করোনা সংকট কেটে যাওয়ার পর দেশে পণ্য আমদানির ঋণপত্র বা এলসি খোলার পরিমাণ অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে।
চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) ৬ হাজার ৮৩৬ কোটি ১৮ লাখ (৬৮.৩৬ বিলিয়ন) ডলারের এলসি খুলেছেন ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা, যা গত অর্থবছরের পুরো সময়ের (২০২১ সালের জুলাই থেকে ২০২২ সালের জুন) চেয়েও ২ শতাংশ বেশি। আর একই সময়ের চেয়ে বেশি ৪৬ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ।
বর্তমান বিনিময়হার হিসেবে (প্রতি ডলার ৮৬ টাকা ২০ পয়সা) টাকার অঙ্কে চলতি অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে ৫ লাখ ৮৯ হাজার ২৬৩ কোটি টাকার এলসি খুলেছেন ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। এই অঙ্ক চলতি অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের প্রায় সমান।
২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটের আকার হচ্ছে ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই পণ্য আমদানির এলসি খুলতে এমন উল্লম্ফন দেখা যায়নি। আর এতে বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভও চাপের মধ্যে রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে আমদানির লাগাম টানার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুর ও মঞ্জুর হোসেন বলছেন, অপ্রয়োজনীয় খরচ কমাতে সরকার ও দেশবাসীর সতর্ক হওয়া প্রয়োজন।
বাংলাদেশ ব্যাংক সোমবার পণ্য আমদানির এলসি-সংক্রান্ত হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যাচ্ছে, এই ৯ মাসে গড়ে ৭ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারের এলসি খোলা হয়েছে।
অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসায় সেসব দেশের মানুষ আগের মতো পণ্য কেনা শুরু করেছেন। দেশের পরিস্থিতিও স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। সব মিলিয়ে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সব ধরনের পণ্যের চাহিদা ব্যাপক বেড়ে গেছে।
সে চাহিদা মাথায় রেখেই বাংলাদেশের ব্যবসায়ী-শিল্পোদ্যোক্তারা নতুন উদ্যমে উৎপাদন কর্মকাণ্ডে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। এ কারণেই শিল্পের কাঁচামাল, মধ্যবর্তী পণ্য, মূলধনি যন্ত্রপাতিসহ (ক্যাপিটাল মেশিনারি) সব ধরনের পণ্য আমদানি বেড়ে গেছে; বেড়েছে এলসি খোলার পরিমাণ।
এ ছাড়া বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল, খাদ্যপণ্যসহ অন্য সব পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় এলসি খুলতে বেশি অর্থ খরচ হচ্ছে বলে জানান তারা।
করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যেও গত ২০২০-২১ অর্থবছরে পণ্য আমদানির জন্য ৬ হাজার ৭০৪ কোটি (৬৭.০৪ বিলিয়ন) ডলারের এলসি খুলেছিলেন ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। ওই অঙ্ক ছিল আগের অর্থবছরের চেয়ে ১৯ দশমিক ৫০ শতাংশ বেশি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে জুলাই-মার্চ সময়ে এলসি খুলতে সবচেয়ে বেশি বিদেশি মুদ্রা খরচ হয়েছে রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাকশিল্পের কাঁচামাল কাপড় ও অন্য পণ্য আমদানিতে। এর পরিমাণ ৯৬৬ কোটি ৬০ লাখ (৯.৬৬ বিলিয়ন) ডলার, গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে যা ৪৩ দশমিক ৩১ শতাংশ বেশি।
সুতা আমদানির এলসি খোলা হয়েছে ৩৮৭ কোটি ৬ লাখ ডলারের; প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় দ্বিগুণ, ৯৩ দশমিক ৫৭ শতাংশ। তুলা ও সিনথেটিক ফাইবার আমদানির এলসি খোলা হয়েছে ৩৩২ কোটি ৯০ লাখ ডলারের। বেড়েছে ৩৫ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
