ঈদের আগের পরিস্থিতির চেয়ে উন্নতি সামান্যই। দাম লিটারে ৩৮ টাকা বাড়ানোর পরও দোকানে দোকানে সয়াবিন তেল মিলছে কমই।
দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়ার পর বোতলে নতুন দাম সাঁটিয়ে তেল এখনও আসেনি। যেসব দোকানে তেল আছে, তাতে আগের গায়ের দাম লেখা; কিন্তু তারা দাম নিচ্ছেন নতুন দরে।
রাজধানীর কারওয়ান বাজার, হাতিরপুল, মিরপুরসহ বিভিন্ন স্থানে মুদি দোকান ঘুরে এই চিত্র দেখা গেছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরবরাহ স্বাভাবিক হতে সপ্তাহখানেক সময় লাগবে। এই কয়েক দিনে বোতলের গায়ে লেখা বেশি দামের তেল আসতে শুরু করবে।
এক বছরেরও বেশি সময় ধরেই বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দাম ঊর্ধ্বমুখী আর বাংলাদেশ তার চাহিদার সিংহভাগ তেলই আমদানি করে থাকে।
ফেব্রুয়ারির শেষে ইউক্রেনে রুশ হামলার পর সরবরাহ পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়। এর মধ্যে পাম তেলের বড় সরবরাহকারী ইন্দোনেশিয়া তেল রপ্তানির সিদ্ধান্ত স্থগিতের কথা জানালে বাজার আরও ঊর্ধ্বমুখী হয়।
ঈদের আগে আমদানিতে ৫ শতাংশ রেখে ভোজ্যতেলে সব ধরনের ভ্যাট ও ট্যাক্স প্রত্যাহারের পর তেলের দাম লিটারে কমানো হয়েছিল ৮ টাকা। তবে ঈদ শেষে প্রথম কর্মদিবস বৃহস্পতিবার বোতলজাত তেল লিটারে ৩৮ টাকা আর খোলা সয়াবিন তেল লিটারে ৪৪ টাকা বাড়ানোর কথা জানানো হয়।
বাণিজ্য সচিবের সঙ্গে মিলমালিকদের বৈঠকের পর এই বিজ্ঞপ্তি দেয় বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স ও বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন।
নতুন নির্ধারিত দাম অনুযায়ী, ভোক্তাপর্যায়ে প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ১৯৮ ও খোলা সয়াবিন তেল প্রতি লিটার ১৮০ টাকায় বিক্রি হবে।
এ ছাড়া পাঁচ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৯৮৫ টাকা। একই সঙ্গে প্রতি লিটার পাম অয়েল বিক্রি হবে ১৭২ টাকায়।
এর আগে গত ২১ মার্চ বোতলজাত সয়াবিন তেল লিটারে ১৬০ টাকা আর খোলা তেল ১৩৬ টাকা ঠিক করা হয়।
সরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অফ বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে ৮০ টাকা। ২০২১ সালের ৫ মে বোতলজাত সয়াবিনের দাম ছিল ১১৮ টাকা।
বাজারের কী চিত্র
ঈদের আগে তেলের তীব্র সংকট দেখা দেয়। তখন খুচরা বিক্রেতারা কোম্পানিগুলো তেল সরবরাহ করছে না বলে অভিযোগ করছিলেন।
আর তেল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান বলেছিল, ঈদের পর তেলের দাম বাড়তে পারে, এ জন্য খুচরা বিক্রেতারা তেল মজুত করছেন।
কিন্তু দাম বাড়ার ঘোষণার পরও বাজারে তেলের সরবরাহ সংকট কাটেনি।
শুক্রবার সকালে শেওড়াপাড়া, কাজীপাড়ার ১০ দোকান ঘুরে তেল পাওয়া যায়নি। সরিষা তেল থাকলেও দাম চড়া। এক লিটার বিক্রি হচ্ছে ৩৫০-৩৬০ টাকায়।
শেওড়াপাড়ার ব্যবসায়ী মোহাম্মদ লিটন বলেন, ডিলারদের কাছে তেল চেয়ে পাননি। ঈদের আগে থেকে দোকানে সয়াবিন তেল বিক্রি বন্ধ।
