রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় খাদ্য ও জ্বালানির যে দর বেড়েছে, তা বছরের পর বছর ঊর্ধ্বমুখীই থাকবে। এরকমই পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক।
সংস্থাটি বলেছে, ‘যুদ্ধ পণ্যের বাজারের জন্য একটি বড় ধাক্কা দিয়েছে। বাণিজ্য, উৎপাদন এবং ব্যবহারের বৈশ্বিক নিদর্শনগুলোকে এমনভাবে ওলটপালট করে দিয়েছে যে, ২০২৪ সালের শেষ পর্যন্ত মূল্য ঐতিহাসিকভাবে উচ্চ স্তরে থাকবে।’
বিশ্বব্যাংকের ‘কমোডিটি মার্কেটস আউটলুক’ প্রতিবেদনে এই আশঙ্কার কথা বলা হয়েছে। মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে সংস্থাটির সদরদপ্তর থেকে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়।
প্রতিবেদনে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলা হয়, গত দুই বছরে জ্বালানির দাম ১৯৭৩ সালের তেল সংকটের পর সর্বোচ্চ। খাদ্যপণ্যের দাম এমনিতেই চড়া ছিল; এরপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে এই বড় দুই খাদ্য উৎপাদক দেশে উৎপাদন কর্মকাণ্ড মারাত্মক ব্যাহত হয়েছে। বিশেষ করে প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর নির্ভর করে যে সার উৎপাদন হয়, তার সরবরাহ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় খাদ্যপণ্য উৎপাদনে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এর ফলে বিশ্বজুড়ে খাদ্য সংকট তীব্র হয়েছে, যা ২০০৮ সালের চেয়েও বড় সংকট হিসেবে দেখা দিয়েছে।’
বিশ্বব্যাংকের ইকুইটেবল গ্রোথ, ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনস্টিটিউশনস ভাইস প্রেসিডেন্ট ইন্ডারমিট গিল বলেছেন, ‘সামগ্রিকভাবে আমরা ১৯৭০ দশকের পর সবচেয়ে বড় সংকট অনুভব করছি। খাদ্য, জ্বালানি এবং সারের বাণিজ্যে বিধিনিষেধের কারণে এই ধাক্কা আরও তীব্র হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘দিন যত যাচ্ছে, সংকট ততই বাড়ছে। নীতিনির্ধারকদের উচিত বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করা। প্রত্যেকটি দেশের উচিত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর প্রতিটি সুযোগ গ্রহণ করা এবং উচিত নয় এমন কাজগুলো করা যা বিশ্ব অর্থনীতির ক্ষতি করে।’
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২২ সালে জ্বালানির দাম ৫০ শতাংশ বাড়বে। কৃষি পণ্য এবং অন্যান্য পণ্যের দাম বাড়বে ২০ শতাংশের বেশি। ২০২৪ সালের শেষ পর্যন্ত ঊর্ধ্বমুখী ধারা অব্যাহত থাকবে। যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে বা রাশিয়ার ওপর অতিরিক্ত নিষেধাজ্ঞা আরোপ হলে খাদ্যপণ্য, জ্বালানিসহ অন্যান্য পণ্যের দাম বর্তমানের অনুমানের চেয়েও বেশি বাড়তে পারে। সে ক্ষেত্র সংকট আরও ঘনীভূত হতে পারে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, যুদ্ধের কারণে বাণিজ্য ও উৎপাদন ব্যাঘাতের কারণে ২০২২ সালে ব্রেন্ট অপরিশোধিত তেলের দাম গড়ে প্রতি ব্যারেল ১০০ ডলার থাকবে। যা সালের পর সর্বোচ্চ। আর ২০২১ সালের তুলনায় ৪০ শতাংশ বাড়বে। ২০২৩ সালে তেলের ব্যারেল ৯২ ডলারে নেমে আসতে পারে। তখন পাঁচ বছরের গড় হিসাবে প্রতি ব্যারেল তেলের দাম ৬০ ডলারের উপরে থাকবে। কয়লার দাম ৮০ শতাংশ বাড়বে। এই সব দামই হবে সর্বকালের সর্বোচ্চ।
প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন বিশ্বব্যাংকের প্রসপেক্টস গ্রুপের পরিচালক আয়হান কোস। তিনি বলেন, ‘ইউক্রেনের যুদ্ধের কারণে পণ্যের বাজার কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় সরবরাহের ধাক্কার সম্মুখীন হচ্ছে। খাদ্য এবং শক্তির মূল্য বৃদ্ধির কারণে বিশ্বে বড় ধরনের মানবিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে এবং এটি দারিদ্র্য হ্রাসের অগ্রগতি স্থগিত করবে। উচ্চ দ্রব্যমূল্য ইতিমধ্যে বিশ্বজুড়ে মূল্যস্ফীতির চাপকে বাড়িয়ে তুলেছে।’
