কিনতে গেছেন সয়াবিন তেল, ১০ দোকান ঘুরেও পাবেন না, আবার কোথাও যদি কপালগুণে পেয়েও যান, কিনতে পারবেন না।
সেখানে দেয়া হবে নানা ধরনের শর্ত। যেমন তেল নিতে হলে আপনাকে নিতে হবে পোলাওয়ের চাল অথবা অন্য কিছু। একটি দোকানে গিয়ে দেখা গেল, ৩৬০ টাকা লিটারের সরিষার তেল কিনলেই ক্রেতাকে সয়াবিন তেল দিতে রাজি হচ্ছেন বিক্রেতা।
আন্তর্জাতিক বাজারে দামের ঊর্ধ্বগতিতে এক বছরের বেশি সময় ধরেই দেশের বাজারে সয়াবিন ও পাম তেলের দাম বেড়েই চলেছে। এর মধ্যে মার্চ থেকে দাম বাড়ানোর আবেদন সরকার ফিরিয়ে দেয়ার পর বাজারে সরবরাহ কমিয়ে দেয় কোম্পানিগুলো। তখন থেকেই তেল কিনতে গিয়ে তেলেসমাতির শিকার হতে হয়।
অন্য পণ্য কিনলেও তেল কিনতে পারছে না মানুষ- এমন পরিস্থিতিতে রোজার আগে আগে সরকার ভোজ্যতেলের আমদানিতে ভ্যাট ও ট্যাক্স অনেকটাই কমিয়ে আনে। তখন তেলের দাম লিটারে ৮ টাকা করে কমানো হয়। বাজারে সরবরাহ পরিস্থিতিও স্বাভাবিক হয়ে ওঠে।
এর মধ্যে আবার অস্থির হয়ে উঠেছে বিশ্ববাজার। তেলের দাম তেতে ওঠার পাশাপাশি পাম তেলের বড় সরবরাহকারী দেশ ইন্দোনেশিয়া তেল রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা দিয়ে বসে। এতে আবার দেশের বাজারে তেলের হাহাকার তৈরি হয়েছে।
আমদানিকারকদের দাবি, তাদের আনা নতুন তেলের যে দাম পড়েছে, বর্তমান বাজার দরে সেটি ছাড়লে লিটারপ্রতি লোকসান হচ্ছে ৫০ টাকার মতো। কিন্তু সরকার এ বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে মূল্য সমন্বয়ের কোনো উদ্যোগ এখনও নেয়নি। এই পরিস্থিতিতে খোলাবাজারে মিলগুলো তেলের সরবরাহ একেবারেই কমিয়ে দিয়েছে।
আগের সরবরাহ করা তেলের সবগুলোও যে স্বাভাবিকভাবে বিক্রি হচ্ছে- এমন নয়। সুযোগ বুঝে পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা ভোক্তাদের জিম্মি করছেন- এটিও স্পষ্ট।
ঈদের দুদিন আগে থেকে রাজধানীর দোকানে দোকানে উধাও হয়ে যায় সয়াবিন তেল। কোথাও কোথাও ধানের কুঁড়ার তেল বা রাইস ব্রান অয়েল, সূর্যমুখীর তেল বা সরিষার তেল দেখতে পাওয়া যায়।
এর মধ্যে রাইস ব্রান ও সূর্যমুখীর তেলের দাম না বাড়লেও সরিষা তেলের দাম বেড়ে গেছে অস্বাভাবিক হারে। সরকার সয়াবিন তেলের দাম ঠিক করে দিলেও সরিষার তেলে চোখ বুঁজে আছে।
রাজধানীর কারওয়ান বাজার কিচেন মার্কেটের দোতলায় মেসার্স শাহানা স্টোরে পাঁচ লিটারের এক বোতল সরিষার তেল ১ হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি করতে দেখা গেল। এর গায়ের দাম দেয়া ১ হাজার ৬১০ টাকা। অর্থাৎ সুপারশপ বা এলাকার দোকানে কিনতে হবে এই দামেই।
কারওয়ান বাজারে গায়ের দামের তুলনায় বেশ কমে বিক্রি করার কারণ জানতে চাইলে বিক্রেতা বললেন, ‘আমাগো কোম্পানি ছাড় দিছে।’
কারওয়ানবাজারের মেসার্স শাহানা স্টোরে পাঁচ লিটারের সরিষার তেল বিক্রি হচ্ছিল এক হাজার দুইশ টাকায়। তবে গায়ের দাম লেখা এক হাজার ৬১০ টাকা। মহল্লার বাজার ও সুপারশপে এই দামেই কিনতে হচ্ছে
এই দাম চাওয়ার পর কর্মচারীকে ধমকাতে দেখা গেল দোকান মালিক বা তার তত্ত্বাবধায়ককে। তিনি বলেন, ‘তোরে এত কমে বেচতে কইছে কেডা?’
