ঈদের অবসর শেষে দুই দিনে পুঁজিবাজারে সূচক যতটা বেড়েছিল, তৃতীয় দিনে তার ৬০ শতাংশ কমে গিয়ে উদ্বেগে রাখা পুঁজিবাজার চতুর্থ কর্মদিবসে এতে দেখাল আরও ভয়।
বুধবার লেনদেন শুরুর সোয়া এক ঘণ্টা পর্যন্ত সূচক বেড়ে লেনদেন হতে থাকলেও এরপর তা টানা নিচে নেমে আসে। ৭৩ পয়েন্ট দরপতনে লেনদেন কমে ১০০ কোটি টাকার বেশি।
পুঁজিবাজার-সংশ্লিষ্ট একজন শীর্ষ কর্মকর্তার ধারণা, শ্রীলঙ্কায় অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব পড়েছে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে। বাংলাদেশের অর্থনীতিও বিপাকে পড়বে বলে সামাজিকমাধ্যমে যেসব অপপ্রচার চলছে, তার প্রভাব পড়েছে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে।
রোজার মতোই এক দিনে তিন শতাধিক শেয়ারের দরপতনের স্মৃতিও ফিরে এসেছে। একগুচ্ছ কোম্পানি দরপতনের সর্বোচ্চ সীমার কাছাকাছিতে নেমে লেনদেনের বিষয়টিও দেখা গেল বেশ কিছুদিন পর।
দিন শেষে ৩৫টি কোম্পানির শেয়ারের দর বৃদ্ধির বিপরীতে কমেছে ৩২৩টির দর। অপরিবর্তিত থাকে ২১টির।
একটি কোম্পানির দরও দিনের দর বৃদ্ধির সর্বোচ্চ সীমা ছুঁতে পারেনি, যে চিত্রটি দেখা গেছে রোজার শুরু থেকে শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত। সবচেয়ে বেশি দর বৃ্দ্ধি পাওয়া কোম্পানির শেয়ারে যোগ হয়েছে ৬.৯৬ শতাংশ।
বিপরীতে দরপতনের সর্বোচ্চ সীমা ছুঁয়ে বা কাছাকাছি পতন হয়েছে ২০টির মতো কোম্পানির। আর একটি কোম্পানির লভ্যাংশ সংক্রান্ত কারণে মূল্যসীমা না থাকায় একটি কোম্পানির দর কমেছে ৬.৩৭ শতাংশ।
ঢালাও পতনের দিন এমন কোনো খাত ছিল না যে খাতের বিনিয়োগকারীরা কিছুটা হলেও স্বস্তিতে থাকবে। বস্ত্র খাতে ৫৪টি কোম্পানির দরপতনের বিপরীতে বেড়েছে কেবল তিনটির, সাধারণ বিমা খাতের ৩৭টি কোম্পানির দর পতনের বিপরীতেও তিনটির, প্রকৌশল খাতে ৩৮টি কোম্পানির দরপতনের বিপরীতে কেবল দুটির, ব্যাংক খাতের ২৩টির দর পতনের বিপরীতে দুটির দর বেড়েছে।
বুধবার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সূচক টানা পড়েছে বেলা সোয়া ১১টা থেকে
ডিএসই ব্রোকারস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি রিচার্ড ডি রোজারিও মনে করেন, শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি ধসে যাওয়ার পর সামাজিক মাধ্যমে বাংলাদেশ নিয়ে যেসব লেখালেখি হচ্ছে, তার প্রভাব পড়েছে পুঁজিবাজারে।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘অনেক ক্ষেত্রে যা হচ্ছে তার চাইতেও বেশি লেখালেখি হচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় বিভিন্ন নেতিবাচক লেখালেখি হচ্ছে, শেয়ারিং হচ্ছে। বিষয়টা মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে গেছে। অনেকেই আতঙ্কিত হচ্ছেন। এটা বাজারে একটা প্রভাব ফেলেছে বা ফেলছে।’
শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করার পর দেশটিতে অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়েছে। পদত্যাগী সরকারের মন্ত্রী, সংসদ সদস্যদের ওপর হামলা চলছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির সঙ্গে শ্রীলঙ্কার কোনো তুলনাই চলে না- বলছেন অর্থনীতিবিদরা। এমনকি দাতা সংস্থা এডিবিও বলেছে, করোনার প্রভাব কাটিয়ে বিশ্বে যে কয়টি অর্থনীতি সবচেয়ে ভালো করেছে, বাংলাদেশ তার মধ্যে একটি।
পতন চলছে ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকেই
গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে সংশোধনে যাওয়া পুঁজিবাজারে ফেব্রুয়ারির চতুর্থ সপ্তাহে ইউক্রেনে রুশ হামলার পর নামে ধস। সে সময় ধস ঠেকাতে নানা পদক্ষেপ ব্যর্থ হওয়ার পর রোজার শেষ সপ্তাহ থেকে আবার ধীরে ধীরে লেনদেন বাড়তে থাকে। ক্রয়চাপ বাড়ার পর শেয়ারদর ও সূচক ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে।
ঈদের সব অবসর শেষে চলতি সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবসে লেনদেন হাজার কোটি টাকা ছুঁই ছুঁই হওয়ার পরের দুই দিনে তা এক হাজার ২০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়।
তবে মঙ্গলবার শেষ সোয়া এক ঘণ্টায় হঠাৎ করেই পুঁজিবাজারের সূচক নিচে নেমে আসে দ্রুত। পরে জানা যায়, বিনিয়োগকারীদের মধ্যে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে যে, এক দিনে দরপতনের সর্বোচ্চ সীমা ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে আবার ১০ শতাংশ করা হচ্ছে।
তবে ডিবিএ সভাপতি রিচার্ড ডি রোজারিও জানান, তারা এমন কোনো ইঙ্গিত পাননি। তিনি বলেন, 'এটা নিয়ে কোনো আলোচনা নেই। না ব্রোকারদের মধ্যে, না বিনিয়োগকারীদের মধ্যে। এমনকি নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষ থেকে এমন কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি। আলোচনা নেই, এটা বাজারে প্রভাব ফেলছে না, এই মুহূর্তে।’
বুধবারও শুরুতে সূচক বেড়েই লেনদেন হচ্ছিল। বেলা ১১টা ১৭ মিনিটেও সূচক আগের দিনের চেয়ে ১১ পয়েন্ট বেশিতে লেনদেন হচ্ছিল। এরপর শুরু হয় আগের দিনের মতো পতন। এই অবস্থান থেকে বেলা সোয়া ২টা পর্যন্ত টানা পতন হয়। সে সময় আগের দিনের চেয়ে ৮০ পয়েন্ট, আর দিনের সর্বোচ্চ অবস্থান থেকে ৯১ পয়েন্ট কমে লেনদেন হতে থাকে।
শেষ ১৫ মিনিটে সেখান থেকে সূচক কিছুটা বাড়লেও দিন শেষে ৭৩ পয়েন্ট হারিয়ে বিনিয়োগকারীদের আবার হতাশায় ফেলে পুঁজিবাজার।
