রমজান মাস জুড়ে দেশে ব্যবসায়ীরা যে দরে ভোজ্যতেল আমদানি করেছিলেন, তার গড় মূল্য সরকার ধরেছিল ১৪৬০ ডলার। এতে প্রতি লিটারে বাজারজাতকারীদের লোকসান হচ্ছিল ৪০ থেকে ৪৫ টাকা। এ লোকসান কমাতে ঈদের পর ৫ মে সেই তেলের গড় আমদানি মূল্য বাড়িয়ে পুনঃনির্ধারণ করা হয় ১৬০৫ ডলার। প্রতিটনে ১৪৫ ডলার দাম বেশি ধরা হয়। এতে ভোজ্যতেলের আমদানিকারক, পরিশোধন ও বাজারজাতকারী কোম্পানিগুলোর লোকসান কমে মুনাফায় ফিরেছে।
সরকার খুচরা বাজারে তেলের বিক্রয়মূল্য নির্ধারণ করে দেয়। এ কারণে দাম হিসাব করার জন্য সরকার আন্তর্জাতিক বাজার থেকে ব্যবসায়ীদের ভোজ্যতেল কেনার বিভিন্ন দরের একটি গড় নির্ধারণ করে সেটাকে আমদানি মূল্য ধরে নিয়ে ভোক্তা পর্যায়ে বিক্রয়মূল্য নির্ধারণ করে।
বিশ্ববাজারে এখন প্রতি টন অপরিশোধিত ভোজ্যতেলের দাম ২০০০ ডলারের বেশি হলেও সরকার সবশেষ গড় আমদানিমূল্য ১৬০৫ ডলার ধরে নিয়েই হিসাব কষেছে। পূর্বাভাস রয়েছে, জুনে বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দাম কমে আসতে পারে।
আন্তর্জাতিক বাজারে দর কমার পূর্বাভাস এবং দেশে দাম বাড়িয়ে সমন্বয়ের কারণে তেলের মজুত ধরে রাখার সুযোগও কমে আসছে। আবার ঈদের ছুটিতে কোম্পানিগুলোর বন্ধ কারখানাও শনিবার থেকে খোলা হয়েছে। রোববার শুরু হয়েছে নতুন বাড়তি দামে সরবরাহের কাজও। এ অবস্থায় বর্তমানে বাজারে ভোজ্যতেলের ঘাটতি দ্রুতই মিটে যাবে। এতে তেল কিনতে ক্রেতাদের আর ঘুরতে হবে না এক দোকান থেকে আরেক দোকানে।
বাড়তি দামে বিক্রির সুযোগ নিতে আমদানিকারক, পরিশোধন কোম্পানি ছাড়াও বিভিন্ন পকেটে থাকা মজুত তেল আবারও সবখানে আগের মতোই দেখা যাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সরকার বৃহস্পতিবার থেকে তেলের নতুন দাম নির্ধারণ করেছে প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন ১৯৮ টাকা, খোলা সয়াবিন ১৮০ টাকা এবং পাম সুপার ১৭২ টাকা। ঘাটতির কারণে বাজারে এর চেয়ে বেশি দামে ভোজ্যতেল বিক্রি হচ্ছিল।
সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন, চলতি সপ্তাহের মধ্যেই ভোজ্যতেলের সরবরাহ সংকট দূর হবে। তখন নির্ধারিত দামেই তেল বিক্রি হবে।
এদিকে লোকসান কমাতে ঈদের দিন পনের আগে থেকেই মিল পর্যায়ে ভোজ্যতেলের সরবরাহে টান পড়ে। এরপর যত দিন গড়ায়, সংকটও তত প্রবল হয়ে ওঠে।
আবার দাম পুনঃনির্ধারণের আগেই বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো লোকসান কমাতে অঘোষিতভাবে বাজারে পণ্যটির দাম বাড়িয়ে দেয়। কৌশল হিসাবে তারা সরবরাহ কমিয়ে দেয়। এর ফলে বোতলজাত তেলের মূল্য ঠিক থাকলেও খোলা তেলের মূল্য লিটার প্রতি ৪০ থেকে ৪৫ টাকা বেড়ে যায়।
বোতলজাত মূল্য কম থাকলেও বিক্রেতারা তা থেকেও দাম বাড়িয়ে বিক্রির সুযোগ নেয়। ফলে ভোজ্যতেলের এই ঘাটতি পরিস্থিতি এবং গচ্চা দিয়েই ক্রেতাদের ঈদের চাহিদা সামলাতে হয়েছে। কিন্তু ঈদের দুই দিন আগে থেকে সেই সরবরাহ একেবারে তলানিতে নেমে আসে। এতে এই নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যটি নিয়ে সারা দেশে সংকট তৈরি হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই সরবরাহ সংকটের নেপথ্যে ছিল ঈদের পর ভোজ্যতেলের দাম সমন্বয়ে সরকারের আগাম ঘোষণা। ব্যবসায়ীরা আগেই জানতেন, ৫ মের পর ভোজ্যতেলের দাম বাড়িয়ে সমন্বয় করা হবে। ফলে রমজানে সরকার নির্ধারিত দামে কোম্পানিগুলো চাহিদা অনুযায়ী তেল সরবরাহ করতে রাজি হয়নি। এতে দৈনিক ৭ হাজার টন চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ আড়াই থেকে ৩ হাজার টনে নেমে আসে।
