প্রতি বছর জাতীয় বাজেটের আগে ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্ট মহলে একটি বিষয় আলোচনায় উঠে আসে। তা হলো নতুন বাজেটেও কালো টাকা (অপ্রদর্শিত আয়) সাদা করার সুযোগ থাকছে কি না।
ব্যতিক্রম নয় এবারও। অবশ্য বিদায়ী অর্থবছরে (২০২১-২২) ‘অতিরিক্ত’ জরিমানা দিয়ে কালো টাকা বৈধ করার সুযোগ দেয়া আছে। আগামী ৩০ জুন এই সুযোগের মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে।
অপ্রদর্শিত আয় বৈধ করার সুযোগটি আসন্ন বাজেটেও থাকছে নাকি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, সে বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি এখনও। তবে এ ক্ষেত্রে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের অবস্থান বিপক্ষে। সে জন্য আসন্ন বাজেটে বিদ্যমান সুযোগটি বহাল রাখার প্রস্তাব করা হচ্ছে না।
এনবিআরের এই অবস্থান সত্ত্বেও এটা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না যে আগামী বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ থাকছে না।
বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে বলেন, এটি একটি রাজনৈতিক ইস্যু। ফলে শেষ মুহূর্তে সরকারের শীর্ষ মহল থেকে এ বিষয়ে যে সিদ্ধান্ত আসবে তা-ই চূড়ান্ত।
সরকারে নীতিনির্ধারক পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এনবিআর এই সুযোগ আর দিতে না চাইলেও অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল তা অব্যাহত রাখার পক্ষে। অর্থমন্ত্রী মনে করেন, দেশ থেকে টাকা পাচার বেড়ে গেছে। এটা বন্ধ করতে হলে অপ্রদর্শিত আয় বৈধ করার সুযোগ দেয়া ছাড়া আপাতত অন্য কোনো বিকল্প নেই।
বিদ্যমান সুযোগটি বহাল থাকলে অন্তত কিছু হলেও দেশ থেকে টাকা পাচার কমবে এবং তা অর্থনীতির মূল স্রোতে ফিরে আসবে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করেই এ বিষয়ে বাজেটে চূড়ান্ত ঘোষণা দিতে পারেন অর্থমন্ত্রী।
এদিকে বারবার কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়ায় সরকারের সমালোচনা করেছেন দেশের শীর্ষ অর্থনীতিবিদরা। তারা বলেন, ‘ন্যায়বিচারের পরিপন্থি এই পদক্ষেপের মাধ্যমে সৎ করদাতাদের প্রতি অবিচার করা হয়। তা ছাড়া সুযোগটা দেয়া হলেও কালো টাকার মালিকদের পক্ষ থেকে তেমন একটা সাড়াও মেলে না।
স্বাধীনতা-পরবর্তী সব সরকারই টাকা বৈধ করার সুযোগ দিয়ে এসেছে। সবশেষ চলতি অর্থবছরে শর্ত সাপেক্ষে এই সুযোগ দেয় আওয়ামী লীগ সরকার।
অপ্রদর্শিত অর্থ বা কালো টাকাকে অর্থনীতির মূল ধারায় আনতে ও দেশে বিনিয়োগ চাঙা করতে চলতি অর্থবছরে শেয়ারবাজার, ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থ, নগদ অর্থ, সঞ্চয়পত্র, জমি ও অ্যাপার্টমেন্ট কিনতে টাকা বৈধ করার সুযোগ দেয়া হয়।
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, কেউ উল্লিখিত খাতগুলোতে প্রযোজ্য হার এবং তার সঙ্গে ‘অতিরিক্ত’ ৫ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার ঘোষণা দিতে পারেন। এ জন্য এনবিআর, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কিংবা সরকারের অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থা তাদের আয়ের উৎস নিয়ে কোনো প্রশ্ন তুলবে না।
