পুঁজিবাজারে এক দিনে কোনো কোম্পানির শেয়ারের দরপতনের সর্বোচ্চ সীমা দুই শতাংশ থেকে বাড়িয়ে পাঁচ শতাংশ করার নির্দেশ জারির পর দিনও আবার উত্থান হলো পুঁজিবাজারে। সব মিলিয়ে এই তিন দিনে সূচকে যোগ হলো ১৭৮ পয়েন্ট। তবে এখন রমজানের আগের অবস্থান থেকে সূচক কম ৯৫ পয়েন্ট।
টানা তৃতীয় দিন সূচক বাড়ার ঘটনার স্বস্তির পাশাপাশি পুঁজিবাজারের জন্য ইতিচক যে বিষয়টি দেখা গেছে, সেটি হলো লেনদেন। চলতি সপ্তাহের শুরুতে লেনদেন যে অবস্থানে নেমেছিল, সেখান থেকে প্রায় দ্বিগুণে পৌঁছেছে তা।
রোজা শুরুর পর থেকে টানা নিম্নমুখি পুঁজিবাজারে যখন হতাশা গাঢ় হচ্ছিল, তখন মঙ্গলবার এক পর্যায়ে ৫৯ পয়েন্ট কমে গিয়েও লেনদেন শেষ করে ৪৭ পয়েন্ট বেড়ে। মন্দাভাব থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টার ইঙ্গিত সেদিনই ছিল। সেটি আরও স্পষ্ট হয় বুধবার আরও ৭৬ পয়েন্ট বাড়ার মধ্য দিয়ে।
এদিনই নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি শেয়ারের দরপতনের সর্বোচ্চ সীমা ২ শতাংশ করে দেয়া আদেশ সংশোধন করে জানায়, এখন থেকে এক দিনে সর্বোচ্চ পাঁচ শতাংশ দর কমতে পারবে। আর বৃদ্ধির সীমা আগের মতোই থাকবে ১০ শতাংশ।
ইউক্রেনে রুশ হামলার পর পুঁজিবাজারে ধস ঠেকাতে গত ৮ মার্চ এক দিনে দরপতনের সর্বোচ্চ সীমা ১০ থেকে ২ শতাংশে নামিয়ে আনে। তাৎক্ষণিকভাবে এই বিষয়টি বাজারের জন্য ইতিবাচক হিসেবে দেখা দিলেও পরে দেখা যায়, এটি লেনদেন কমে যাওয়ার একটি কারণ হিসেবে উঠে এসেছে।
পুঁজিবাজারে এক দিনে কোনো কোম্পানির ২ শতাংশ দরপতন মোটেও অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। দাম কমলে শেয়ারের চাহিদা বাড়লে আবার দর বাড়ার প্রবণতাও দেখা দেয়। কিন্তু ২ শতাংশের এই নির্দেশনা আসার পর দেখা যাচ্ছিল, ২ শতাংশ দাম কমে গেলে শেয়ারের আর ক্রেতা পাওয়া যায় না। এভাবে দিনের পর দিন কোম্পানিগুলোর দরপতন হচ্ছিল। আর ক্রেতা না থাকায় লেনদেন ক্রমেই কমছিল।
রোজা শুরুর আগে বাজারে এক হাজার এক শ কোটি টাকার বেশি লেনদেন হলেও গত ১৭ ও ১৮ এপ্রিল তা নেমে আসে চার শ কোটি টাকার ঘরে।
গত দুই দিন সূচকের পাশাপাশি লেনদেনও কিছুট গতি পেতে থাকে। এর মধ্যে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি ২ শতাংশের এই বাধা দূর করে আদেশ দেয়ার পর বাজার সংশ্লিষ্টরা একে ইতিবাচক আখ্যা দেন, যদিও ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের মধ্যে সংশয় ছিল যে, দরপতনের সর্বোচ্চ সীমা ৫ শতাংশ করার কারণে আবার দরপতন হয় কি না।
বৃহস্পতিবার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে লেনদেনের চিত্র
বৃহস্পতিবার লেনদেন শুরুর পর বিনিয়োগকারীরা যে সতর্ক ছিলেন, সেটাও বোঝা যায়। সকাল ১০টা ৪০ মিনিট পর্যন্ত সূচক বাড়তে থাকলেও এর পরের আধা ঘণ্টায় তা আবার পড়তে থাকে। তবে এরপর আবার ক্রয়চাপ তৈরি হয়। বেলা সোয়া ১১টা থেকে শেষ পর্যন্ত ঢেউয়ের মতো করে সূচক বাড়তে থাকে।
