দেশে যত সরিষা উৎপাদিত হয়, তার পুরোটাই তেল হয়ে বাজারে আসে না। বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ক্রপস উইং শাখার তথ্য অনুযায়ী, বছরওয়ারি ফলন যাই হোক, বীজ সংরক্ষণসহ সরিষার অন্যান্য ব্যবহার বাদ দিয়ে প্রতি বছর গড়ে ৫ লাখ টন সরিষা ব্যবহার হয় তেল উৎপাদনে।
বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিনা) উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগের তথ্য বলছে, সরিষা বীজে সাধারণত ৪০ থেকে সর্বোচ্চ ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত তেল থাকে। এ হিসাবে এক কেজি সরিষা থেকে পাওয়া যায় ৪০০ গ্রাম তেল। ৪০ কেজি বা এক মণ সরিষা থেকে তেল মেলে ১৬ কেজি।
অর্থাৎ প্রতি বছর ৫ লাখ টন সরিষা থেকে গড়ে ২ লাখ টন তেল পাওয়া যায়। বিপরীতে সারা বছর দেশে ভোজ্যতেলের চাহিদা ২০ লাখ টন।
ঘাটতি পূরণে সয়াবিনের বিকল্প হিসেবে ভোক্তারা যদি তাদের রান্নার পুরো চাহিদা সরিষা তেল দিয়ে মেটাতে চায়, তাহলে এখন উৎপাদিত সরিষা তেল দিয়ে মাত্র ৩৭ দিনের চাহিদা মিটতে পারে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে ৫ লাখ ৮৮ হাজার ৭৩৭ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষ হয়েছে। হেক্টরে ১.৩৬ টন গড় ফলন হিসাবে ৭ লাখ ৯৯ হাজার ৮৪১ টন সরিষা উৎপন্ন হয়।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, বিশ্বে যত তেল ব্যবহার হয়, তার ৬০ শতাংশের জোগান দেয় সয়াবিন, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি করোনা এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে এখন সয়াবিনের সরবরাহে মারাত্মক টান পড়েছে।
দেশে দৈনিক ভোজ্যতেলের চাহিদা ৫ হাজার ৪৭৯ টন। এর ৯০ শতাংশের জোগান আসে আমদানীকৃত সয়াবিন থেকে। বাকিটা সরিষা, সানফ্লাওয়ার অয়েল, রাইস ব্র্যান অয়েলসহ অন্যান্য উৎস থেকে আসে। এই বিকল্পগুলো থেকে সম্মিলিতভাবে বছরজুড়ে তেল পাওয়া যায় মাত্র ২ লাখ ৩০ হাজার টন।
কয়েক দশক আগেও দেশে সরিষার তেল ছিল রান্নায় বহুল ব্যবহৃত ভোজ্যতেল। এরপর ধীরে ধীরে সেই রান্নাঘরে দখল নেয় সয়াবিন তেল।
মূলত বড় বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর বাজারনীতি এবং সরিষার তেলের তুলনায় দাম কম হওয়ার কারণে দেশের ৯৫ ভাগ ক্রেতা এখন সয়াবিন তেলের ভোক্তা হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে দাম বেশি হওয়ায় সরিষা তেল পরিণত হয়েছে শৌখিন পণ্যে।
কয়েক মাস ধরে আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ বাজারে সয়াবিনের দাম চড়ছে। সেই সঙ্গে দেখা দিয়েছে সরবরাহে ঘাটতি। পরিস্থিতির এতটাই অবনতি ঘটেছে যে, বাড়তি দাম দিয়েও ধারে-কাছে মিলছে না সয়াবিন। এর বিপরীতে পরিমাণে কম হলেও দেশের সর্বত্র মিলছে সরিষার তেল। আবার কাঠের ঘানি বা মেশিনে ভাঙা সরিষার তেল খোলা বিক্রির পাশাপাশি করপোরেট কোম্পানিগুলোর মাধ্যমেও সারা দেশে বাজারজাত হচ্ছে। সুবিধামতো মিলছে ১০০ গ্রাম, ২৫০ গ্রাম, ৫০০ গ্রাম, ১ লিটার ও পাঁচ লিটারের বোতলেও।
এ অবস্থায় অনেক ভোক্তা বিকল্প হিসেবে আবারও সরিষার তেলে ফেরার কথা ভাবছেন, কিন্তু সয়াবিনের তাপ এসে লেগেছে সরিষার তেলের বাজারেও। সেখানেও দামে ঊর্ধ্বগতি। একসঙ্গে অনেক ক্রেতা এই তেল কিনতে শুরু করায় এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর বাজারে ছাড়া আগের সব স্টক ইতোমধ্যে ফুরিয়ে এসেছে। তাদের ঘন ঘন ছাড়তে হচ্ছে নতুন স্টক। আগে কোম্পানিভেদে প্রতি লিটার বোতলজাত সরিষার তেলের দাম রাখা হতো ২৮০ থেকে ২৯০ টাকা। এখন নতুন মূল্য উঠেছে ৩৫০ থেকে ৩৬০ টাকা।
শুধু বড় কোম্পানিই নয়, দাম বেড়েছে স্থানীয়ভাবে ঘানিতে ভাঙা সরিষার তেলেরও।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাজারে সয়াবিনের অস্থিরতা তৈরির আগে প্রতি লিটার খোলা সরিষার তেলের দাম ছিল ১৮০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত। রোজার আগে এ দাম বেড়ে ২২০ থেকে ২৪০ টাকায় গড়ায়।
