আমদানিতে জোয়ারের পাশাপাশি বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্য, জ্বালানিসহ সব ধরনের পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে বাণিজ্য ঘাটতি চূড়ায় উঠেছে।
চলতি অর্থবছরের ৯ মাসেই (জুলাই-মার্চ) পণ্য বাণিজ্যে সার্বিক ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৫ বিলিয়ন (২ হাজার ৪৯০ কোটি ৭০ লাখ) ডলার। বর্তমান বিনিময় হার হিসাবে (প্রতি ডলার ৮৬ টাকা ৪৫ পয়সা) টাকার অঙ্কে এই অর্থের পরিমাণ ২ লাখ ১৫ হাজার ৩৪৭ কোটি টাকা।
এই অঙ্ক গত অর্থবছরের পুরো সময়ের (১২ মাস, ২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের জুন) চেয়েও ৯ দশমিক ২৫ শতাংশ বেশি। আর জুলাই-মার্চ সময়ের চেয়ে বেশি প্রায় ৬৪ শতাংশ।
২০২০-২১ অর্থবছরের এই ৯ মাসে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল ১৫ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলার। আর পুরো অর্থবছরে এই ঘাটতি ছিল ২২ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই কোনো বছর বা অর্থবছরে এত বিশাল অঙ্কের বাণিজ্য ঘাটতির মুখে পড়েনি বাংলাদেশ। আর এর ফলে বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যেও (ব্যালান্স অফ পেমেন্ট) বড় ঘাটতিতে পড়েছে বাংলাদেশ।
জুলাই-মার্চ সময়ে এই ঘাটতির পরিমাণ ১৪ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে ১৪ দশমিক শূন্য ৭ বিলিয়ন ডলারে উঠেছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচক মাত্র ৫৫ কোটি ৫০ লাখ ডলারের ঘাটতি ছিল।
পণ্য আমদানি অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় বাণিজ্য ও লেনদেন ভারসাম্যে ঘাটতিতে বাংলাদেশ এই মাইলফলক অতিক্রম করেছে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুর ও মঞ্জুর হোসেন।
তারা বলেছেন, এই মুহূর্তে বাংলাদেশের অর্থনীতির বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে আমদানির লাগাম টেনে ধরা। যে করেই হোক এটা করতে হবে। তা না হলে সংকটে পড়বে অর্থনীতি।
করোনা মহামারি পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর থেকেই আমদানিতে জোয়ার বইছে। আর এতে আমদানি-রপ্তানির মধ্যে ব্যবধান বা বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েই চলেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক রোববার বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায় ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে ৬ হাজার ১৫২ কোটি ৪০ লাখ (৬১.৫২ বিলিয়ন) ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৪৩ দশমিক ৮৬ শতাংশ বেশি। ২০২০-২১ অর্থবছরের এই ৯ মাসে ৪২ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছিল।
অন্যদিকে চলতি অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে ৩৬ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার আয় করেছেন রপ্তানিকারকরা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৩২ দশমিক ৯২ শতাংশ বেশি।
এ হিসাবেই অর্থবছরের ৯ মাসে পণ্য বাণিজ্যে সার্বিক ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২৪ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলার।
সেবা বাণিজ্যে ঘাটতিও বাড়ছে
জুলাই-মার্চ সময়ে সেবা খাতের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৮০ কোটি ৬০ লাখ ডলার। গত বছরের একই সময়ে এই ঘাটতি ছিল ১৯৯ কোটি ২০ লাখ ডলার।
মূলত বিমা, ভ্রমণ ইত্যাদি খাতের আয়-ব্যয় হিসাব করে সেবা খাতের বাণিজ্য ঘাটতি পরিমাপ করা হয়।
লেনদেন ভারসাম্যে ঘাটতি ১৪ বিলিয়ন ডলার ছাড়াল
২০২১-২২ অর্থবছর শুরুই হয়েছিল লেনদেনের ভারসাম্যে ঘাটতি নিয়ে। দিন যত যাচ্ছে, ঘাটতি ততই বাড়ছে। প্রথম তিন মাসে অর্থাৎ জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে এই ঘাটতির পরিমাণ ছিল ২৩১ কোটি ৪০ লাখ (২.৩১ বিলিয়ন) ডলার। চার মাস শেষে (জুলাই-অক্টোবর) তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৭৬ কোটি ৯০ লাখ ডলারে। জুলাই-নভেম্বর সময়ে ঘাটতি ছিল ৬ দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলার।