গমের দাম ৪০ শতাংশ বাড়ার পূর্বাভাস দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘এখনই গমের দাম সর্বকালের সর্বোচ্চ পর্যায়ে অবস্থান করছে। এর ওপর আরও বাড়লে পরিস্থিতি আরও নাজুক হবে। বিশেষ করে উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি করবে, যারা গম আমদানিতে পুরোপুরি রাশিয়া এবং ইউক্রেন নির্ভর করে। লৌহজাত পণ্যের (মেটাল) দাম বাড়বে ১৬ শতাংশের বেশি।’
বিশ্বব্যাংকের প্রসপেক্টস গ্রুপের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ জন ব্যাফেস বলেন, ‘বিশ্ব পণ্য বাজার প্রচণ্ড চাপের মধ্যে রয়েছে। কিছু পণ্যের দাম সর্বকালের সর্বোচ্চে পৌঁছেছে। এর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব পড়বে। খাদ্য উৎপাদনের অন্যতম প্রধান উপাদান জ্বালানি এবং সারের মূল্যের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি উন্নয়নশীল দেশগুলোতে খাদ্য উৎপাদন হ্রাস করতে পারে। যা খাদ্যের প্রাপ্যতা, গ্রামীণ আয় এবং দরিদ্রদের জীবিকাকে প্রভাবিত করবে।’
পণ্যের বাজারে যুদ্ধের প্রভাব সম্পর্কে গভীরভাবে অনুসন্ধান করা হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, যুদ্ধের প্রভাব কমপক্ষে দুটি কারণে পূর্ববর্তী ধাক্কাগুলোর চেয়ে দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে।
‘প্রথমত, অন্যান্য জীবাশ্ম জ্বালানির জন্য সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত শক্তির পণ্যগুলোকে প্রতিস্থাপন করার জন্য এখন কম জায়গা রয়েছে, কারণ দাম বৃদ্ধি সমস্ত জ্বালানিজুড়ে বিস্তৃতভিত্তিক হয়েছে।
‘দ্বিতীয়ত, কিছু পণ্যের দাম বৃদ্ধি অন্যান্য পণ্যের দামও বাড়িয়ে দিচ্ছে; উচ্চ প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম সারের দাম বাড়িয়েছে, কৃষি পণ্যের মূল্যের উপর ঊর্ধ্বমুখী চাপ সৃষ্টি করেছে। অন্যদিকে মূল্য বুদ্ধির লাগাম টেনে ধরতে সরকারগুলো এখন পর্যন্ত ট্যাক্স কাট (কর হ্রাস) এবং ভর্তুকিতে বেশি মনোযোগ দিয়েছে। যা প্রায়শই সরবরাহের ঘাটতি এবং দামের চাপকে বাড়িয়ে তোলে, চাহিদা কমাতে এবং সরবরাহের বিকল্প উৎসকে উৎসাহিত করার জন্য দীর্ঘমেয়াদী পদক্ষেপের চেয়ে।’
প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘এই যুদ্ধ বাণিজ্যের আরও ব্যয়বহুলকরে তুলেছে। যার ফলে দীর্ঘস্থায়ী মূল্যস্ফীতি হতে পারে। এটি জ্বালানি বাণিজ্যের একটি বড় পরিবর্তন ঘটাবে বলে মনে হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, কিছু দেশ এখন আরও প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে কয়লা কিনতে চাইবে। একইসঙ্গে কিছু প্রধান কয়লা আমদানিকারক অন্য বড় রপ্তানিকারকদের কাছ থেকে চাহিদা কমিয়ে রাশিয়া থেকে আমদানি বাড়াতে পারে। এটা সম্ভবত আরও ব্যয়বহুল হবে, কারণ, এতে পরিবহনের দূরত্ব বেশি হবে। প্রাকৃতিক গ্যাস ও তেলের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটবে।’
প্রতিবেদনের শেষে রাষ্ট্রপ্রধানদের তাদের নাগরিকদের এবং বৈশ্বিক অর্থনীতির ক্ষতি কমানোর জন্য অবিলম্বে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে বলা হয়েছে, ‘খাদ্য এবং জ্বালানি ভর্তুকির পরিবর্তে এখন লক্ষ্যযুক্ত সুরক্ষানেট প্রোগ্রাম (সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্ঠনী) যেমন- নগদ অর্থ প্রদান, স্কুল ফিডিং কর্মসূচি এবং কাজের সুযোগ সৃষ্টি হয়- এমন কর্মসূচি নিতে হবে।’