দিন শেষে লেনদেন হয়েছে এক হাজার ১৩৫ কোটি ৭০ লাখ ৮৭ হাজার টাকা। আগের দিন হাতবদল হয়েছিল এক হাজার ২৫৮ লাখ ৫৮ হাজার টাকা, যা ছিল গত ১৩ ফেব্রুয়ারির পর সর্বোচ্চ।
লেনদেন কমলেও টানা তিন দিন হাজার কোটি টাকার বেশি লেনদেন গত ১৬ ফেব্রুয়ারির পর প্রথমবারের মতো দেখল দেশের পুঁজিবাজার।
পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান এক্সপো ট্রেডার্সের সিইও শহিদুল হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বাজারে অস্বাভাবিক কিছু ঘটেনি। মার্চেন্ট ব্যাংকসহ কিছু প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী শেয়ার কিনেছিল। কিছু প্রফিট হয়েছে, প্রফিট টেকিংয়ের কারণে কিছুটা ডাউন।’
তিনি বলেন, ‘লক্ষ করে দেখবেন যে বাজারে টার্নওভার ভালো রয়েছে। লেনদেন ভালো রয়েছে বলে আশঙ্কার কিছু নেই। বিনিয়োগ হচ্ছে, প্রফিট টেকিং হচ্ছে। সহজ সমীকরণ।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি ব্রোকারেজ হাউসের শীর্ষ কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বাজারে স্থিতিশীলতা এসেছে, এটা বলা যায় না। কিছু প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের দিয়ে শেয়ার কেনানো হচ্ছে, যার কারণে টার্নওভার ভালো।
‘এই দামেই কিছুদিন বেচাকেনা হবে। এই হাত, ওই হাত ঘুরবে। বাজারে আসলে গতি ফিরবে কি না সেটা আলাদা বিষয়, সময়ই বলে দেবে।’
ডিএসই ব্রোকারস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি রিচার্ড ডি রোজারিও বলেন, ‘মার্কেট খারাপ হলেই মানুষ কারণ খোঁজা শুরু করে। গত দুই দিন যে ভালো ছিল, কেউ কিন্তু জানতে চায়নি যে কেন ভালো হলো? একটু খারাপ হলেই জানতে চায় সবাই।
‘বাজার ডিমান্ড অ্যান্ড সাপ্লাইয়ের ওপর চলে। সাপ্লাই বা সেলার বেশি। মার্চেন্ট ব্যাংক বা অন্য যে কেউই হোক, তার ক্যাপাসিটির বেশি তো কিনতে পারবে না।’
সূচকের বড় পতনে যেসব কোম্পানি
গ্রামীণ ফোনের ১.০৭ শতাংশ দর পতনের কারণে সূচক পড়েছে সবচেয়ে বেশি ৭.৫১ পয়েন্ট। রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান আইসিবির ৩.১৬ শতাংশ দরপতন সূচক কমিয়েছে ৪.৩৫ পয়েন্ট।
এছাড়া রবি ৪.২৯ পয়েন্ট, স্কয়ার ফার্মা ২.৯ পয়েন্ট, ইউনাইটেড পাওয়ার ২.১৮ পয়েন্ট, লাফার্জ হোলসিম সিমেন্ট ২.০৯ পয়েন্ট, ইউনিক হোটেল ১.৭৩ পয়েন্ট, বেক্সিমকো ফার্মা ১.৬১ পয়েন্ট, আর এ কে সিরামিকস ১.২৬ পয়েন্ট এবং এসিআই লিমিটেড সূচক ফেলেছে ১.২২ পয়েন্ট।
সব মিলিয়ে কেবল ১০টি কোম্পনিই সূচক ফেলেছে ২৯ পয়েন্ট।
