রাজধানীর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী তাশফিয়া তাসনিম। রোববার বিকেলে মগবাজারের মীরবাগে সুপারশপ স্বপ্নে করতে গিয়েছিলেন ঈদের বাজার। প্রয়োজনীয় প্রায় সব কেনা শেষে তাশফিয়া জানতে পারলেন, সরিষা বাদে অন্য কোনো ভোজ্যতেল নেই সুপারশপটিতে। এতে মাথায় হাত পড়ে তার।
পরে বিকেল থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত মীরবাগ মোড়, রামপুরা কাঁচাবাজার, নতুন রাস্তা, নয়াটোলা ও আশপাশে অন্তত ১০টি মুদি দোকানে খোঁজ করেও সয়াবিন তেলের দেখা পাননি তাশফিয়া। অনলাইন মার্কেটপ্লেসে খোঁজ নিয়েও ব্যর্থ হন। বাধ্য হয়েই সরিষার তেল নিয়েই ঘরে ফিরতে হয়েছে তাকে।
মঙ্গলবার ঈদুল ফিতরের আগে দুদিন ধরে ভোজ্যতেলের এমন সংকটের খবর পাওয়া যাচ্ছে রাজধানীর অন্য এলাকাগুলোতেও। ফেসবুকেও বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ জানিয়েছেন অনেকে। তেল সংকটের খবর আসছে বিভিন্ন জেলা থেকে। আছে বাড়তি দাম নেয়ার অভিযোগও।
মগবাজারে হাসিব নামের এক ক্রেতা জানান, অনেকগুলো দোকান ঘুরে দুই-একটাতে সয়াবিন তেল পাওয়া গেলেও দাম পড়ছে বেশি। এক লিটারের তেল পাওয়া যাচ্ছে না। দুই বা তার বেশি লিটার নিতে হচ্ছে। রাইস ব্র্যান বা সূর্যমুখী তেল কিনতেও বাধ্য হচ্ছেন অনেকে।
তিনি আরও জানান, বোতলের গায়ে যে দাম লেখা রয়েছে, তার চেয়ে বেশি দাম দিতে হচ্ছে। কোনো কোনো দোকানি আবার তেলের সঙ্গে চাল বা অন্য পণ্য কিনতে বাধ্য করছেন। অন্য পণ্য না নিলে তেল বিক্রি করছেন না। তারা বলছেন, যেখান থেকে তেল আনা হচ্ছে, তাদেরও একইভাবে বাধ্য করা হচ্ছে।
মগবাজারের মধুবাগের রনি স্টোরের মালিক রনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কোথাও সয়াবিন তেল নেই। কোম্পানিকে অগ্রিম টাকা দিয়ে রেখেছি, তেল পাইনি। ঈদের আগে আর তেল আসবে না।’
তেলের এই সংকটের মধ্যেই অবৈধভাবে মজুতের দায়ে রোববার কারওয়ান বাজারে কয়েকটি দোকানকে জরিমানা করেছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। ওই সময় দুই হাজার লিটার সয়াবিন তেল উদ্ধার করা হয়। অধিদপ্তরের ভ্রাম্যমাণ আদালত চলমান থাকবে বলে জানানো হয়েছে।
কারওয়ান বাজারের চিত্র
রাজধানীর অন্যতম বড় পাইকারি বাজার কারওয়ান বাজারে সোমবার ৫০টি দোকান ঘুরেও ভোজ্যতেল পাননি নিউজবাংলার প্রতিবেদক।‘বি বাড়িয়া জেনারেল স্টোর’ নামের একটি দোকানে শুধু রাইস ব্র্যান অয়েল ছিল। সেখানে পাওয়া যায়নি সয়াবিন।
দোকানের এক কর্মী বলেন, ‘তেল পাওয়া যায় না তো, নিউজ দেহেন নাই? কালকা দুই লিটারের একটা কার্টন আনছিলাম। আজ এখনও দেয় নাই। তেল আইন্যা দোকানদারে লাভ করতে পারে না। যে দামে কেনা, সেই দামে বেচা।’
কোথা থেকে তেল আনেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা তো আনি ডিলারের থেইক্যা। এই যে সিদ্দিক স্টোর আছে, বিসমিল্লাহ স্টোর আছে।’পাশেই সিদ্দিক স্টোরে গিয়ে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। পাশের দোকানের ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান বাবলু জানালেন, দোকান খুলবে।
তিনি বলেন, ‘মনে হয় তেলটেল বেইচ্যা চল্যা গেছে তো। আবার আসবে। চাহিদা এক হাজার কার্টন, কোম্পানি দিছে ১০০ কার্টন। ঈদের পরে অবস্থা আরও খারাপ হয়া যাইব।