আর এক দোকানি আবদুল হাকিম বলেন, রোজার শেষ দিকে চড়া দামে তেল কিনতে হয়েছে। এ জন্য বিক্রি করতে হয়েছে বেশি দামে৷ কিন্তু চাহিদামতো তেল আনতে পারেননি। ঈদের আগেই মজুত তেল বিক্রি শেষ।
দুই লিটার সয়াবিন তেল কিনতে একাধিক দোকান ঘুরে আলিম স্টোরে এসেছেন মনির আলম। তিনি বলেন, ‘ঈদের আগে তেল পাইনি। ঘরে কিছুটা ছিল, সেটা দিয়ে ঈদ পার করেছি। গতকাল দাম বাড়ানোর ঘোষণার পর ভাবছিলাম তেল পাব। কিন্তু কোনো দোকানে তেল পাইনি।
আলিম স্টোরের বিক্রেতা আলিম উদ্দিন বলেন, রোববার তেল দেবে বলে কোম্পানিগুলো জানিয়েছে।
কারওয়ান বাজারেও সয়াবিন তেলের দেখা নেই বললেই চলে। দু-একটি দোকানে আগের কিছু তেল আছে। সেটা বিক্রি করছেন নতুন দামে। তবে গায়ে লেখা আগের দাম।
মেসার্স কমলা ট্রেডার্সের ব্যবসায়ী বলেন, ‘তেল নেই কেন তা আমরা জানি না, কোম্পানি জানে। ঈদের এক সপ্তাহ আগ থেকে তেলের গাড়ি আসে না। তেল যা ছিল ঈদের তিন-চার দিন আগেই বিক্রি শেষ। এখনও নতুন তেল আসেনি।’
কিছু দোকানে ধানের কুঁড়ার তেল বা রাইস ব্রান ও সানফ্লাওয়ার অয়েল পাওয়া গেছে।
পাঁচ লিটারের বোতলজাত সানফ্লাওয়ারের দাম ১ হাজার ৪৫০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা দাম হাঁকা হচ্ছে, যা ঈদের আগের দিনেই পাওয়া গেছে ১ হাজার ২০০ টাকায়। অর্থাৎ সয়াবিন তেলের দাম বেড়ে যাওয়ার পর সানফ্লাওয়ারের দামও বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
পাঁচ লিটারের রাইস ব্রান অয়েল বিক্রি হচ্ছে ৯৬৫ টাকায়। ঈদের আগে এই তেল পাওয়া গেছে ৯০০ টাকায়।
কারওয়ান বাজারে বোতলের গায়ের চেয়ে কিছুটা কমে তেল পাওয়া যায়। তবে এখন দোকানিরা সেভাবে কমাতে চাইছেন না।
সরবরাহ কমানোর অভিযোগ অস্বীকার
দোকানিরা কোম্পানির পক্ষ থেকে সরবরাহ কমিয়ে দেয়ার অভিযোগ করলেও তা মানছেন না দেশে ভোজ্যতেল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপের পরিচালক (করপোরেট ও রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স) বিশ্বজিৎ সাহা। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বেশি হওয়ায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠকে দাম সমন্বয় করা হয়েছে। বাজারে সয়াবিন তেলের কোনো ঘাটতি নেই। ঈদের আগে তেলের সংকটের কোনো কারণ ছিল না। আমরা তেল সরবরাহ স্বাভাবিক রেখেছি।’
কনজ্যুমার ফোরামের সাধারণ সম্পাদক এমদাদ হোসেন মালেক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘দাম বাড়ার ফলে ভোক্তার কষ্ট আরও বাড়বে। ঈদের আগে তেল পাওয়াই যায়নি। এখন লিটারে ৩৮ টাকা বেড়ে যাওয়ায় যারা তেল মজুত করেছিল, তারা বিক্রি করবে।
তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেশির কথা বলে দাম সমন্বয় করা হয়েছে। কিন্তু যখন আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমে যাবে, তখন আমাদের দেশেও যেন দাম কমিয়ে সমন্বয় করা হয় সেদিকে সরকারকে খেয়াল রাখতে হবে।’