ব্যাংকগুলো নিজেদের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের বেঁধে দেয়া দরে ডলার কেনাবেচা করলেও সাধারণ মানুষের কাছে ডলার বিক্রি করছে সাড়ে ৪ টাকা থেকে ৭ টাকা বেশি দরে। খোলাবাজার বা কার্ব মার্কেটে বিক্রি হচ্ছে আরও বেশি দামে।
ব্যাংকগুলোর দাবির পরিপেক্ষিতে রোববার কেন্দ্রীয় ব্যাংক আন্তব্যাংক কেনাবেচার ক্ষেত্রে ডলারের দাম ৮৯ টাকা নির্ধারণ করে দেয়। পাশাপাশি আমদানিকারকদের কাছে বিক্রির ক্ষেত্রে প্রতি ডলারের দাম ৮৯ টাকা ১৫ পয়সা নির্ধারণ করা হয়। ব্যাংকগুলো অবশ্য আন্তব্যাংক লেনদেনে প্রতি ডলারের বিনিময় মূল্য ৮৯ টাকা ৮০ পয়সা নির্ধারণের প্রস্তাব করেছিল।
ব্যাংকগুলো সোমবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেঁধে দেয়া ৮৯ টাকা দরে নিজেদের মধ্যে ডলার কেনোবেচা করেছে। আমদানিকারকদের কাছে বিক্রির ক্ষেত্রেও ৮৯ টাকা ১৫ পয়সা নির্ধারণ করা দর মেনেছে।
তবে সাধারণ মানুষের কাছে ডলার বিক্রির ক্ষেত্রে আগের মতোই গ্রাহকদের কাছ থেকে বেশি টাকা রাখছে ব্যাংকগুলো। রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক ৯৩ টাকা ৪৫ পয়সা দরে ডলার বিক্রি করেছে। জনতা ব্যাংক থেকে ১ ডলার কিনতে লেগেছে ৯৩ টাকা ৯০ পয়সা। অগ্রণী ব্যাংক বিক্রি করেছে ৯৩ টাকা ৫০ পয়সায়।
বেসরকারি ইস্টার্ন ব্যাংক থেকে ১ ডলার কিনতে লেগেছে ৯৬ টাকা। প্রাইম ব্যাংক নিয়েছে ৯৫ টাকা।
খোলাবাজারে সোমবার প্রতি ডলার ৯৭ টাকা ৩০ পয়সা থেকে ৫০ পয়সায় ডলার বিক্রি হয়েছে।
অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংক যে ডলারের একক রেট বেঁধে দিয়েছে, সাধারণ মানুষের তাতে কোনো লাভ হচ্ছে না। তাদের কাছে মর্জি মাফিজ দাম নিচ্ছে ব্যাংকগুলো।
বেশ কিছুদিন ধরেই ডলারের বাজারে অস্থিরতা চলছিল। আমদানি অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় বাজারে ডলারের চাহিদা অনেক বেড়ে গিয়েছিল। চাহিদা মেটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেঁধে দেয়া আন্তব্যাংক দরের চেয়ে অনেক বেশি দামে ডলার কেনাবেচা করছিল। যে ব্যাংকের কাছে বেশি ডলার ছিল তারা চাহিদার সুযোগ নিয়ে অন্য ব্যাংকের কাছে বেশি দামে ডলার বিক্রি করত।
ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাচ্ছে গত কিছুদিন থেকেই। অলঙ্করণ: মামুন হোসাইন/নিউজবাংলা
সে পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের একক দর বেঁধে দেয়ার উদ্যোগ নেয়। বৃহস্পতিবার দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশ (এবিবি) ও বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনকারী ব্যাংকগুলোর সংগঠন বাফেদার সঙ্গে বৈঠক করেন গভর্নর ফজলে কবির।
ওই বৈঠকে ডলারের একক দর নির্ধারণের সিদ্ধান্ত হয়। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে বাফেদাকে একটি প্রস্তাব দিতে বলা হয়। বাফেদা রোববার দুপুরে একটি প্রস্তাবনা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে দেয়।
সেই প্রস্তাব বিচার-বিশ্লেষণ করে সন্ধ্যায় ডলারের একক হার বেঁধে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। বলা হয়, সোমবার থেকে এক ব্যাংক আরেক ব্যাংকের মধ্যে (আন্তব্যাংক লেনদেন) ৮৯ টাকায় ডলার কেনাবেচা করবে। আমদানি ব্যয় পরিশোধে ডলারের সর্বোচ্চ দর হবে ৮৯ টাকা ১৫ পয়সা।
এই একক দর নির্ধারণ করে দেয়ার মাধ্যমে আসলে যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারের বিপরীতে টাকার মান আরেক দফা কমল। এবার এক ধাক্কাতেই ১ টাকা ১০ পয়সা কমিয়ে আন্তব্যাংক লেনদেনে ৮৯ টাকা করা হয়েছে। গত কয়েক দিন আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলার ৮৭ টাকা ৯০ পয়সায় বিক্রি হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে এই হার নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। সোমবার থেকে এ নির্দেশনা মেনে ব্যাংকগুলোকে ডলার কেনাবেচা করছে।’