রাসায়নিক দ্রব্য ও সার আমদানির জন্য এলসি খোলা হয়েছে ৪১৮ কোটি ১৮ লাখ ডলার। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭৫ দশমিক ৪২ শতাংশ। এ ছাড়া ওষুধের কাঁচামালের এলসি খোলা হয়েছে ৯১ কোটি ৯২ লাখ ডলারের; বেড়েছে ২০ দশমিক ২৫ শতাংশ।
শিল্পের মধ্যবর্তী কাঁচামাল আমদানির জন্য ৬৩৫ কোটি ৫১ লাখ ডলারের এলসি খুলেছেন ব্যবসায়ীরা। যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৪৯ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ বেশি।
মূলধনি যন্ত্রপাতি বা ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানির জন্য ৪০৭ কোটি ৭৩ লাখ ডলারের এলসি খুলেছেন ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা। বেড়েছে ৪৯ শতাংশ। শিল্পের মধ্যবর্তী পণ্যের জন্য এলসি খোলা হয়েছে ৫৫৪ কোটি ৮৩ লাখ ডলার; প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫৫ দশমিক ৭২ শতাংশ।
জুলাই-মার্চ সময়ে জ্বালানি তেল আমদানির জন্য ৩১৯ কোটি ১৯ লাখ ডলারের এলসি খোলা হয়েছে। বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি, ১২৯ দশমিক ১৩ শতাংশ।
খাদ্যপণ্যের মধ্যে চাল আমদানির এলসি খোলা হয়েছে ৩২ কোটি ৮৫ লাখ ডলারের; কমেছে ৫০ দশমিক ২৭ শতাংশ। গম আমদানির এলসি খোলা হয়েছে ১৭৩ কোটি ৯২ লাখ ডলার; প্রবৃদ্ধি ৪২ দশমিক ২৯ শতাংশ।
চিনি আমদানির এলসি খোলা হয়েছে ৮৭ কোটি ৫৪ লাখ ডলারের। প্রবৃদ্ধি ৭৮ দশমিক ৭৭ শতাংশ। ভোজ্যতেল আমদানির এলসি খোলা হয়েছে ১৬২ কোটি ৭১ লাখ ডলারের; বেড়েছে ৫৬ দশমিক ৬৩ শতাংশ।
এ ছাড়া অন্যান্য পণ্য ও শিল্প যন্ত্রপাতি আমদানির এলসি খোলা হয়েছে ১ হাজার ৮২০ কোটি ৭৬ লাখ ডলারের; বেড়েছে ৩৫ শতাংশ।
গত ২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে ৪৬ দশমিক ৮১ বিলিয়ন ডলারের এলসি খোলা হয়েছিল।
২০১৯-২০ অর্থবছরে বিভিন্ন পণ্য আমদানির জন্য মোট ৫৬ দশমিক ১০ বিলিয়ন ডলারের এলসি খোলা হয়েছিল, যা ছিল আগের (২০১৮-১৯) অর্থবছরের চেয়ে ১০ দশমিক ২১ শতাংশ কম।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর নিউজবাংলাকে বলেন, ‘লাগামহীন আমদানিতে বেশ চাপে পড়েছে দেশের অর্থনীতি। বৈদেশিক লেনদেনের চলতি ভারসাম্যের ঘাটতি (ব্যালান্স অফ পেমেন্ট) ১২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। অস্থির হয়ে উঠেছে ডলারের বাজার। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এই অর্থবছরে এখন পর্যন্ত সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার বাজারে ছাড়া হয়েছে। কিন্তু আমদানি বাড়ায় তারপরও চাহিদা মিটছে না।’
তিনি বলেন, ‘অনেক হয়েছে আর নয়। আমাদের কোমরের বেল্টটা এখন টাইট করতে হবে। যে করেই হোক আমদানি কমাতেই হবে। এ ছাড়া এখন আর অন্য কোনো পথ খোলা নেই।
‘সাধারণভাবে অর্থনীতিতে আমদানি বাড়াকে ইতিবাচকভাবে দেখা হয়ে থাকে। বলা হয়, আমদানি বাড়লে দেশে বিনিয়োগ বাড়বে, কর্মসংস্থান বাড়বে। এতদিন আমরাও সেটা বলে আসছি। কিন্তু এখন অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। ৫০ শতাংশ আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির ধাক্কা সামলানোর ক্ষমতা আমাদের অর্থনীতির নেই। এখন এটা কমাতেই হবে। তা না হলে বড় ধরনের সংকটের মুখে পড়ব আমরা।’
আহসান মনসুর বলেন, ‘দাম বাড়ায় সরকারের জ্বালানি তেলে ভর্তুকি কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। একই সঙ্গে গ্যাসে ভর্তুকি বেড়েছে, সারে বেড়েছে। বিদ্যুতে বেড়েছে। অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে এবার ভর্তুকি এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। সে ক্ষেত্রে বাজেট ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের চাপ পড়বে।’
