দেশে ভোজ্যতেলের যে সরবরাহ সংকট দেখা দিয়েছে, তাতে নিজেদের দায় স্বীকার না করে এবার ভর্তুকি মূল্যে স্বল্প আয়ের মানুষদের কাছে তেল বিক্রি করা সরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অফ বাংলাদেশ টিসিবিকে দায়ী করা হলো ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে।
বুধবার এফবিসিসিআই আয়োজিত ভোজ্যতেলের আমদানি, মজুত, সরবরাহ ও মূল্য পরিস্থিতি পর্যালোচনার নিমিত্ত সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের নিয়ে মতবিনিময় সভায় এই মন্তব্য করেন সংগঠনের সভাপতি জসিম উদ্দিন।
রাজধানীর মতিঝিলে সংগঠনের কার্যালয়ে এই মতবিনিময়ে তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে টিসিবি এক কোটি পরিবারের কাছে ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে দুই দফায় দুই লিটার করে মোট চার কোটি লিটার তেল দিয়েছে।
‘সংকটের মুহূর্তে এটা খুবই মানবিক উদ্যোগ। আমরা এর জন্য সাধুবাদ জানাই। কিন্তু টিসিবির এই উদ্যোগ আরও এক-দেড় বছর আগে থেকে প্ল্যান প্রোগ্রাম করার প্রয়োজন ছিল। তারা স্থানীয় বাজার থেকেই চার কোটি লিটার তেল কিনেছে। এর ফলে বাজারে ভোজ্যতেলের একটি ঘাটতি তৈরি হয়েছে।’
এফবিসিসিআই প্রধান দাবি করেন, টিসিবি স্থানীয় বাজার থেকে তেল না কিনে যদি বিশ্ববাজার থেকে আমদানির মাধ্যমে কিনে আনত, তাহলে বাজার পরিস্থিতি এর চেয়ে ভালো রাখা সম্ভব হতো।
ভবিষ্যতে এ ধরনের পদক্ষেপ অব্যাহত রাখলে টিসিবির নিজস্ব বিক্রি কার্যক্রমের পণ্যগুলো আমদানির মাধ্যমে কিনে গুদামে মজুত রাখার পরামর্শ দেন জমিস উদ্দিন।
তবে বাজারে বিক্রির জন্য ছাড়া তেল গ্রাহকদের না দিয়ে বেশি দামে বিক্রির জন্য লুকিয়ে রাখার যে ঘটনায় তোলপাড় এখন দেশজুড়ে, সে বিষয়ে কিছুই বলেননি এফবিসিসিআই প্রধান।
গত মার্চে তেলের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব সরকার ফিরিয়ে দেয়ার পর বাজারে সরবরাহ কমে গিয়েছিল। পরে সরকার তেলের ওপর থেকে কর ও ভ্যাট কমিয়ে দেয়ার পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়।
তবে ঈদের আগে সংকট চরম আকার ধারণ করে। বাজার থেকে সয়াবিন তেল পুরোপুরি উধাও হয়ে যায়। ঈদের ছুটি শেষে বোতলজাত তেলের লিটার ৩৮ টাকা আর খোলা সয়াবিন তেলের লিটার ৪৪ টাকা বাড়ানোর পর প্রমাণ হয়, দাম বাড়বে এই আভাস পেয়ে লাখ লাখ লিটার তেল বিক্রি না করে মজুত করে রাখেন খুচরা পর্যায়ের ব্যবসায়ী ও ডিলাররা।
কয়েক দিনে ধরে প্রতিদিনই বিভিন্ন জেলায় অভিযান চালিয়ে লুকিয়ে রাখা হাজার হাজার লিটার তেল খুঁজে বের করে বিক্রি করার ব্যবস্থা করছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। ব্যবসায়ীদের করা হচ্ছে জরিমানা।
মতবিনিময় সভায় ভোজ্যতেল বাজারজাতকারী টিকে গ্রুপের পরিচালক শফিউল আতাহার তাসলিম বলেন, ‘ভবিষ্যতে ভোজ্যতেলের সংকট এড়াতে মিলমালিকরা যত আমদানি করেন, তার অন্তত ২০ শতাংশ টিসিবির মাধ্যমে আমদানি করা উচিত।’
পাম তেলের সংকট এড়াতে সরকার টু সরকার পদ্ধতিতে ইন্দোনেশিয়া বা মালয়েশিয়া থেকে চার থেকে পাঁচ লাখ টন পাম তেল আমদানি করার পরামর্শও দেন তিনি। বলেন, আপৎকালীন সময়ে এই তেল বাজারে ছাড়া যেতে পারে।
অবশ্য পাম তেলের অন্যতম প্রধান রপ্তানিকারক ইন্দোনেশিয়া নিজ দেশে সরবরাহ ঠিক রাখতে তেল রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ভোজ্যতেল কোনো নিয়ন্ত্রিত পণ্য নয় জানিয়ে টিকে গ্রুপের পরিচালক বলেন, ‘যে কেউ চাইলেই তা আমদানি করতে পারেন। তাহলে কেউ যদি মনে করেন মিলমালিকদের কাছে ভোক্তারা জিম্মি, এতে করে মিলগুলোর ওপর নির্ভরশীলতা অনেকটা কমে আসবে।’
পাইকার, ডিলার, খুচরা পর্যায়ের বিক্রেতা কে কত মজুত কতদিন ধরে রাখতে পারবেন সে বিষয়েও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা চাইছেন শফিউল আতাহার। বলেন, কয়েকটি পদক্ষেপ নিলে ভবিষ্যতে ভোজ্যতেলের বাজার স্বাভাবিক হয়ে আসবে বলে মনে করেন তিনি।
সিটি গ্রুপের উপদেষ্টা অমিতাভ চক্রবর্তী বলেন, টিসিবির কার্যক্রম সচল রাখতে সিটি গ্রুপ একাই ৪৫ লাখ লিটার তেল সরবরাহ করেছে।
করোনা পরিস্থিতির পর বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্যের সরবরাহে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এতে বেড়ে গেছে দাম। চলমান ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটাচ্ছে।
এক বছরের ব্যবধানে আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গেছে। দেশের বাজারেও তা হয়েছে। বোতলজাত সয়াবিন তেলের লিটার সরকার নির্ধারণ করে দিয়েছে ১৯৮ টাকা। এই দর প্রতিবেশী যেকোনো দেশের তুলনায় অবশ্য কম।