অন্যদিকে সূচকে সবচেয়ে বেশি পয়েন্ট যোগ করা ১০টি কোম্পানি মিলিয়েও যোগ করতে পারেনি ১০ পয়েন্ট।
এর মধ্যে বেক্সিমকো লিমিটেড একাই যোগ করেছে ২.৫৮ পয়েন্ট। দ্বিতীয় স্থানে থাকা ওয়ালটন ২.২৮ পয়েন্ট আর তৃতীয় অবস্থানে থাকা এসিআই ফর্মুলা যোগ করেছে ১.০৩ পয়েন্ট।
এর বাইরে কোনো কোম্পানিই এক পয়েন্ট যোগ করতে পারেনি। ওপরের তিনটি এবং ম্যারিকো, বিডি ফাইন্যান্স, ট্রাস্ট ব্যাংক, যমুনা অয়েল, আরডি ফুড, বার্জার পেইন্টস ও সিভিও পেট্রো ক্যামিকেলস মিলিয়ে যোগ করতে পেরেছে ৯.৮৯ পয়েন্ট।
দর বৃদ্ধির শীর্ষ দশ
এই তালিকার শীর্ষে থাকা বিডি ফাইনান্সের শেয়ারদরে যোগ হয়েছে ৬.৯৬ শতাংশ। আগের দিন দর ছিল ৪৩ টাকা ১০ পয়সা। সেটি বেড়ে হয়েছে ৪৬ টাকা ১০ পয়সা।
দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা ইমাম বাটনের শেয়ারদরে যোগ হয়েছে ৬.৯৫ পয়েন্ট। এই কোম্পানিটির শেয়ারদর টানা তিন দিন পাঁচ শতাংশ বা কাছাকাছি দর কমেছিল।
তৃতীয় অবস্থানে থাকা এসিআই ফর্মুলেশনের দর বেড়েছে ৬.৫ পয়েন্ট। দিনের শুরুতে বেড়েছিল ১০ শতাংশের মতো। আগের দুই দিন কোম্পানটির দর ২০ শতাংশের বেশি বেড়েছিল।
চতুর্থ অবস্থানে থাকা আরডি ফুডের দর ৪.৭৫ শতাংশ বেড়েছে। আগের দিন দর ছিল ৫৬ টাকা ৮০ পয়সা। সেটি বেড়ে হয়েছে ৫৯ টাকা ৫০ পয়সা।
এছাড়া বঙ্গজের দর ৩.২০ শতাংশ, সিভিও পেট্রো ক্যামিকেলের দর ২.৯২ শতাংশ, পদ্মা লাইফের দর ২.০৩ শতাংশ, জিকিউ বলপেনের দর ১.৯৬ শতাংশ, ডেফোডিলস কম্পিউটারের দর ১.৭৩ শতাংশ এবং আমান ফিডের দর বেড়েছে ১.৬৭ শতাংশ।
দর পতনের শীর্ষ দশে যেসব কোম্পানি
এক দিনে দরপতনের সর্বোচ্চ সীমা ৫ শতাংশ হলেও এশিয়া ইন্স্যুরেন্সের দর এরচেয়ে বেশি কমতে পেরেছে এর লভ্যাংশ সংক্রান্ত ঘোষণার কারণে কোম্পানিটি শেয়ার প্রতি দেড় টাকা লভ্যাংশ ঘোষণার পর এর লেনদেনে কোনো মূল্যসীমা ছিল না।
এই লভ্যাংশ বিনিয়োগকারীদের মনঃপুত না হওয়ার পর দর কমেছে ৬.৩৭ শতাংশ। আগের দিন লেনদেন হয়েছিল ৭২ টাকা ২০ পয়সায়, সেটি নেমে এসেছে ৬৭ টাকা ৬০ পয়সা।
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির পর উড়তে থাকা জেএমআই হসপিটালের দর কমেছে ৫ শতাংশ। টানা বাড়তে থাকা কোম্পানিটির দর আগেরদিনও প্রায় সম হারে কমেছিল।
এছাড়া জেমিনি সি ফুডের দর ৪.৯৮ শতাংশ, পেপার প্রসেসিংয়ের দর ৪.৯৬ শতাংশ, মনস্পুল পেপারের দর ৪.৯৫ শতাংশ, প্রগতি ইন্স্যুরেন্সের দর ৪.৯৪ শতাংশ, জিলবাংলা সুগারের দর ৪.৯২ শতাংশ, ইউনিক হোটেলের দর ৪.৮৫ শতাংশ, তমিজউদ্দিন টেক্সটাইলের দর ৪.৭৭ শতাংশ, ইস্টার্ন হাউজিংংয়ের দর ৪.৭২ শতাংশ, কমেছে।
আরও ২৩টির দর ৪ শতাংশের বেশি, ৫০টির দর ৩ শতাংশের বেশি এবং ৯৬টির দর কমেছে ২ শতাংশের বেশি।