এমন পরিস্থিতিতে করণীয় জানাতে গিয়ে দীর্ঘদিন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলে (আইএমএফ) গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করা আহসান মনসুর বলেন, ‘সরকারকে সাশ্রয়ী হতে হবে। একই সঙ্গে দেশের মানুষকেও সংকটের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে কম খরচ করতে হবে। আমাদের অনেক কিছুই কিন্তু জ্বালানি তেলের ওপর নির্ভরশীল। গ্যাস, বিদ্যুৎ, সার, পানি এসব উৎপাদনে তেলের প্রয়োজন হয়। এই সংকটের সময়ে এসব যদি মানুষ কম ব্যবহার করে।
‘পরিবহন খাতে যদি জ্বালানি তেলের ব্যবহার কমানো যায়, তাহলে আমদানি খাতে খরচ কমবে। সরকারের ভর্তুকি কমবে। অন্যদিকে বিলাসবহুল পণ্য যাতে কম আমদানি হয়, সেদিকে সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। প্রয়োজন নেই এমন পণ্য আমদানি থেকে এখন বিরত থাকতে হবে।’
এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে দেশবাসীর উদ্দেশে একটি দিকনির্দেশনা দেয়া উচিত বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) জ্যেষ্ঠ গবেষণা পরিচালক মঞ্জুর হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমদানির লাগাম টানতে ইতোমধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অতি প্রয়োজনীয় পণ্য ছাড়া অন্য সব পণ্য আমদানিতে এলসি মার্জিন ২৫ শতাংশ রাখার নির্দেশ দিয়েছে। আমি মনে করি, এটা একটা ভালো সিদ্ধান্ত। একই সঙ্গে পণ্য আমদানির আড়ালে বিদেশে টাকা পাচার হচ্ছে কি না, সেটাও খতিয়ে দেখতে হবে।’
দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্পমালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, ‘রপ্তানি বাড়ছে। এটা অব্যাহত রাখতে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানি করতেই হবে আমাদের। এখন বিলাসবহুল ও অপ্রয়োজনীয় পণ্য যাতে আমদানি না হয়, সেদিকে সরকারকে কঠোর হতে হবে।’
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ার ইউক্রেনে হামলার পর থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছিল তেলের দাম; একপর্যায়ে প্রতি ব্যারেলের দর ১৩৯ ডলারে গিয়ে ঠেকেছিল। এখন বিশ্ববাজারে তেলের দর নিম্নমুখী; তাও ১০০ ডলারের ওপরে অবস্থান করছে।
আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ার পর ডলারের দাম ক্রমেই বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে এবার জরুরি পণ্য ছাড়া বিলাস পণ্য আমদানি কমাতে চাইছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এদিকে দেরিতে হলেও বিলাস পণ্যের আমদানিতে লাগাম টেনে ধরেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত ১১ এপ্রিল এক সার্কুলারের মাধ্যমে শিশুখাদ্য, জ্বালানিসহ অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যপণ্য, জীবন রক্ষাকারী ওষুধ, স্থানীয় ও রপ্তানিমুখী শিল্প এবং কৃষি খাতসংশ্লিষ্ট পণ্য আমদানি ছাড়া অন্য সকল পণ্য আমদানির বিপরীতে ঋণপত্র স্থাপনের (এলসি) নগদ মার্জিন হার ন্যূনতম ২৫ শতাংশ সংরক্ষণের জন্য ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
রিজার্ভে টান
আমদানি বাড়ায় বাংলাদেশের বিদেশি রিজার্ভ বা সঞ্চয়নও কমছে। সোমবার দিন শেষে রিজার্ভ ছিল ৪৪ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার। প্রতি মাসে ৮ বিলিয়ন ডলার আমদানি খরচ হিসেবে এই রিজার্ভ দিয়ে পাঁচ মাসের কিছু বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।
অথচ গত বছরের আগস্টে বাংলাদেশের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচক ৪৮ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করেছিল, যা ছিল অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। ওই সময়ে প্রতি মাসে সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার আমদানি খরচ হিসেবে ১০ মাসের বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানোর রিজার্ভ ছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংকে।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রার মজুত থাকতে হয়।