চাহিদার বাকি তেল সরবরাহ না দিয়ে কোম্পানিগুলো মজুত করতে শুরু করে। আবার যে পরিমাণ সরবরাহ দেয়া হয়, তার থেকে বিক্রি কমিয়ে দেয়া হয় পাইকারি এবং খুচরা পর্যায়েও। আবার দাম বাড়বে এমন আতঙ্কে সামর্থ্যবান অনেক ভোক্তাও বিভিন্ন দোকান ঘুরে চাহিদার অতিরিক্ত পাঁচ লিটার বা ততোধিক ধারণ ক্ষমতার বোতল কিনে রাখে। এতে বাজার থেকে ভোজ্যতেল প্রায় উধাও হয়ে যায়।
সেই পরিস্থিতি ঈদের পর রোববারও স্বাভাবিক হয়নি। বাড়তি দামেও ক্রেতারা তেল কিনতে পারছেন না। দোকানিরা বলছেন, ‘সাপ্লাই নেই’।
বাজারে ভোজ্যতেলের ঘাটতি পরিস্থিতির বিষয়টি সরকারও অবগত। এ অবস্থায় বাজার ব্যবস্থাপনার ঘাটতি দূর করে সরবরাহ চেইনের দ্রুত উন্নতি এবং ভোক্তাপর্যায়ে সেই তেল সরকার নির্ধারিত দামে বিক্রি নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে সরকারের পদক্ষেপ তুলে ধরতে সোমবার ভোজ্যতেল ইস্যুতে সংবাদ সম্মেলন ডেকেছে বাজার নিয়ন্ত্রণকারী বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
সংবাদ সম্মেলনে সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলবেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। ভোজ্যতেলের ঘাটতি পরিস্থিতির বিষয়ে জানতে চাইলে সংবাদ সম্মেলনের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ।
তিনি বলেন, ‘এখন বিস্তারিত কিছু বলছি না। আগামীকাল (সোমবার) সংবাদ সম্মেলনেই সব বলব।’
সরবরাহে ঘাটতি পরিস্থিতির কারণ জানতে চাইলে বাংলাদেশ ভোজ্যতেল পাইকারি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি গোলাম মাওলা বলেন, ‘ঈদের বন্ধ গেছে। তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে বৃহস্পতিবার। সেদিনও ছুটির মধ্যেই ছিল। এরপর শুক্র ও শনিবার ছুটি ছিল। মাল (ভোজ্যতেল) কিনতে হলে তো ব্যাংকের মাধ্যমে টাকাটা দিতে হবে। লেনদেন করতে হবে। সব কিছু বন্ধ থাকলে হঠাৎ মাল আসবে কোত্থেকে? বুঝতে হবে চার-পাঁচজন লোকের হাতে সারা দেশ। মিল থেকে তো আসতে হবে। এর জন্য ধৈর্য্য ধরতে হবে।
‘আজ (রোববার) ব্যাংক ও অফিস-আদালত খুলেছে। আমার মনে হয় দুই-একদিনের মধ্যে তেলের সরবরাহ পরিস্থিতির উন্নতি হবে।’
ভোজ্যতেলের অন্যতম সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান টি কে গ্রুপের পরিচালক (ফাইন্যান্স অ্যান্ড অপারেশন) সফিউল আতাহার তাসলিম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বাজারে এতোদিন আমরা যে তেল সরবরাহ করেছি কিংবা গত দুই-তিন দিন বাজারে যে তেল গেছে, সেগুলো হলো পুরনো অর্থাৎ আগের দামে। বৃহস্পতিবার তেলের দাম বাড়ানো হলেও নতুন দামে সরবরাহ দেয়া সম্ভব হয়নি ঈদের ছুটির কারণে।’
তিনি বলেন, ‘গত শুক্রবার পর্যন্ত আমাদের কারখানা বন্ধ ছিল। শনিবার মাত্র কারখানা খোলা হয়েছে। কারখানা চালুর পর পূর্ণ উৎপাদনে যেতে ৩৫ থেকে ৪৮ ঘণ্টা সময় লাগে। তা ছাড়া এখনও অনেক ডিলার তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলেননি। যদিও রোববার থেকেই নতুন দামে তেল ডেলিভারি দেয়া শুরু হয়েছে। তবে একদিনে তো সরবরাহ পরিস্থিতির উন্নতি হবে না।
‘আমরা আশা করছি, দুই তিন দিনের মধ্যে সারা দেশে ভোজ্যতেলের সরবরাহ পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে।’
অপর বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠান মেঘনা গ্রুপের সিনিয়র সহকারী ব্যবস্থাপক শাহরিয়ার তসলিম বলেন, ‘ভোজ্যতেল নিয়ে অস্থির হওয়ার কোনো কারণ নেই। দুই-একদিনের মধ্যেই বাজারে তেলের সরবরাহ ঘাটতি দূর হয়ে যাবে। দেশে ভোজ্যতেলের পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে। এ তেল তো বাজারেই দিতে হবে। তবে ঈদের ছুটির কারণে সবারই সরবরাহে একটা ঘাটতি হয়েছে।’
তিনি বলেন,‘সবারই তো ঈদ আছে। ঈদের ছুটির কারণে কারখানা বন্ধ ছিল। ব্যাংক বন্ধ ছিল। ডিলার ছিল না। ডিলার থেকে তেল কেনার ক্রেতাও ছিল না। এ কারণে সবারই সরবরাহে একটা টান ছিল। এখন নতুন দামে তেল ছাড়া শুরু হলে দ্রুতই ঘাটতি দূর হবে।’