আকুর রেকর্ড আমদানি বিল পরিশোধের পর বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ ৪২ বিলিয়ন (৪ হাজার ২০০ কোটি) ডলারের নিচে নেমে এসেছে।
বৃহস্পতিবার এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) মার্চ-এপ্রিল মেয়াদের ২ দশমিক ২৪ বিলিয়ন (২২৪ কোটি) ডলারের আমদানি বিল পরিশোধ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর আগে কখনই আকুর এতো বেশি বিল শোধ করেনি বাংলাদেশ। এর ফলে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচক ৪১ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে।
যা গত দেড় বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম। এর আগে ২০২০ সালের নভেম্বরে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪১ দশমিক ২৬ বিলিয়ন ডলার।
বর্তমানের আমদানির খরচ হিসাবে এই রিজার্ভ দিয়ে পাঁচ মাসের কিছু বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব হবে। অথচ সাত-আট মাস আগেও ১০ মাসের আমদানি খরচ মেটানোর রিজার্ভ ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, মহামারি করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার পর থেকেই দেশে আমদানি ব্যয় অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। ২০২০ সালের মার্চে দেশে করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার আগে মাসে আমদানি খাতে গড়ে ৪ থেকে সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার খরচ হতো। করোনার মধ্যে তা কমে গড়ে ৩ থেকে সাড়ে ৩ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে।
কিন্তু চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের শুরু থেকেই আমদানিতে উল্লম্ফন লক্ষ্য করা যায়। অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ৫ দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়। আগস্টে তা বেড়ে ৬ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলারে ওঠে। সেপ্টেম্বরে তা গিয়ে ঠেকে ৭ বিলিয়ন ডলারে।
অক্টোবরে পণ্য আমদানিতে ব্যয় হয় ৭ দশমিক ১১ বিলিয়ন ডলার। নভেম্বরে তা বেড়ে ৭.৮৫ বিলিয়ন ডলারে উঠে। ডিসেম্বরে তা আরও বেড়ে ৮ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করে।
জানুয়ারি মাসে ৮ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি করেছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা।
সবশেষ ফেব্রুয়ারি মাসে আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ৮ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার।
অর্থনীতির বিশ্লেষক ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, মূলত আমদানি বাড়ার কারণেই রিজার্ভ কমছে। এ ছাড়া প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের নিম্নগতি রিজার্ভ কমার আরও একটি কারণ বলে জানিয়েছেন তারা।
বেশ কয়েক বছর ধরে রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে বাড়তে থাকে। একের পর এক রেকর্ড হয়। মহামারি করোনাকালে আমদানিতে ধীরগতি আর রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ের ঊর্ধ্বগতির কারণে গত বছরের ২৪ আগস্ট রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করে, যা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে সময়ের চেয়ে বেশি।
সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে আকুর জুলাই-আগস্ট মেয়াদের আমদানি বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ ৪৭ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসে।
আমদানি বাড়ায় রিজার্ভ থেকে প্রয়োজনীয় ডলার চলে যাওয়ায় অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে তা ৪৬ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। রপ্তানি বাড়ায় নভেম্বরের প্রথম দিকে রিজার্ভ খানিকটা বেড়ে ৪৬ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারে ওঠে।
৭ নভেম্বর আকুর সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসের দেনা পরিশোধের পর রিজার্ভ ৪৫ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসে।
চলতি বছরের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে আকুর নভেম্বর-ডিসেম্বর মেয়াদের ১ দশমিক ৯৩ বিলিয়ন ডলারের বিল শোধের পর এই সূচক ফের ৪৪ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে।
রপ্তানি আয় বাড়ায় এবং রেমিট্যান্সপ্রবাহে গতি ফেরায় পরে তা বেড়ে ৪৬ বিলিয়ন ডলারে উঠে।
মার্চের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে আকুর জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসের ২ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করা হয়। সমন্বয় করার পর রিজার্ভ ৪৩ দশমিক ৮৯ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে।
এরপর গত দুই মাসে তা কিছুটা বেড়ে ৪৪ থেকে ৪৪ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে উঠানামা করে।
বৃহস্পতিবার আকুর ২ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলার বিল শোধ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। রোববার সমন্বয়ের পর তা ৪২ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের একজন কর্মকর্তা।
এক বছর পর রিজার্ভ ৪৩ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নামল। গত বছরের মার্চে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪৩ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলার।
দুই মাস পর পর আকুর বিল পরিশোধ
বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, ইরান, মিয়ানমার, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ বর্তমানে আকুর সদস্য। এই দেশগুলো থেকে বাংলাদেশ যেসব পণ্য আমদানি করে তার বিল দুই মাস পরপর আকুর মাধ্যমে পরিশোধ করতে হয়।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রা মজুত থাকতে হয়।
গত জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি পণ্য আমদানি খরচের হিসাবে বর্তমানের রিজার্ভ দিয়ে পাঁচ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যাবে।
অর্থনীতির গবেষক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর নিউজবাংলাকে বলেছেন, ‘আমদানি বাড়লে রিজার্ভ কমবে এটাই স্বাভাবিক। তবে এতে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। এখনও মোটামুটি সন্তোষজনক রিজার্ভ আছে। তবে, যে করেই হোক এখন আমদানি কমাতেই হবে। একইসঙ্গে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় আরও বাড়ানোর দিকে নজর দিতে হবে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘করোনার ধাক্কা সামলে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোয় মূলধনি যন্ত্রপাতি, শিল্পের কাঁচামালসহ সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়ছে। জ্বালানি তেল ও খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধিও আমদানি খরচ বাড়িয়ে দিয়েছে। সব মিলিয়ে আমদানিতে রিজার্ভ থেকে আগের চেয়ে বেশি খরচ হচ্ছে।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে ৫৮ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি (সিঅ্যান্ডএফ) করেছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৪৬ দশমিক ৭০ শতাংশ বেশি।
রেমিট্যান্সের দশ মাসের (জুলাই-এপ্রিল) তথ্য প্রকাশ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এই দশ মাসে ১৭ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৬ দশমিক ২৪ শতাংশ কম।
তবে রপ্তানি বাণিজ্যে উল্লম্ফন অব্যাহত রয়েছে। নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে ৩৮ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৩৩ দশমিক ৪১ শতাংশ বেশি।