.১ বিলিয়ন) ডলার ঋণসহায়তা পেয়েছিল বাংলাদেশ।
তার আগে ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বিদেশি ঋণ আসে বাংলাদেশে। ওই বছর ৭৩৮ কোটি (৭.৩৮ বিলিয়ন) ডলার ঋণ পাওয়া গিয়েছিল।
চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের ১০ মাসে অর্থাৎ জুলাই-এপ্রিল সময়ে তার চেয়েও সাড়ে ৪ শতাংশ বেশি ঋণসহায়তা পেল বাংলাদেশ।
বাংলাদেশে বিদেশি ঋণ বাড়তে থাকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে। ওই বছরই এক লাফে অর্থছাড় ৩০০ কোটি থেকে ৬৩৭ কোটি ডলারে উন্নীত হয়। তারপর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আসে ৬৫৪ কোটি ডলার।
শ্রীলঙ্কায় অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের পর বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ নিয়েও নানা কথা হচ্ছে। যদিও দুই দেশের তুলনাই চলে না।
বাংলাদেশের জিডিপির তুলনায় এই ঋণ এখনও ১৩ শতাংশের নিচে; আর শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রে তা ৫০ শতাংশের কাছাকাছি।
অর্থ সচিব আব্দুর রউফ তালুকদার ও ইআরডি সচিব ফাতিমা ইয়াসমিন জোর দিয়ে বলেছেন, বাংলাদেশের বিদেশি ঋণের সুদের হার খুবই কম। বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি খুবই ভালো অবস্থায় আছে; প্রতিটি সূচক ঊর্ধ্বমুখী। শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তান মিলিয়ে যা রিজার্ভ আছে, বাংলাদেশের তার দ্বিগুণেরও বেশি আছে। শ্রীলঙ্কার মতো ভুল করেনি বাংলাদেশ। তাই বিদেশি ঋণ নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। কম সুদের বিদেশি ঋণ যত বাড়বে, বাংলাদেশের উন্নয়ন ততই ত্বরান্বিত হবে।
ইআরডি বৃহস্পতিবার বিদেশি ঋণসহায়তার প্রতিশ্রুতি ও ছাড়ের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত বাংলাদেশকে ৫৮৮ কোটি ৫৪ লাখ (৫.৮৮ বিলিয়ন) ডলার ছাড় করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল দাতারা। পাওয়া গেছে ৭৭০ কোটি ৮৫ লাখ ৫০ হাজার (৭.৭১বিলিয়ন) ডলার।
এ হিসাবে, ১০ মাসে দাতারা বাংলাদেশকে যে ঋণ দিতে চেয়েছিল তার থেকেও ৩১ শতাংশ বেশি ছাড় করেছে। বিদেশি ঋণসহায়তা প্রাপ্তিতে এমনটা বিরল।
ছাড় করা ঋণের মধ্যে ৭৫২ কোটি ডলার পাওয়া গেছে প্রকল্প সাহায্য হিসেবে। ১৮ কোটি ৮৫ লাখ ৪০ হাজার ডলার পাওয়া গেছে অনুদান।
এর মধ্যে ২৫ লাখ ৩০ হাজার ডলার খাদ্য অনুদান এবং ১৮ কোটি ৬০ লাখ ১০ হাজার ডলার প্রকল্প অনুদান হিসেবে পাওয়া গেছে।
২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে ৪৮৫ কোটি ৫৩ লাখ ৮০ হাজার (৪.৮৫ বিলিয়ন) ডলার ছাড় করেছিল দাতারা।
সে হিসাবেই এই ১০ মাসে বিদেশি ঋণসহায়তা বেড়েছে ৫৯ শতাংশ।
প্রতিশ্রুতি বেড়েছে ৩৬.৫১ শতাংশ
ইআরডির তথ্য বলছে, গত অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে ৫২৭ কোটি ৫৪ লাখ (৫.২৭ বিলিয়ন) ডলারের ঋণসহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল দাতারা। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে সেই প্রতিশ্রুতির চেয়ে ১১ দশমিক ৫৬ শতাংশ বাড়িয়ে ৫ দশমিক ৮৮ বিলিয়ন ডলার করেছে।
সুদ পরিশোধ বেড়েছে ৯.২২ শতাংশ
এই ১০ মাসে আগে নেয়া ঋণের আসল ও সুদ পরিশোধের পরিমাণ বেড়েছে ৯ দশমিক ২২ শতাংশ। এ সময়ে সরকার আসল ও সুদ বাবদ উন্নয়ন সহযোগীদের ১৭৫ কোটি ১৮ লাখ ৩০ হাজার ডলার শোধ করেছে। গত অর্থবছরে একই সময়ে এই অঙ্ক ছিল ১৬০ কোটি ৩৮ লাখ ৮০ হাজার ডলার।
‘শ্রীলঙ্কা হবে না বাংলাদেশ’
