ঈদের সুস্বাদু খাবারের একটি সেমাই। লাচ্চা সেমাই তৈরিতে দীর্ঘ দিনের সুনাম রয়েছে উত্তরের জেলা বগুড়ার। দক্ষ কারিগর থাকায় এখানকার উৎপাদিত লাচ্ছা, সাদা সেমাই সরবরাহ হয় দেশের বিভিন্ন জেলায়। এবারও ঈদ মৌসুমকে ঘিরে সেমাই কারখানাগুলোয় শুরু হয়েছে কর্মযজ্ঞ। কিন্তু কাঁচামালের দাম বৃদ্ধিতে এবার ক্রেতাদের সুস্বাদু এ খাবার কিনতে ব্যয় করতে হবে প্রায় দ্বিগুণ টাকা।
এর পরেও ঈদ মৌসুমকে ঘিরে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা ব্যবসার সম্ভাবনা দেখছেন জেলার সেমাই ব্যবসায়ীরা।
ব্যবসায়ী ও কারিগররা জানান, বগুড়ার লাচ্ছা সেমাইয়ের দেশব্যাপী সুখ্যাতি রয়েছে। গেল দুই বছর ছিল করোনার তাণ্ডব। সেই বিপদ কাটিয়ে উঠলেও সেমাইয়ের বাজারে দেখা দিয়েছে কাঁচামালের দাম বৃদ্ধির সংকট।
বগুড়ায় সেমাই প্রস্তুতের সঙ্গে বেকারি ব্যবসায়ীরা জড়িত। জেলায় এই বেকারি ব্যবসায়ীদের সংগঠনের নাম বাংলাদেশ ব্রেড বিস্কিট অ্যান্ড কনফেকশনারি দ্রব্য প্রস্তুতকারক সমিতি, উত্তরবঙ্গ পরিষদ।
সংগঠনটির তথ্যমতে, জেলায় এবারের ঈদ বাজারে অন্তত ১৫০ কারখানায় প্রায় সাড়ে ১৬ হাজার টন লাচ্ছা সেমাই উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। বিগত সময়গুলোয় এমনই উৎপাদন করা হয়েছে। এসব সেমাই উত্তরাঞ্চল ছাড়াও ঢাকা, চট্টগ্রাম, বরিশাল, সিলেটসহ দেশের সব জেলায় চলে যায়।
জেলায় ব্র্যান্ড (মোড়কজাত) কারখানা ৮ থেকে ১০টি। বাকিগুলো নন ব্র্যান্ড (খোলা বা বাঁশের খাচিতে)। এসব নন ব্র্যান্ড কারখানার অধিকাংশই মৌসুমী ব্যবসায়ী।
লাচ্ছা সেমাই ব্যবসায়ীরাই মৌসুমী নয়। বেশিরভাগ কারিগররা ঈদ মৌসুমে সেমাই তৈরি করেন। বাকি সময় অন্য পেশায় নিয়োজিত থাকেন।
এমন একজন শহরের বৃন্দাবন এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ রতন। তিনি ২০ বছর ধরে সেমাই তৈরির সঙ্গে জড়িত। প্রতিবারের মতো এবারও খাজা বেকারির কারখানায় সেমাই প্রস্তুত করছেন।
রতন বলেন, ‘দেশ স্বাধীনের আগে বিহারিরা বগুড়ায় সেমাই বানাত। তাদের কাছে থেকে বাঙালি শিখছে।’
কারখানায় সেমাই তৈরিতে কাজের অংশ ভাগ করা আছে। এ বিষয়টি ব্যাখ্যা করেন আরেক কারিগর রাহুল।
তিনি বলেন, ‘প্রত্যেক কারখানায় ৮ থেকে ১২ জনের একটি করে দল থাকে। এদের দু’জন খামির তৈরি করে। তিন থেকে চার জন সেমাইয়ের চাকা তৈরি করবে। আরও দু থেকে তিন জন সেই চাকা নিয়ে তেলে ভাজবে। বাকি কয়েক জন সেমাই খাচিতে তুলবে।’
এভাবে একটি দল প্রতিদিন প্রায় ১২ বস্তা আটা-ময়দার সেমাই প্রস্তুত করতে পারে বলে জানান কারিগররা।
উত্তরবঙ্গ পরিষদ জানায়, ঈদ মৌসুমে অন্তত সাড়ে তিন হাজার কারিগর সেমাই তৈরির কাজে জড়িত থাকে। ঈদের দুই সপ্তাহ আগে থেকে এই মৌসুম শুরু হয়। এ হিসেবে অন্তত ৪৫ দিন সেমাই তৈরির কাজ চলে।
কিন্তু চলতি মৌসুমে সব কারখানাতে লাচ্ছা সেমাই উৎপাদনে ব্যস্ততা বাড়লেও কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধিতে স্বস্তিতে নেই ব্যবসায়ীরা। খাজা বেকারির সেমাই তৈরির কারখানায় গেলে সেখানকার কারিগর ও ব্যবস্থাপকদের সঙ্গে কথা হয়। তারা এসব বিষয় জানান।
খাজা বেকারির লাচ্ছা সেমাইয়ের ব্যবস্থাপক সাব্বির হোসেন জানান, আগের বছর পাম অয়েলের দাম ছিল ড্রাম প্রতি ১৭ হাজার টাকা। এখন সেই পাম অয়েলের ড্রাম ব্যবসায়ীদের কিনতে হচ্ছে সাড়ে ২৮ হাজার টাকায়।