আন্তব্যাংক দর ৮৭ টাকা ৯০ পয়সা থাকলেও গত কয়েক দিনে অনেক ব্যাংক প্রবাসী ও রপ্তানিকারকদের থেকে ৯৫ টাকা পর্যন্ত দরে ডলার কিনেছে। আর আমদানিকারকদের কাছে তা বিক্রি করেছে ৯৭ টাকা পর্যন্ত দরে। এ ছাড়া খোলা বাজারে ডলারের দর ১০০ টাকা ছাড়িয়ে ১০৪ টাকায় উঠেছিল।
আমদানি অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় বাজারে ডলারের চাহিদা বেড়ে যায়। চাহিদা সংকটে ঊর্ধ্বমুখী ডলারের দামের অস্থিরতা কমাতে বেশ কিছুদিন থেকেই টাকার মান অবমূল্যায়ন করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চলতি মে মাসেই চার দফায় ডলারের দাম বাড়ানো হয়েছে।
মে মাসে প্রথম দফায় দর বাড়ানো হয়েছিল ৯ মে। সেদিন ডলারের বিনিময়মূল্য ২৫ পয়সা বাড়িয়ে ৮৬ টাকা ৭০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়। এর আগে এ বিনিময় হার ছিল ৮৬ টাকা ৪৫ পয়সা।
আর গত ২৩ মে তৃতীয়বারের মতো ডলারের বিপরীতে টাকার দর ৪০ পয়সা বাড়িয়ে আন্তব্যাংক লেনদেনে নির্ধারণ করা হয় ৮৭ টাকা ৯০ পয়সা, যা রোববার পর্যন্ত কার্যকর ছিল।
এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, তিন সপ্তাহেই ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে ২ দশমিক ৬৫ শতাংশ।
আর চলতি বছর ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে সাতবার।
গত জানুয়ারির শুরুতে ডলারের বিনিময়মূল্য ২০ পয়সা বাড়িয়ে ৮৬ টাকা করেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ২৩ মার্চ তা আবার ২০ পয়সা বাড়িয়ে ৮৬ টাকা ২০ পয়সা করা হয়। ২৭ এপ্রিল বাড়ানো হয় আরও ২৫ পয়সা। তখন ১ ডলারের বিনিময়মূল্য দাঁড়ায় ৮৬ টাকা ৪৫ পয়সা।
করোনা মহামারির কারণে গত ২০২০-২১ অর্থবছরজুড়ে আমদানি বেশ কমে গিয়েছিল। তখন প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ে উল্লম্ফন দেখা যায়। সে কারণে বাজারে ডলারের সরবরাহ বেড়ে যায়। সে পরিস্থিতিতে ডলারের দর ধরে রাখতে গত অর্থবছরে রেকর্ড প্রায় ৮ বিলিয়ন (৮০০ কোটি) ডলার কিনেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তারই ধারাবাহিকতায় চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়েও ২০ কোটি ৫০ লাখ ডলার কেনা হয়।
কিন্তু আগস্ট মাস থেকে দেখা যায় উল্টোচিত্র। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করায় লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে শুরু করে আমদানি। রপ্তানি বাড়লেও কমতে থাকে রেমিট্যান্স। বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভও কমতে থাকে। বাজারে ডলারের চাহিদা বেড়ে যায়; বাড়তে থাকে দাম। বাজার স্থিতিশীল রাখতে আগস্ট থেকে ডলার বিক্রি শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক, যা এখনও অব্যাহত রয়েছে।
সব মিলিয়ে চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের রোববার পর্যন্ত ১১ মাসে (২০২১ সালের ১ জুলাই থেকে ২৬ মে পর্যন্ত) ৫৭০ কোটি (৫.৭০ বিলিয়ন) ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপরও বাজারের অস্থিরতা কমছিল না। একেক ব্যাংক একেক দরে ডলার বিক্রি করছিল।
সে পরিস্থিতিতে বাজারে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতেই ডলারের একক দর নির্ধারণ করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
কিন্তু চিকিৎসা, শিক্ষাসহ অন্যান্য জরুরি প্রয়োজনে যাদের বিদেশ যেতে হবে তাদের বেশি দামেই ব্যাংক, একচেঞ্জ হাউস অথবা খোলাবাজার থেকে বেশি দামেই ডলার কিনতে হচ্ছে।