নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য থেকে শুরু করে প্রতিটি জিনিসের দাম এখন লাগামহীন। ইচ্ছেমতো বাড়ানো হচ্ছে দাম। ক্রমাগত ব্যয় বৃদ্ধির এই পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে নিম্নবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্তরা। দাম বৃদ্ধির দৌড়ে নেই এমন পণ্য খুঁজে পাওয়া কঠিন। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম কেবল তামাকপণ্য।
জাতীয় বাজেট ঘোষণার মধ্য দিয়ে নতুন অর্থবছরের যাত্রার শুরুতেই দেশের তামাকজাত পণ্যের দাম বৃদ্ধি নিয়মিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। নতুন করে করারোপের পরিপ্রেক্ষিতে কোম্পানিগুলো তাদের উৎপাদিত সিগারেট, বিড়ি, জর্দাসহ তামাকজাত পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়, তবে অন্যান্য পণ্যের মতো সারা বছরই দাম বৃদ্ধির প্রবণতা তামাকপণ্যের ক্ষেত্রে দেখা যায় না।
বছরজুড়ে কিস্তিতে কিস্তিতে দাম না বাড়ানোর অন্যতম কারণ হতে পারে অর্থবছরের শুরুতেই সারা বছর ভোক্তার পকেট খালি করার মতো দাম বাড়িয়ে নেয়া। আবার এসব পণ্য আমদানি নির্ভর নয়। কাঁচামালের জোগানটা স্থানীয় উৎস থেকেই আসে। আবার কাঁচামালের বাজারও কোম্পানিগুলোর নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ার সুযোগ কম।
নানামুখী হিসাব-নিকাশ করেই বহুজাতিক ও স্থানীয় কোম্পানিগুলো এখানে তামাকপণ্যের দাম যখন তখন বাড়ানোর পথে হাঁটে না। সে ক্ষেত্রে তামাক পণ্যের ওপর আরও বেশি হারে কর আরোপের পক্ষে বিভিন্ন সংস্থা।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণায় দেখা যায়, বছরের নানা সময়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়লেও বিড়ি, সিগারেট ও জর্দার মতো পণ্য সেই দৌড়ে নেই। কোম্পানিগুলো ভোক্তা ধরে রাখতে কৌশলী ভূমিকায় অগ্রসর হয়। পণ্যের দাম বাড়লে ব্যবহার কমে যাবে, এমন চিন্তা থেকে তারা নতুন অর্থবছরের বাজেট পর্যন্ত অপেক্ষা করে।
প্রগতির জন্য জ্ঞানের (প্রজ্ঞা) নির্বাহী পরিচালক এ বি এম জুবায়ের নিউজবাংলাকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার যে ঘোষণা দিয়েছেন, সেটা বাস্তবায়নে তামাক পণ্যের দাম বাড়ানোর বিকল্প নেই। এসব পণ্যের দাম বাড়িয়ে মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে নিতে হবে। নতুন করে কেউ যেন তামাকে আকৃষ্ট না হয় সে লক্ষ্যে দাম নির্ধারণ করতে হবে।’
দেশে সিগারেটের দাম তুলনামূলক কম
পার্শ্ববর্তী একাধিক দেশসহ উন্নত কয়েকটি দেশের তুলনায় বাংলাদেশে সিগারেটের দাম কম। অন্যান্য দেশ দাম বাড়িয়ে তামাকপণ্য ব্যবহার কমানোর পথ বেছে নিয়েছে।
অস্ট্রেলিয়ার পার্থে মার্লবোরো ব্র্যান্ডের এক প্যাকেট সিগারেটের দাম বাংলাদেশি মুদ্রায় ২ হাজার ৫১৬ টাকা ৭৩ পয়সা। নিউজিল্যান্ডের হ্যামিল্টনে দাম ২ হাজার ১০৩ টাকা ৫২ পয়সা।
যুক্তরাজ্যের ব্রিস্টলে ২০ শলাকার সিগারেটের দাম ১ হাজার ৪৬৮ টাকা ৬১ পয়সা। আয়ারল্যান্ডের বৃহত্তম শহর গ্যালওয়েতে দাম ১ হাজার ৪২২ টাকা ৩২ পয়সা। নরওয়ের অসলোতে এক প্যাকেটের দাম রাখা হয় ১ হাজার ৩৪৬ টাকা।
যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোতে দাম নেয়া হয় ১ হাজার ২৮৬ টাকা ১২ পয়সা। কানাডার ভ্যানকুভারে এই সিগারেটের দাম রাখা হয় ১ হাজার ২০৪ টাকা ১৪ পয়সা।