‘পাম তেল ১৯০ টাকা কেজি। আগের দিন সিদ্দিক স্টোরকে জরিমানা করেছে ২০ হাজার টাকা।’
মেসার্স শাহানা স্টোরে গিয়ে দেখা যায়, সূর্যমুখী ও সরিষার তেল আছে। সেখানে কোনো সয়াবিন তেল নেই। দোকানটিতে প্রাণ কোম্পানির ৫ লিটার সরিষার তেল বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ২০০ টাকায়। তেলের গায়ে লেখা ছিল ১ হাজার ৬১০ টাকা।
দোকানটির এক কর্মী জানান, কোম্পানি ছাড় দেয়ায় কম দামে বিক্রি করা হচ্ছে সরিষার তেল, তবে সয়াবিন নেই তাদের কাছে।
কারওয়ান বাজার পাইকারি মার্কেটের দ্বিতীয় তলার একটি দোকানে এক লিটারের কয়েক বোতল সয়াবিন দেখা যায়। দোকানির কাছে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা কাস্টমারের তেল; বিক্রি হয়ে গেছে।’
কী বলছেন সংশ্লিষ্টরা
তিন স্তরে ভ্যাট কমার সুবিধা নিয়েও ভোজ্যতেলের দাম বাড়াতে চাইছেন আমদানিকারক ও মিলাররা। লক্ষ্যপূরণে তারা সয়াবিন ও পাম তেলের সরবরাহে অনীহা দেখাচ্ছেন।
দেশে সয়াবিন ও পাম তেলসহ সব ধরনের ভোজ্যতেলের দৈনিক সরবরাহ দরকার প্রায় ৭ হাজার টন, কিন্তু বর্তমানে বিভিন্ন কোম্পানি কারখানা পর্যায় থেকে সরবরাহ দিচ্ছে দৈনিক ৩ থেকে ৪ হাজার টনের মতো।
এ মুহূর্তে দেশে ভোজ্যতেলের মজুতের ঘাটতি নেই; বরং সয়াবিন ও পাম তেল চাহিদার চেয়ে বেশি মজুত রয়েছে। মজুত তেল আছে আমদানিকারক ও পরিশোধন কোম্পানিগুলোর গুদাম, কারখানায় এবং তাদের পরিবেশকদের হাতে।
বন্দরেও নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে সয়াবিন ও পাম তেল। এর বাইরে বন্দরে ভেড়ার অপেক্ষায় সমুদ্রপথে রয়েছে আরও কয়েকটি তেলবাহী জাহাজ।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা দাবি করছেন, চলতি বছর ফেব্রুয়ারি, মার্চ ও এপ্রিলে যে পরিমাণ অপরিশোধিত তেল আমদানি হয়েছে, তা দিয়ে কমপক্ষে আরও দুই মাস চলার কথা। অপর দিকে বিশ্ববাজার থেকে বর্তমানে যে তেল আমদানি হবে, তা দেশে আসতে আরও দুই মাস লাগার কথা। আবার তা দেশে আসার পর কারখানায় পরিশোধিত হয়ে বাজার পর্যায়ে সরবরাহ হতে আরও দেড়-দুই মাস লেগে যাবে।
ক্রেতাদের অভিযাগ, দেশে মজুত তেলের দাম সরবরাহ পর্যায়ে এখনই বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। দাম বাড়ানোর অপচেষ্টা হিসেবে মিলাররা সরবরাহ চেইনেই পরিকল্পিতভাবে কৃত্রিম সংকট তৈরি করছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ভোজ্যতেলের অন্যতম সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপের পরিচালক (অর্থ) বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, ঈদের পর দাম সমন্বয় হলে পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি হবে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (আইআইটি অনুবিভাগ) এ কে এম আহাদ আলী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এ মুহূর্তে দেশে কোনোভাবেই ভোজ্যতেলের সরবরাহে ঘাটতি হওয়ার কথা নয়। কেন এমনটি হচ্ছে, আমরা নানাভাবে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ শুরু করেছি। ঈদের পর ভোজ্যতেলের দাম পুনর্নির্ধারণী বৈঠক রয়েছে। আমরা ওই বৈঠকেই এসবের জবাব চাইব।’
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, ‘দাম নিয়ন্ত্রণে আমরা বাজারে মনিটরিং জোরদার করেছি। নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।’