ডালডার অবস্থাও ঠিক একই। লাচ্ছা তৈরিতে এই ডালডা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। গত বছরে ডালডার ১৬ কেজির প্রতিটি কার্টুনের দাম ছিল ১ হাজার ৬০০ টাকা। দাম বেড়ে বর্তমানে প্রতি কার্টুনের দাম হয়েছে ২ হাজার ৭০০ টাকা।
এ ব্যবস্থাপক আরও জানান, আটার দাম বৃদ্ধিও থেমে নেই। আগের বছর ২০২১ সালে ৭৪ কেজির প্রতি বস্তা ময়দার দাম ছিল ২ হাজার টাকা। সেই ময়দার বস্তার এবারে ব্যবসায়ীদের কিনতে হচ্ছে সাড়ে ৩ হাজার টাকায়। অর্থ্যাৎ বস্তা প্রতি ময়দার দাম বেড়েছে ১ হাজার টাকা করে।
কাঁচামালের মূল্য বেশি হওয়ায় এবার উৎপাদন সীমিত করেছেন শহরের মালতিনগর এলাকার এক মৌসুমী সেমাই ব্যবসায়ী জাকির হোসেন। তিনি বলেন, ‘সব কিছুর দাম বাড়ছে। এতে করে বিক্রি হলেও লাভের পরিমাণ কম থাকে। তাই এবার সেমাই তৈরির পরিমাণ কমানো হয়েছে। শুধু নির্ধারিত কিছু কাস্টমারের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে সেমাই তৈরি করছি।’
কাঁচামালের দাম বৃদ্ধির প্রভাবে লাচ্ছা সেমাইয়ের দামও বেড়েছে। গত বছর নন ব্র্যান্ডের লাচ্ছা প্রতি কেজি ৬০ থেকে ৭০ টাকা পাইকারি দরে বিক্রি হয়েছিল। এবার সেই লাচ্ছার মূল্য ধরা হয়েছে ৯০ থেকে ১২০ টাকা। ব্র্যান্ডের বক্স লাচ্ছা ১৫০ থেকে ১৭০ টাকার জায়গায় এবার পাইকারি বিক্রি হবে ২০০ থেকে ২৪০ টাকায়।
এ ছাড়া গতবার ঘিয়ে ভাজা যে লাচ্ছা মানভেদে ৪০০ থেকে দেড় হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে। এবার সেই একই লাচ্ছা ব্যবসায়ীরা বিক্রি করছে ৬০০ থেকে ১ হাজার ৬০০ টাকায়।
বাজারের এসব বিষয় নিশ্চিত করেছেন জেলার উত্তরবঙ্গ সমিতির সহ সাধারণ সম্পাদক ও খাজা কনফেকশনারীর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) বায়েজিদ শেখ। তিনি বলেন, ‘বগুড়া লাচ্ছা সেমাই তৈরিতে দেশসেরা। এখানে প্রচুর দক্ষ কারিগর রয়েছে। এ জন্য স্থানীয় ব্র্যান্ডের প্রতিষ্ঠান ছাড়াও জাতীয় পর্যায়ে অনেক কোম্পানি সেমাই তৈরি করে নিয়ে যায়। এদের মধ্যে বনফুল, ড্যানিশ অন্যতম। এবারের মূল সংকট কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি।’
বায়েজিদ বলেন, ‘এ কারণে গত বছরের চেয়ে এবার ঈদে প্রায় দ্বিগুণ দামে লাচ্ছা সেমাই বিক্রি করতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের।’
কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি প্রভাবে সেমাই ব্যবসায়ীদের বেশি বিনিয়োগ করতে হচ্ছে। এতে তাদের লাভের পরিমাণ কমছে বলে মন্তব্য করেন এই ব্যবসায়ী নেতা।
বায়েজিদ শেখ বলেন, জেলায় এবার ১৫০টি কারখানায় প্রায় সাড়ে ১৬ হাজার টন সেমাই উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। পাইকারি দরে বিক্রি হলে এই সেমাইয়ের আর্থিক মূল্য আসে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা। এই পরিমাণ আয় হলেও লাভ খুব সীমিত হবে বলে ধারণা করছেন তিনি।
জেলা বিসিক কার্যালয়ের ডেপুটি মহাব্যবস্থাপক একেএম মাহফুজ রহমান বলেন, ‘বগুড়ায় প্রথমত কৃষি যন্ত্রপাতির তৈরিতে এগিয়ে আছে। এর পরের অবস্থানে সেমাই শিল্পকে ধরা হয়। এখানকার লাচ্ছা, চিকন সেমাই উত্তরের ১৬ জেলার পাশাপাশি দেশের প্রায় সবখানেই যায়।’
বিসিক কর্মকর্তা জানান, বগুড়ার সেমাইয়ের মান ভালো হওয়ায় ড্যানিশ, বনফুলের জেলার বিসিক এরিয়াতে কারখানা স্থাপন করেছে। এ কোম্পানিগুলো স্থানীয় কারিগরদের কাছে থেকে নিয়মিত সেমাই তৈরি করছে।
এ ছাড়াও স্থানীয় আকবরিয়া, শ্যামলীর লাচ্ছা সেমাই ঢাকা, চট্টগ্রামে সরবরাহ করা হয়।