অর্থ সচিব আবদুর রউফ তালুকদার বলেন, ‘কম সুদের বিদেশি ঋণসহায়তা বাংলাদেশের উন্নয়নে বরাবরই অবদান রেখে চলেছে। অনেকে না বুঝেই এ বিষয়ে কথা বলছেন। এসবের কোনো ভিত্তি নেই। দুই-আড়াই বছরের মহামারির পর এখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ গোটা বিশ্ব অর্থনীতিকেই পাল্টে দিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে এই ঋণ আমাদের অর্থনীতির গতি ইতিবাচক ধারায় রাখতে অবদান রাখবে।’
বাংলাদেশ কেন শ্রীলঙ্কা হবে না- তার পক্ষে যুক্তি ও তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরে অর্থ সচিব আবদুর রউফ তালুকদার বলেন, “গত ১৩ বছরে বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় আছে। তার সুফল অর্থনীতি পাচ্ছে। আমাদের অর্থনীতির ‘থ্রি আর’ আরএমজি, (তৈরি পোশাক), রেমিট্যান্স এবং রাইস (চাল বা ধান) চমক দেখিয়ে চলেছে। বছরের পর বছর ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। তৈরি পোশাকের রপ্তানি বেড়েছে ৩৬ শতাংশ। রেমিট্যান্সও ইতিবাচক ধারায় আছে। এ তিন খাতেই শ্রীলঙ্কা নাজুক অবস্থায় আছে।”
তিনি বলেন, ‘মহামারি করোনার ধাক্কা দ্রুত কাটিয়ে উঠছি আমরা। পৃথিবীর অনেক দেশই তা পারেনি। গত অর্থবছরে আমরা ৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছি। চলতি অর্থবছরে ৭ দশমিক ২৫ শতাংশের বেশি অর্জিত হবে। রাজস্ব আদায়ে ১৫ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বেড়ে ১২ শতাংশ ছাড়িয়েছে।
‘সব মিলিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি শক্ত মজবুত ভিক্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থায় আছে আমাদের অর্থনীতি।’
ইআরডি সচিব ফাতিমা ইয়াসমিন বলেন, ‘আমাদের বিদেশি ঋণ জিডিপির ১২ শতাংশ; আর শ্রীলঙ্কার ৪৮ শতাংশ। আমাদের ঋণের সুদের হার মাত্র ১ দশমিক ৪ শতাংশ; শ্রীলঙ্কার ১২ শতাংশ। শ্রীলঙ্কার বিদেশি ঋণের পরিমাণ ৩৫ বিলিয়ন ডলার; আমাদের ৫০ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশের ঋণ ঝুঁকিমুক্ত। শ্রীলঙ্কাকে প্রতি বছর সুদ-আসল বাবদ ৭ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতে হয়। আমাদের করতে হয় দুই-আড়াই বিলিয়ন ডলার।
‘আমাদের কোনো সভরেন বন্ড ঋণ নেই, বাণিজ্যিক ঋণও নেই। আমাদের ঋণ পরিশোধ নিয়ে কোনো ঝুঁকি নেই। আগামী ১০ বছর ঋণ পরিশোধে কোনো সমস্যা নেই বাংলাদেশের। অথচ শ্রীলঙ্কার এক কিস্তি শোধ করারও ক্ষমতা নেই।’
তবে বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে সার্বিক বিষয় বিবেচনায় আত্মতুষ্ঠিতে না ভুগে সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদ পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘দেশের প্রয়োজনে কম গুরুত্বপূর্ণ অনেক মেগা প্রকল্পও নেয়া হচ্ছে। তবে এসব প্রকল্পে করা বিনিয়োগ দ্রুত সময়ে ফেরত না এলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সংকট দেখা দিতে পারে।
‘আমাদের অনেকগুলো মেগা প্রকল্প হচ্ছে, যেগুলোর প্রয়োজন আছে। তবে এমন অনেকগুলো আছে, যেগুলোর এই মুহূর্তে আসলে কোনো উপযোগিতা বা প্রয়োজন নেই। পদ্মাসেতু আমাদের অবশ্যই দরকার আছে। এটা চালু হলে প্রথম দিন থেকেই রিটার্ন আসবে। কিন্তু ওই রুটে পদ্মা রেল সেতুর খুব একটা প্রয়োজন নেই। কারণ পদ্মা সেতু হওয়ার কারণে ওই এলাকা থেকে সহজেই পণ্য ঢাকায় আসবে, আবার নৌ-পথও রয়েছে। এখানে রেলপথে যে এক্সট্রা ভ্যালু এডিশন হওয়ার কথা, সে সুযোগ নেই। যে বিশাল বিনিয়োগ হচ্ছে, সেটা ফেরত আসার সুযোগ কম।’
এ ধরনের ‘কম প্রয়োজনীয়’ প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন আহসান মনসুর।