রাজধানীর নাখালপাড়া, ফার্মগেট এলাকা ঘুরেও একই চিত্র দেখা গেল। তীর কোম্পানির পাঁচ লিটার তেল নিয়ে বাড়ি যাচ্ছেন নুরুন্নবী ইমন নামে একজন।
কত নিল- জানতে চাইলে নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘গায়ের দামে তেল পাওয়া যায় না। আমি খুঁজছি অনেক পাই নাই। তারপর পাঁচ লিটার সয়াবিনের সঙ্গে এক লিটার সরিষার তেল কিনতে হয়েছে।
‘সয়াবিন ৭৬০, সরিষা ১ লিটার ৩৬০ টাকা সব মিলিয়ে তেলের পেছনে ব্যয় করতে হয়েছে ১ হাজার ১২০ টাকা। এই সরিষার তেলের প্রয়োজন ছিল না। তাও বাধ্য হয়েই কিনতে হয়েছে।’
রামপুরা দাশপাড়ার বাসিন্দা সুভাষ চন্দ্র দাস জানান, এক লিটার তেল ১৬০ টাকা গায়ের মূল্য হলেও ১৭০ টাকা নিয়েছে কারওয়ান বাজারে। পাশাপাশি সেই দোকান থেকে তেল ও অন্য পণ্য কিনতে হয়েছে।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, 'হেরা (দোকানদার) তেল দিতে চায় না। কত রিকোয়েস্ট কইরা লইয়া আইছি।'
সুভাষ চন্দ্রের কথার সত্যতা মিলল কারওয়ান বাজারের আল্লাহর দান দোকানের স্বত্বাধিকারী ওমর ফারুকের বক্তব্যে। তিনি বলেন, ‘আমরা গায়ের দামেই বিক্রি করছি। তবে শর্ত হইল বাজার নিতে হবে। কিন্তু মানুষ তেল নিয়া বাসায় জমায়। তাই শর্ত দিয়া দিই। এক লিটার তেল ১৬০, দুই লিটার ৩১৮ টাকা।’
নাখালপাড়ার গৃহিণী লিজা চৌধুরী সয়াবিন তেল কিনতে পাঁচ দোকান ঘুরেছেন। অন্য বাজার রেখে আসতে যাচ্ছিলেন বাসায়। জানালেন এরপর তেল খোঁজার জন্য আবার বের হবেন।
পশ্চিম নাখালপাড়ার হাফিজ স্টোরে গিয়ে শুধু এক লিটারের সয়াবিন তেলের বোতল পাওয়া গেছে। সেই তেল আগের কেনা জানিয়ে দোকানি গায়ের দাম ১৬৮ টাকা লিটারেই বিক্রি করছিলেন।
বিক্রেতা বোরহান উদ্দীন বলেন, 'কাস্টমাররা এসে ফিরে যাচ্ছে। ডিলাররা দেয় না এটা হলো মূল কারণ।‘
সপ্তাহখানেক ধরে এই সংকটের সৃষ্টি হয়েছে বলে যোগ করেন তিনি। বলেন, ঈদ উপলক্ষে তেমন কিছু বাড়ে নাই। পোলাওয়ের চাল প্যাকেটেরটা ১৩০ টাকা কেজি, খোলাটা ১১০ টাকা। পিঁয়াজ ২৫ টাকা, চিনি খোলাটা ৮০ টাকা, প্যাকেটেরটা ৮৫ টাকা।
মেসার্স আমান এন্টারপ্রাইজে গিয়ে সয়াবিন তেল পাওয়া যায়নি। বিক্রেতা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘তেলই তো নাই। যা ছিল, আগের দামে গতকাল বিক্রি করে ফেলেছি।’
কারওয়ানবাজারের মেসার্স বিউটি স্টোরের সব তেলই সানফ্লাওয়ার অয়েল
পশ্চিম নাখালপাড়ার কুমিল্লা স্টোরে গিয়েও সয়াবিন তেল পাওয়া যায়নি। সেখানে সানফ্লাওয়ার তেল আছে। পাঁচ লিটারের বোতলের গায়ের দাম ১ হাজার ৬৭০ টাকা লেখা। দোকানি বিক্রি করছিলেন ১ হাজার ৬০০ টাকায়। তবে কারওয়ান বাজারে এই তেল পাওয়া যায় ১ হাজার ২০০ টাকায়।
