গম আমদানিতে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। প্রতি বছর চাহিদা পূরণে প্রয়োজনীয় গমের ৮৫ শতাংশই আমদানি করা হয়, যার ৬৮ শতাংশ এতদিন আমদানি হতো রাশিয়া-ইউক্রেন ও কানাডা থেকে।
ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে অতিসম্প্রতি বাংলাদেশের এই নিত্যপণ্যটি আমদানির বড় উৎসে পরিণত হয়েছে ভারত। যুদ্ধের কারণে গমের আন্তর্জাতিক বাজার রাতারাতি পাল্টে গেছে। একই কারণে কানাডা থেকে গম আমদানিও অনিশ্চয়তায় পড়েছে। এসব কারণে মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে একক দেশ হিসেবে ভারত থেকে বাংলাদেশের গম আমদানির অংশ দাঁড়িয়েছে ৬৩ শতাংশে। চলতি অর্থবছরের ১ মার্চ পর্যন্ত ২৭ লাখ ১৫ হাজার টন গম আমদানি হয়েছে শুধু ভারত থেকে।
ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্য অধিদপ্তর থেকে গম রপ্তানিতে বিশ্বজুড়ে যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে, তার প্রভাব বাংলাদেশে পড়তে বাধ্য। কারণ এর মাধ্যমে আমদানির বড় উৎস বন্ধ হয়ে গেল।
গত শুক্রবার ভারত এই নিষেধাজ্ঞা জারির পর শনিবারই বাংলাদেশের গমের পাইকারি বড় বাজার খাতুনগঞ্জে বেড়ে গেছে গমের মণপ্রতি দাম। এই বাজারে বৃহস্পতিবার ভারতীয় গমের দাম ছিল ১ হাজার ৪০০ টাকা, কানাডার গমের দাম ছিল ১ হাজার ৯৫০ টাকা। শনিবার থেকে সেই ভারতীয় গম ১ হাজার ৫৫০ টাকা এবং কানাডার গম ২ হাজার ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অফ বাংলাদেশ চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সিনিয়র সহসভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু এ প্রসঙ্গে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সাম্প্রতিককালে বিশ্ববাজার পরিস্থিতি খুবই ঘোলাটে অবস্থায় রয়েছে। ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে এই বাজারগুলো থেকে এখন গম আমদানি বন্ধ রয়েছে। এ অবস্থায় বিকল্প বাজার হয়ে ওঠা ভারত যদি পণ্যটি রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয়, তার একটা মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট খাতের ব্যবসায় তো আছেই।
‘কিন্তু তার মানে এই নয় যে শুক্রবার নিষেধাজ্ঞা দিল আর শনিবার থেকেই দেশে দাম বেড়ে যাবে। এটা কোনোভাবেই নৈতিক নয় এবং কেউ সমর্থনও করবে না। দেশে যেটা হয়ে থাকে তা হলো কিছু ব্যবসায়ীর অতি লোভ-লালসার প্রভাব, যারা কোনো একটি ইস্যুকে পুঁজি করে স্বল্প সময়ের মধ্যে বাড়তি ফায়দা লোটার চেষ্টা করে।’
তিনি এ বিষয়ে সরকারকে পরামর্শ দিয়ে বলেন, এই রপ্তানি বন্ধের সুযোগ নিয়ে বাজার পরিস্থিতি যাতে ঘোলাটে না হয়, সে জন্য আগে থেকেই সরকারের সতর্ক থাকা উচিত।
এফবিসিসিআই সহসভাপতি বলেন, ‘ভারত বেসরকারি খাতের জন্য রপ্তানি বন্ধ করলেও সেখানে সরকারিভাবে আমদানির সুযোগ এখনও রয়েছে। সরকারকে অতিসত্বর ভারত সরকারের সঙ্গে কথা বলে এই জি-টু-জি পর্যায়ে গম কেনার সুযোগটি নিতে হবে। পাশাপাশি বেসরকারিভাবেও যাতে গম আমদানি করা যায় তার অনুরোধ করতে হবে।’
এ বিষয়ে সরকারের পদক্ষেপ জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ভারত থেকে জি-টু-জি পর্যায়ে বাংলাদেশ গম আমদানির সুযোগ তো আছেই। গম তো আমাদের প্রয়োজন। এখন এই উদ্যোগটি খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে আসতে হবে। তারা আগ্রহ দেখালে বা চাহিদাপত্র দিলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে সেই অনুযায়ী গম আমদানির পথ সুগম করতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় ভারত সরকারের সঙ্গে সব ধরনের যোগাযোগ করতে প্রস্তুত।’
তিনি জানান, দেশে পর্যাপ্ত গম আমদানি হয়েছে। ভারত ছাড়াও আরও অনেক দেশ থেকে আমদানির সুযোগ রয়েছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, প্রতি বছর দেশে গমের চাহিদা আছে ৭৫ লাখ টনের। এ হিসাবে দৈনিক ২০ হাজার ৫৪৭ টন গম বা গমের আটা-ময়দার প্রয়োজন হয়। দেশে প্রতি বছর গড়ে উৎপাদন হয় ১১ লাখ টন গম।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, ২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ের তুলনায় চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের একই সময়ে গম আমদানির পরিমাণ অনেক বেড়েছে, দামের দিক থেকে যা ৩৫ কোটি ৩৯ লাখ মার্কিন ডলার বেশি। এটা শুধু তবে গম আমদানির পরিমাণ বাড়ার কারণে ঘটেনি, বিশ্ববাজারে গমের বাড়তি মূল্যের কারণেও ঘটেছে।
এদিকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য মতে, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে সরকারি-বেসরকারিভাবে মোট ৫৫ লাখ ৪৬ হাজার টন গম দেশে এসেছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয় ও এনবিআরের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, অভ্যন্তরীণ উৎপাদন আর ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত আমদানিকৃত গম দিয়ে দেশের চলতি অর্থবছরের মে পর্যন্ত চাহিদা পূরণ হওয়ার কথা। গমের সম্ভাব্য ঘাটতি এবং রপ্তানি বন্ধের সুযোগ ইতোমধ্যে ব্যবসায়ীরা নিয়েছেন। সামনে দাম আরও বাড়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ অটো বিস্কুট অ্যান্ড ব্রেড ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. শফিকুর রহমান ভূঁইয়া নিউজবাংলাকে জানান, ‘ভারত থেকে আমদানি করা গম দিয়ে সাধারণত নানান রকম রুটি ও বিস্কুট তৈরি হয়। এই রুটি বিস্কুট মূলত দরিদ্র ও স্বল্প আয়ের মানুষের খাদ্য।
‘এখন ভারত সরকার বেসরকারিভাবে গম রপ্তানি সাময়িক বন্ধ রেখেছে। অথচ দেশে গমের যত প্রয়োজন তার ৯০ ভাগই আমদানি করে বেসরকারি খাত। রপ্তানি বন্ধের প্রভাব দেশেও পড়বে, এটাই স্বাভাবিক। আর গমের দাম বাড়লে শেষ পর্যন্ত সেটার প্রভাব গমনির্ভর পণ্য আটা, ময়দা, রুটি, পরোটা, পাউরুটি, বিস্কুট, কেক, পাস্তা, পিৎজা, নুডলস, বার্গারসহ বিভিন্ন পণ্যে পড়বে, যেমনটি হয়েছিল রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর।’
জানা গেছে, আটা-ময়দা এবং ভোজ্যতেলের দাম বাড়ায় দেশে অনেক আগেই পরোটার দাম দ্বিগুণ হয়ে ১০ টাকা হয়েছে। এ ছাড়া বাজারে আগে ৩২৫ থেকে ৩৫০ গ্রাম ওজনের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের পাউরুটির দাম ছিল ৩৫ টাকা। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর গম রপ্তানি বন্ধ হয়ে গেলে সেই পাউরুটির প্যাকেটের দাম বেড়ে হয়েছে ৪০ টাকা। আনুপাতিক হারে বেড়েছে কেক-বিস্কুটসহ বিভিন্ন ব্র্যান্ডের নুডলসের দামও। একইভাবে ভারতের গম রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্ত দীর্ঘতর হলে তার প্রভাব পর্যায়ক্রমে সবখানেই পড়বে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে খাদ্যসচিব ড. নাজমানারা খানুম নিউজবাংলাকে জানান, বর্তমানে চাহিদা অনুযায়ী গমের কোনো ঘাটতি নেই। এ নিয়ে আতঙ্কিত হওয়া এবং গমনির্ভর পণ্যের দাম বাড়ারও কারণ নেই।
জি-টু-জি উদ্যোগে ভারত থেকে বড় লটে গম আমদানির পরিকল্পনা আছে কি না জানতে চাইলে খাদ্যসচিব বলেন, ‘গম আমদানির জন্য বাংলাদেশ সব ধরনের সুযোগ নিতে চায়। ভারতের বাইরে অন্যান্য দেশ থেকেও গম আনার জন্য মন্ত্রণালয়ের কাজ চলছে। ইতোমধ্যে বুলগেরিয়ার সঙ্গে একটি চুক্তি হয়েছে। অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ইউক্রেন ও রাশিয়াসহ অন্যান্য রপ্তানিকারকদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চলছে। তবে এই পরিস্থিতিতে সরকার জি-টু-জি পর্যায়ে ভারত থেকে আরও গম আমদানির বিষয়েও নতুন করে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। চূড়ান্ত কিছু হলে সেটি আপনারা জানবেন।’
তিনি জানান, চলতি অর্থবছর ১২ মে পর্যন্ত সরকারিভাবে দেশে গম আমদানি হয়েছে ৪ লাখ ৪২ হাজার টন। বেসরকারি খাতে আমদানি হয়েছে ৩০ লাখ টন। সরকার আরও ৩ লাখ টন গম আমদানি করছে, যার প্রথম চালান ১ লাখ টন দুই-এক দিনের মধ্যে বন্দরে ভিড়বে। এ ছাড়া গুদামে মজুত আছে ১ লাখ ১৮ হাজার টন গম।
এর বাইরে বেসরকারিভাবে আমদানি করা ১ লাখ ২৫ হাজার ৩০০ টন গম নিয়ে জাহাজ বন্দরে ভিড়েছে, যা এখন খালাসের অপেক্ষায়। অন্য দিকে চলতি অর্থবছরের ২৩ এপ্রিল পর্যন্ত আরও ৬ লাখ ২৬ হাজার ৩৮০ টন গম আমদানির এলসি খোলা হয়েছে। পাইপলাইনে থাকা এসব গম দ্রুতই দেশে আসবে। এ ছাড়া ইউক্রেন-রাশিয়া ও ভারত ছাড়াও গম আমদানির আরও বাজার আছে। সেইসব দেশ থেকেও বেসরকারিভাবে গম আমদানি হচ্ছে। সব মিলিয়ে মজুত ও পাইপলাইনে থাকা গম দিয়ে আগামী আগস্ট পর্যন্ত চাহিদায় কোনো ঘাটতি হওয়ার কথা নয়।