আগের অর্থবছরে ওইসব খাতে শুধু ১০ শতাংশ কর দিয়ে ঢালাওভাবে কালো টাকা বৈধ করার সুযোগ দেয়া হয়েছিল। এ কারণে মোটামুটি সাড়াও মিলেছিল। কিন্তু এবার শর্ত কিছুটা কঠোর করায় তেমন সাড়া মেলেনি।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও আইএমএফের সাবেক কর্মকর্তা ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘আমি আগেই বলেছি কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিয়ে অন্যায় করছে সরকার। তা ছাড়া যে উদ্দেশ্যে সরকার এই সুযোগটা দেয় তা অর্জিত হয় না। এটি দেয়ার ফলে লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হয়।’
এনবিআরের সবশেষ পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরে শেয়ারবাজার, নগদ টাকাসহ বিভিন্ন খাতে সরকার যে সুযোগ দিয়েছে তাতে কালো টাকার মালিকদের পক্ষ থেকে কম সংখ্যায়ই আগ্রহ মিলেছে।
চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আট মাসে মাত্র ২ হাজার ৩১৩ জন ঘোষণা দিয়ে টাকা সাদা করার সুযোগ নেন। এর বিপরীতে সরকার কর পেয়েছে মাত্র ৯৫ কোটি টাকা।
গত অর্থবছরে ১২ হাজারের বেশি মানুষ এই সুযোগ নিয়েছিল। বিপরীতে সরকার প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা কর পায়।
এবার সাড়া কম কেন- এমন প্রশ্নের জবাবে এনবিআরের বেশ কজন কর্মকর্তা বলেন, কঠোর শর্ত। কর হার অত্যন্ত বেশি। এতে বেশি করারোপের কারণে আগ্রহ দেখাচ্ছে না সংশ্লিষ্টরা। কালো টাকা সাদা করতে হলে এখনকার নিয়মে একজন করদাতাকে সর্বোচ্চ ২৭ শতাংশ পর্যন্ত কর দিতে হয়। এত বেশি কর দিয়ে টাকা বৈধ করতে অনেকেই নিরুৎসাহিত হচ্ছেন।
এনবিআরের হালনাগাদ পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চলতি বছরের ৮ মাসে সবচেয়ে বেশি টাকা সাদা হয়েছে নগদ অর্থ, ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থ ও সঞ্চয়পত্রে। ২ হাজার ২৫৮ জন করদাতা এসব খাতে টাকা বৈধ করার ঘোষণা দেন। কর আহরণ হয় প্রায় ৯৩ কোটি টাকা।
কালো টাকার মালিকদের পক্ষ থেকে এবার শেয়ারবাজারেও তেমন একটা সাড়া মেলেনি। চলতি অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মাত্র ৪৬ জন শেয়ার, ডিবেঞ্চার ও সরকার অনুমোদিত সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ করেছেন। এ থেকে কর আহরণ হয় ২ কোটি ৭০ লাখ টাকা।
গত বছর ২৮৬ জন শেয়ারবাজারে টাকা সাদা করেছিলেন। এর বিপরীতে কর আহরণ হয় ৪০ কোটি টাকা।
করোনা মহামারির কারণে বেসরকারি বিনিয়োগ চাঙা করতে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে এবারের বাজেটে। বলা হয়েছে, উৎপাদনমুখী যেকোনো শিল্প খাতে নতুন করে বিনিয়োগ করলে তার আয়ের উৎস সম্পর্কে জানতে চাওয়া হবে না। কিন্তু তেমন আগ্রহ দেখা যায়নি। হালনাগাদ পরিসংখ্যানে দেখা যায়, মাত্র ৯ জন উদ্যোক্তা এতে সাড়া দেন।
এনবিআরের সাবেক সদস্য আমিনুর রহমান বলেন, ‘বর্তমান আইনে ভলান্টারি ডিসক্লোজার বা স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে কালো টাকা বৈধ করার যে সুযোগ আছে, এটি প্রায় অকার্যকর। নতুন নিয়মে যে সুযোগ দেয়া হয়েছে তা-ও একই ধরনের। এতেও তেমন সাড়া মেলেনি।’
এবারের বাজেটের বাইরে আরও তিনটি খাতে আগে থেকেই কালো টাকা বৈধ করার সুযোগ বহাল রয়েছে। ১০ শতাংশ কর দিয়ে হাইটেক পার্কে বিনিয়োগ করলে আয়ের উৎস সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন করা হবে না। রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে বিনিয়োগেও একই সুবিধা দেয়া আছে।
এ ছাড়া সিটি ও পৌর করপোরেশনের মধ্যে এলাকাভেদে ফ্ল্যাটে প্রতি বর্গমিটারে নির্ধারিত কর দিয়ে টাকা বৈধ করা যায়। আর স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে জরিমানা দিয়ে টাকা সাদা করার স্থায়ী সুযোগ অনেক আগে থেকেই দেয়া আছে।