ঘানি ভাঙা তেল রোজার আগে ছিল ২৬০ থেকে ২৮০ টাকা পর্যন্ত। এখন সয়াবিনের মারাত্মক ঘাটতিতে প্রচণ্ড রকম চাপ পড়েছে সব ধরনের সরিষার তেলের ওপর। এতে করে আরেক দফা দাম বাড়ে ঘানিতে ভাঙা সরিষারও। বর্তমানে এই তেল স্থানভেদে ৩২০ থেকে ৩৬০ টাকায়ও বিক্রি হচ্ছে।
বিক্রেতারা বলছেন, দেশে সয়াবিন তেলের বাজার অস্থির হওয়ার আগে তারা দোকানে সরিষার তেল রাখতেন শৌখিন পণ্য হিসেবে। সাধারণত আচার, চাটনি তৈরিতে এর ব্যবহার হতো। এ ছাড়া ভর্তা খাওয়া বা মুড়ি মাখার জন্য আগ্রহী ক্রেতাই শুধু সরিষার তেল কিনতেন। ফলে সরিষার তেল উৎপাদন এবং সরবরাহ খুব কম হতো।
তারা বলছেন, যেটুকু সরবরাহ থাকত, বাজারে তার স্টক শেষ হতে সপ্তাহ থেকে মাস লেগে যেত। এখন ক্রেতারা আসছেন, সরিষার তেল চাচ্ছেন, কিন্তু স্টক ফুরিয়ে যাওয়ায় কিনতে পারছেন না। অনেকে এখন ঘানিতে ভাঙা তেলের খোঁজ করছেন। বাড়তি চাহিদার কারণে কৃষক পর্যায়েও বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে সরিষার দাম।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মৌসুমের শুরুতেও প্রতি মণ সরিষার দাম ছিল মানভেদে ২ হাজার টাকা থেকে আড়াই হাজার টাকা পর্যন্ত। এখন সেই সরিষা বাজারে বা কৃষক পর্যায়ে বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকায়।
মূলত সরিষার দাম বাড়ায় তেলের দামও বেড়েছে। আবার সরিষা কিনে মিলাররাও তেল বিক্রিতে বাড়তি মুনাফা করার চেষ্টা করছেন। এ কারণেও সরিষার তেলের দাম বেড়েছে।
বাজারে বর্তমানে রাঁধুনি, তীর, ফ্রেশ, সুরেশ, পুষ্টি, রূপচাঁদা ছাড়াও কমপক্ষে ২০টিরও বেশি ব্র্যান্ড ও নন ব্র্যান্ডের সরিষার তেল বিক্রি হচ্ছে।
এ বিষয়ে তীর ব্র্যান্ডের সরিষা তেল বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপের পরিচালক (অর্থ) বিশ্বজিৎ সাহা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বিষয়টি খুব সিম্পল। চাহিদা বাড়লে দাম বাড়বে। এটাই স্বাভাবিক।
‘তেলের কাঁচামাল হলো বীজ, কিন্তু এবার বাড়তি চাহিদার কারণে সরিষার বীজের দামও বেড়েছে। সরিষা কেনায় বেশি খরচ পড়ায় দামও বাড়াতে হয়েছে।’
সরিষা চাষ বাড়ানো সম্ভব?
সরিষা দেশের সর্বত্র চাষ হলেও ঢাকা, টাঙ্গাইল, কুমিল্লা, ফরিদপুর, জামালপুর, কিশোরগঞ্জ, বরিশাল, যশোর, কুষ্টিয়া, দিনাজপুর, পাবনা, রাজশাহী ও রংপুর জেলায় এটি বেশি চাষ হয়।
দেশের তেলবীজ আবাদি জমির প্রায় ৬০ শতাংশ এলাকায় সরিষা চাষ করা হয়। এরপরও ২০১৯ সালে প্রায় দশমিক ৪৬ লাখ টন সরিষা আমদানি করা হয়েছে।
বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা দাবি করেন, এ ভোজ্যতেলের আমদানিনির্ভরতা কমাতে সরিষা আবাদের পরিমাণ বাড়াতে হবে। এ জন্য এখনই প্রয়োজন তেল ফসলের চাষাবাদ বৃদ্ধি করে উৎপাদন বৃদ্ধিতে গুরুত্ব দেয়া।
বিনার উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এবং তেলজাতীয় ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি প্রকল্পের উপপ্রকল্প সমন্বয়ক ড. রেজা মোহাম্মদ ইমনের দাবি, দেশের ২২ লাখ হেক্টর পতিত (দুই ফসলের মাঝের) জমিতে যদি বিনাসরিষা-৪ ও বিনাসরিষা-৯ আবাদ করা যায়, তাহলে বছরে ১৭ হাজার কোটি টাকার তেল আমদানি সাশ্রয় করা সম্ভব।
তিনি আরও মনে করেন, প্রতি বছর ৩ দশমিক ৫ লাখ টন উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হলে ২০৩০ সালে মোট সরিষা উৎপাদন হবে প্রায় ৪৬ দশমিক ৬৩ লাখ টন, যা থেকে প্রায় ১৬ দশমিক ৩২ লাখ টন তেল পাওয়া সম্ভব। এতে ১৭ হাজার কোটি টাকার যে তেল আমদানি করতে হয়, তা আর আমদানি করতে হবে না। এ জন্য অবশ্যই দুই ফসলি জমিকে তিন ফসলি জমিতে রূপান্তর করতে হবে বিনাসরিষার মাধ্যমে।