ডিসেম্বর শেষে তা আরও বেড়ে ৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। জানুয়ারি শেষে ১০ দশমিক শূন্য ১৯ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়।
ফেব্রুয়ারি শেষে তা ১২ দশমিক ৮৩ বিলিয়ন ডলারে ওঠে। সবশেষ মার্চ শেষে ১৪ দশমিক শূন্য ৭ বিলিয়ন ডলারের চূড়ায় উঠেছে। এর আগে কোনো অর্থবছরেও এত বিশাল ঘাটতিতে পড়েনি বাংলাদেশ।
করোনা মহামারির কারণে আমদানি কমায় ৯২৭ কোটি ৪০ লাখ (৯.২৭ বিলিয়ন) ডলারের বড় উদ্বৃত্ত নিয়ে ২০২০-২১ অর্থবছর শেষ হয়েছিল। তার আগের বছরে উদ্বৃত্ত ছিল ৩১৬ কোটি ৯০ লাখ ডলার।
আর্থিক হিসাবে এখনও বড় উদ্বৃত্ত
তবে আর্থিক হিসাবে এখনও বড় উদ্বৃত্ত ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। জুলাই-মার্চ সময়ে এই উদ্বৃত্ত দাঁড়িয়েছে ১১ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন ডলার। গত অর্থবছরের এই সময়ে ৭ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলারের উদ্বৃত্ত ছিল।
করোনার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবিসহ অন্য দাতা দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত ঋণসহায়তা পাওয়ায় আর্থিক হিসাবে উদ্বৃত্ত হয়েছে বলে জানান আহসান মনসুর।
তথ্যে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে ৬ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলারের ঋণসহায়তা পেয়েছে বাংলাদেশ, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৫৫ দশমিক ১৬ শতাংশ বেশি।
২০২০-২১ অর্থবছরের এই ৯ মাসে ৪ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলারের ঋণসহায়তা পেয়েছিল বাংলাদেশ।
তবে জুলাই-মার্চ সময়ে সামগ্রিক লেনেদেনে (ওভারঅল ব্যালান্স) ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার। অথচ গত অর্থবছরের একই সময়ে এই সূচকে ৭ বিলিয়ন ডলার উদ্বৃত্ত ছিল।
রেমিট্যান্স কমেছে ১৭.৭৪ শতাংশ
জুলাই-মার্চ সময়ে ১৫ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। এই অঙ্ক গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১৭ দশমিক ৭৪ শতাংশ কম।
২০২০-২১ অর্থবছরের একই সময়ে ১৮ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স এসেছিল দেশে।
যে কারণে আমদানিতে উল্লম্ফন
করোনার পর সব ধরনের পণ্যের চাহিদা ব্যাপক বেড়েছে। সেই চাহিদার কারণে বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছিল। সবশেষ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পণ্য সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়ায় আরও চড়ছে দাম। পাশাপাশি জাহাজ ভাড়া অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ায় বাড়তি খরচ গুনতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে আমদানি ব্যয় বেড়ে নতুন উচ্চতায় উঠেছে।
গত বছরের এপ্রিলে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি ব্যারেল জ্বালানি তেলের দাম ছিল ৬০ ডলার। রোববার সেই তেল ১১২ ডলারের বেশি দামে বিক্রি হয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের শুরুতে এর দর ১৩৯ ডলারে উঠে গিয়েছিল।
২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে জ্বালানি তেল আমদানিতে খরচ বেড়েছে ৮২ শতাংশ। মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিতে ব্যয় বেড়েছে ৫০ শতাংশ। শিল্পে কাঁচামাল আমদানিতে ব্যয় বেড়েছে ৪৯ শতাংশ। খাদ্যপণ্যের আমদানি ব্যয় বেড়েছে ২৭ দশমিক ৫০ শতাংশ।
মহামারির পর চাহিদা বাড়ায় জ্বালানি তেল ছাড়াও খাদ্যপণ্য (বিশেষ করে গম), ভোজ্যতেল, শিল্প স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় মূলধনি যন্ত্রপাতি (ক্যাপিটাল মেশিনারি), শিল্পের মধ্যবর্তী কাঁচামালসহ সব ধরনের জিনিসের দামই বেড়েছে।