ব্যতিক্রম কেবল বাংলাদেশ। এখানে ২০ শলাকা মার্লবোরো সিগারেটের দাম ৩০১ টাকা।
প্রতি বছর বাজেটে বাড়ানো হয় সিগারেটের শুল্ক, কিন্তু কোম্পানিগুলো এর পুরোটা ক্রেতার ঘাড়ে না চাপিয়ে কৌশলে মূল্য সহনীয় রাখে। ফলে দাম বাড়লেও তা ক্রেতাদের সেভাবে স্পর্শ করে না। ফলে ব্যবহারও কমে না।
তামাকপণ্যে দামের উত্তাপে নেই কেন
সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) মূল্যস্ফীতির হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসওয়ারি) গত মার্চ মাসে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৬ দশমিক ২২ শতাংশ। এটি ১৭ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। আগের মাস ফেব্রুয়ারিতে এই হার ছিল ৬ দশমিক ১৭ শতাংশ।
এই মাসে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি হয়েছে বেশি (৬ দশমিক ৩৪ শতাংশ)। আর খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৬ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ।
এভাবে দামের উত্তাপ সব পণ্যে লাগলেও তামাকে এর প্রভাব পড়েনি। প্রশ্ন হলো কেন?
এ বিষয়ে প্রজ্ঞার নির্বাহী পরিচালক এ বি এম জুবায়ের বলেন, ‘বাংলাদেশের বর্তমান তামাক কর-কাঠামো অত্যন্ত জটিল। সিগারেটে একাধিক মূল্যস্তর এবং বিভিন্ন দামে তামাক পণ্য কেনার সুযোগ রয়েছে। ধোঁয়াবিহীন তামাক পণ্য, বিশেষ করে গুল ও জর্দা বিক্রির ক্ষেত্রে কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। ফলে একটি মূল্য স্তরে তামাক পণ্যের দাম বাড়লেও অন্যগুলো অপরিবর্তিত থাকে। তখন ভোক্তা তার সুবিধামতো স্তরে বা পণ্যে স্থানান্তর হতে পারে। বাজেটে কর আরোপের মাধ্যমে তামাক পণ্যের মূল্য বৃদ্ধিও মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
‘এখানে তামাক পণ্য ব্যবহারে ভোক্তাকে নিরুৎসাহিত করা হয় না। বর্তমানে তামাক ব্যবহারকারীদের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ (যাদের অধিকাংশ দরিদ্র ও নারী) ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহার করে। কোনো তামাক কর নীতিমালা না থাকায় এ খাত থেকে সরকারের রাজস্ব আহরণের কোনো সুনির্দিষ্ট দিক নির্দেশনা নেই। তামাক পণ্যে করারোপের ক্ষেত্রে জনস্বাস্থ্যের চেয়ে রাজস্ব প্রাপ্তিকেই অগ্রাধিকার দেয়া হয়।’
কোম্পানিগুলো যে কৌশল নেয়
তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী, তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন, প্রচার ও পৃষ্ঠপোষকতা নিষিদ্ধ, কিন্তু ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে বিভিন্ন কৌশলে এসব পণ্যের প্রচার করেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা।
আইনে বিক্রিস্থলে পণ্য প্রদর্শন নিষিদ্ধ না থাকায় এটার সুযোগে তামাকজাত দ্রব্য প্রদর্শনকে বিজ্ঞাপন প্রচারের কৌশল হিসেবে বেছে নিয়েছে তামাক কোম্পানিগুলো। এসব কোম্পানির মূল টার্গেট শিশু, কিশোর ও তরুণরা।
তামাকজাত পণ্যকে আকর্ষণীয় করতে নেয়া হয় নানা পদক্ষেপ। এ ক্ষেত্রে দ্রব্যের প্যাকেটে ডিজাইনের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয় কোম্পানিগুলো।
টোব্যাকো অ্যাটলাস-এর সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সীদের মধ্যে তামাক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১ লাখ ৭২ হাজারের বেশি।