নাখালপাড়ার খুচরা ও পাইকারি বিক্রির দোকান খায়ের স্টোর। বিক্রেতা জানান, তেল এক লিটার ১৭০ টাকা দরে বিক্রি করা হচ্ছে। খোলা সয়াবিন তেল আছে যার কেজি বিক্রি করা হচ্ছে ১৯৫ টাকা।
নাখালপাড়ার চেইন সুপারশপ স্বপ্নের বিক্রয়কর্মী কাজী নাবিল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘দুই দিন ধরে আউটলেটে সয়াবিন তেল নেই। অর্ডার দিয়েছি, আসেনি। রাইস ব্রান আছে শুধু।’
তেজগাঁওয়ের ফার্মগেটে রোজ ট্রেডার্সে অন্যান্য পণ্যের পসরা থাকলেও সয়াবিন তেল চোখে পড়েনি।
মজুত কেমন, সরবরাহ কত
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব বলছে, এ মুহূর্তে দেশে ভোজ্যতেলের কোনো ঘাটতি নেই; বরং সয়াবিন ও পাম তেল চাহিদার চেয়ে বেশি মজুত রয়েছে। মজুত তেল আছে আমদানিকারক ও পরিশোধন কোম্পানিগুলোর গুদাম, কারখানায় এবং তাদের পরিবেশকদের হাতে।
দেশে সয়াবিন, পাম তেলসহ সব ধরনের ভোজ্যতেলের দৈনিক সরবরাহ দরকার প্রায় সাত হাজার টন, কিন্তু বর্তমানে বিভিন্ন কোম্পানি কারখানা পর্যায় থেকে সরবরাহ দিচ্ছে দৈনিক তিন-চার হাজার টনের মতো।
বন্দরেও নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে সয়াবিন ও পাম তেল। এর বাইরে বন্দরে ভেড়ার অপেক্ষায় সমুদ্রপথে রয়েছে আরও কয়েকটি তেলবাহী জাহাজ।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা দাবি করছেন, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি, মার্চ ও এপ্রিলে যে পরিমাণ অপরিশোধিত তেল আমদানি হয়েছে, তা দিয়ে কমপক্ষে আরও দুই মাস চলার কথা। অন্যদিকে বিশ্ববাজার থেকে বর্তমানে যে তেল আমদানি হবে, তা দেশে আসতে আরও দুই মাস লাগার কথা। আবার তা দেশে আসার পর কারখানায় পরিশোধিত হয়ে বাজার পর্যায়ে সরবরাহ হতে আরও দেড়-দুই মাস লেগে যাবে।
পর্যাপ্ত মজুত থাকা সত্ত্বেও কেন সরবরাহে ঘাটতি জানতে চাইলে ভোজ্যতেলের অন্যতম সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপের পরিচালক (অর্থ) বিশ্বজিৎ সাহা এক কথায় বলেন, ‘আপনি ব্যবসা করলে কি লোকসান দিয়ে ব্যবসা করবেন? কোম্পানিগুলোর কী দায় পড়েছে লিটারে ৫০ টাকা লোকসান দিয়ে তেল সরবরাহের।’
বাজারে তেলের সরবরাহে ঘাটতির কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘ঈদের পর দাম সমন্বয় হলে পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি হবে।’
টিকে গ্রুপের পরিচালক (ফাইন্যান্স অ্যান্ড অপারেশন) সফিউল আতাহার তাসলিম বলেন, ‘বাজারে তেলের সরবরাহ হচ্ছে না বিষয়টি এমন নয়, তবে সরবরাহ কমেছে। তার পরিমাণ ১৫-২০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে।’
এ ঘাটতিকে যৌক্তিক উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বিপুল পরিমাণ লোকসান দিয়ে মিলাররা যে এখনও তেল সরবরাহ করে যাচ্ছেন, সেটিই বিস্ময়ের বিষয়।’