গত বছরের মার্চে প্রতি টন অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের দাম ছিল ৮৫০ থেকে ৯০০ ডলার। বর্তমানে এই তেল ১ হাজার ৬০০ থেকে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৯০০ ডলারে বিক্রি হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে জুলাই-মার্চ সময়ে মোট আমদানি ব্যয়ের ৭০ শতাংশের মতো খরচ হয়েছে রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাকের প্রয়োজনীয় কাঁচামাল ও অন্য পণ্য আমদানিতে। একই সঙ্গে এ খাতে নতুন শিল্প স্থাপনের জন্য ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানিও বেড়েছে।
তৈরি পোশাকের প্রধান কাঁচামাল হচ্ছে তুলা। গত বছরের শুরুর দিকে আন্তর্জাতিক বাজারে ৩০ কাউন্ট মানের সুতার দাম ছিল ৩ ডলারের মতো। বছরের মাঝামাঝি সময়ে তা ৪ দশমিক ২০ থেকে ৪ দশমিক ৩০ ডলার পর্যন্ত উঠে যায়। এখন তা ৪ দশমিক ১০ থেকে ৪ দশমিক ১৫ ডলারে নেমেছে।
নানা উদ্যোগেও কমছে না আমদানি
বিলাস পণ্যের আমদানিতে লাগাম টেনে ধরতে জরুরি পণ্য ছাড়া অন্য সব পণ্য আমদানি কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত ১১ এপ্রিল এক সার্কুলারের মাধ্যমে শিশুখাদ্য, জ্বালানিসহ অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যপণ্য, জীবন রক্ষাকারী ওষুধ, স্থানীয় ও রপ্তানিমুখী শিল্প এবং কৃষি খাতসংশ্লিষ্ট পণ্য আমদানি ছাড়া অন্য সকল পণ্য আমদানির বিপরীতে ঋণপত্র স্থাপনের (এলসি) নগদ মার্জিন হার ন্যূনতম ২৫ শতাংশ সংরক্ষণের জন্য ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু এরপরও আমদানি কমছে না।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর নিউজবাংলাকে বলেন, ‘লাগামহীন আমদানিতে বেশ চাপে পড়েছে দেশের অর্থনীতি। ব্যালান্স অফ পেমেন্ট ১৪ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। অস্থির হয়ে উঠেছে ডলারের বাজার। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এই অর্থবছরে এখন পর্যন্ত প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলার বাজারে ছাড়া হয়েছে। কিন্তু আমদানি বাড়ায় তারপরও চাহিদা মিটছে না।’
তিনি বলেন, ‘অনেক হয়েছে আর নয়। যে করেই হোক আমদানি কমাতেই হবে। এ ছাড়া এখন আর অন্য কোনো পথ খোলা নেই।
‘সাধারণভাবে অর্থনীতিতে আমদানি বাড়াকে ইতিবাচকভাবে দেখা হয়ে থাকে। বলা হয়, আমদানি বাড়লে দেশে বিনিয়োগ বাড়বে, কর্মসংস্থান বাড়বে। এতদিন আমরাও সেটা বলে আসছি। কিন্তু এখন অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। ৫০ শতাংশ আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির ধাক্কা সামলানোর ক্ষমতা আমাদের অর্থনীতির নেই। এখন এটা কমাতেই হবে। তা না হলে বড় ধরনের সংকটের মুখে পড়ব আমরা।’
আহসান মনসুর বলেন, ‘দাম বাড়ায় সরকারের জ্বালানি তেলে ভর্তুকি কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। একই সঙ্গে গ্যাসে ভর্তুকি বেড়েছে, সারে বেড়েছে। বিদ্যুতে বেড়েছে। অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে এবার ভর্তুকি এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। সে ক্ষেত্রে বাজেট ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের চাপ পড়বে।’
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) জ্যেষ্ঠ গবেষণা পরিচালক মঞ্জুর হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমদানির লাগাম টানতে ইতোমধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অতি প্রয়োজনীয় পণ্য ছাড়া অন্য সব পণ্য আমদানিতে এলসি মার্জিন ২৫ শতাংশ রাখার নির্দেশ দিয়েছে। আমি মনে করি, এটা একটা ভালো সিদ্ধান্ত। একই সঙ্গে পণ্য আমদানির আড়ালে বিদেশে টাকা পাচার হচ্ছে কি না, সেটাও খতিয়ে দেখতে হবে।’
দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্পমালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, ‘রপ্তানি বাড়ছে। এটা অব্যাহত রাখতে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানি করতেই হবে আমাদের। এখন বিলাসবহুল ও অপ্রয়োজনীয় পণ্য যাতে আমদানি না হয়, সেদিকে সরকারকে কঠোর হতে হবে।’