গবেষণায় দেখা যায়, তামাকপণ্য প্রদর্শনের কারণে ব্যবহারকারীদের অনেকেই তামাক ছাড়ার বিষয়ে আগ্রহী হয় না।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, তরুণদের নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডে আকৃষ্ট করতে পৃথিবীব্যাপী বছরে ৯০০ কোটি ডলার ব্যয় করে তামাক কোম্পানিগুলো।
ব্যবহারকারী কমছে না
গবেষণায় দেখা যায়, সর্বোচ্চ ধূমপায়ীর দিক থেকে ১০৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান নবম। এখানে প্রাপ্তবয়স্ক (১৫ বছর ও তদূর্ধ্ব) ৩ কোটি ৭৮ লাখ মানুষ তামাক সেবন করে। শতকরা হিসেবে ৩৫ দশমিক ৩ শতাংশ। ভারতে এ হার ২৮ দশমিক ৬ শতাংশ।
বাংলাদেশে তামাক ব্যবহারজনিত ক্ষতির চিত্রও ভয়াবহ।
গবেষণায় দেখা যায়, বছরে তামাক ব্যবহারের কারণে ১ লাখ ৬১ হাজারের বেশি মানুষ মারা যায়। পঙ্গুত্ব বরণ করে আরও প্রায় ৪ লাখ মানুষ।
ধূমপান না করেও কর্মক্ষেত্রে নারীরা ১৯ শতাংশ, গণপরিবহনে ৩৮ শতাংশ এবং বাড়িতে ৩৭ শতাংশ পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হচ্ছেন।
ঢাকার প্রাথমিক স্কুলে পড়া ৯৫ শতাংশ শিশুর দেহে উচ্চমাত্রার নিকোটিন পাওয়া গেছে।
আরেকটি ভয়াবহ তথ্য হলো বিড়ি কারখানাগুলোর মোট শ্রমিকের ৫০ থেকে ৭০ শতাংশই শিশু।
এনবিআরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, কর ও মূল্য পদক্ষেপ যথাযথভাবে কাজ না করায় সিগারেট ছাড়ার পরিবর্তে উচ্চ ও মধ্যম স্তরের ভোক্তারা নিম্ন স্তরে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে। ২০০৬-০৭ সালে নিম্নস্তরের তামাক ব্যবহারকারী ছিল ৩০ শতাংশ। ২০২০-২১ সালে সেটা বেড়ে প্রায় ৮০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
নিম্ন স্তরের সিগারেটের শুল্ক হার কম থাকায় এই স্তরে নতুন নতুন ব্র্যান্ড চালু হয়েছে, ফলে ভোক্তাও বেড়েছে।
তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন শক্তিশালী করা জরুরি
বাংলাদেশে বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোলের (এফসিটিসি) বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা অনুপস্থিত রয়েছে বলে মনে করে তামাকবিরোধী সংগঠন প্রজ্ঞা ও অ্যান্টি-টোব্যাকো মিডিয়া অ্যালায়েন্স (আত্মা)।
বিশেষ করে পাবলিক প্লেস ও পরিবহনে স্মোকিং জোন, বিক্রয়স্থলে তামাকপণ্য প্রদর্শন এবং তামাক কোম্পানির সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মসূচি (সিএসআর) প্রভৃতি সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ না থাকায় আইনটি প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ অর্জনে যথেষ্ট শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে পারছে না বলে মনে করে তামাকবিরোধী সংগঠনগুলো।
ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য (ব্যবহার) নিয়ন্ত্রণ আইন ২০০৫ এর কিছু ধারা সংশোধনের প্রস্তাব দিয়েছে তারা।
এগুলো হলো শতভাগ ধূমপান বন্ধ নিশ্চিতে উন্মুক্ত স্থানে (পাবলিক প্লেস) ধূমপান নিষিদ্ধ করতে হবে। বিড়ি-সিগারেটের খুচরা শলাকা বিক্রি বন্ধ করতে হবে।
ই-সিগারেট বাজারজাত বন্ধ করা, তামাকজাত পণ্যের মোড়কে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণীর আকার বাড়ানো, সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মসূচির (সিএসআর) নামে সিগারেট কোম্পানিগুলোর কার্যক্রম বন্ধ করা এবং বিক্রির স্থানে তামাকজাত দ্রব্যের প্রদর্শন বন্ধ করতে হবে।