শেষ পর্যন্ত আগের তুলনায় সূচক বাড়ে ৫৫ পয়েন্ট। তবে শেষ মুহূর্তের সমন্বয়ের আগ মুহূর্তে সেটি বেড়েছিল ৬৪ পয়েন্ট।
দিন শেষে লেনদেন যা হয়েছে, সেটি চলতি মাস তথা রমজানের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। রোজায় বড় বিনিয়োগের আশ্বাস আসার পর প্রথম কর্মদিবসেই লেনদেন আগের কর্মদিবসের তুলনায় আড়াই শ কোটি টাকার বেশি কমে গিয়ে হয়েছিল ৮৩৬ কোটি ৬২ লাখ ৮৬ হাজার টাকা। আর আজ হাতবদল হয়েছে ৭৫৪ কোটি ৭ লাখ ৭৩ হাজার টাকা। আগের দিন লেনদেন ছিল ৬০৫ কোটি ৯৭ লাখ ১৬ হাজার টাকা।
রোববার এক দিনে ৩৪৭টি কোম্পানির দর কমেছিল। বিপরীত চিত্র দেখা গেছে আজ। যতগুলো কোম্পানি দর হারিয়েছে তার প্রায় ছয়গুণ কোম্পানির দর বেড়েছে। ৩০০টি শেয়ারের দাম বেড়ে ও ২৫টি অপরিবর্তিত দামে লেনদেন হয়েছে। বিপরীতে কমেছে ৫৫টির দর। এর মধ্যে বেশ কিছু কোম্পানির দর সমন্বয় হয়েছে লভ্যাংশ ইস্যুতে।
দর পতনের সীমা ২ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশে উন্নীতকরণ বাজারের জন্য ইতিবাচক হয়েছে বলে মনে করেন ট্রেজার সিকিউরিটিজের চিফ অপারেটিং অফিসার মোস্তফা মাহবুব উল্লাহ। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বাজারে একটা ফ্লেক্সিবিলিটি তৈরি হয়েছে। যার কারণে আগের দিনের চেয়ে প্রায় দেড় শ কোটি টাকা টার্নওভার বেড়েছে।’
তবে বাজার ঘুরে দাঁড়িয়েছে- এমন সিদ্ধান্তে এখনই আসতে চান না তিনি। বলেন, ‘বরং ঘুরে দাঁড়ানোর প্রক্রিয়ায় রয়েছে। লেনদেন ৮০০ থেকে ১২০০ কোটি টাকার মধ্যে চলে আসলে বলা যাবে বাজার ফিরেছে। এতে করে যারা টাকা ক্যাশ করে সাইডলাইনে আছেন, বাজার পর্যবেক্ষণ করছেন তারাও বাজারে ফিরবেন। ওই টাকাগুলোও বাজারে আসতে শুরু করবে।’
সূচক বাড়াল যেসব কোম্পানি
সূচকে সর্বোচ্চ ৪.৯৪ পয়েন্ট যোগ করেছে গ্রামীণফোন। কোম্পানিটির ০.৭৮ শতাংশ দর বৃদ্ধি পেয়েছে।
দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা আইসিবির দর বেড়েছে ৩.৪১ শতাংশ আর এতে সূচক বেড়েছে ৪.০১ পয়েন্ট।
রবির ১.৫৩ শতাংশ দর বৃদ্ধিতে সূচক বেড়েছে ৩.৮৩ পয়েন্ট। আর ১.১৭ শতাংশ দর বাড়ায় বেক্সিমকো সূচকে যোগ করেছে ২.১৮ পয়েন্ট।
এছাড়া ১ পয়েন্টের বেশি সূচক বাড়িয়েছে আইপিডিসি, লাফার্জ হোলসিম, এনআরবিসি ব্যাংক, বেক্সিমকো ফার্মা, ব্যাংক এশিয়া ও লঙ্কাবাংলা ফাইন্যান্স।সব মিলিয়ে এই ১০টি কোম্পানি সূচক বাড়িয়েছে ২৫.৩৫ পয়েন্ট।
বিপরীতে সবচেয়ে বেশি ৩.৩৬ পয়েন্ট সূচক কমিয়েছে প্রিমিয়ার ব্যাংক। প্রাইম ব্যাংকের ৪.৯৮ শতাংশ দর পতনে সূচক কমেছে ১.৮২ শতাংশ।
এছাড়া সূচক পতনে ভূমিকা রেখেছে ফরচুন শুজ, আল আরাফাহ ব্যাংক, ইউনাইটেড পাওয়ার, রেনাটা, মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক, সোনালী পেপার ও আইসিবি ইসলামী ব্যাংক। তবে কোনোটিই এক পয়েন্ট সূচক কমাতে পারেনি।
দর বৃদ্ধির শীর্ষ ১০
একমাত্র কোম্পানি হিসেবে বিডি কমের দর বেড়েছে দিনের সর্বোচ্চ। ৯.৭৩ শতাংশ দর বেড়ে প্রতিটি শেয়ার হাতবদল হয়েছে ৩৭ টাকা ২০ পয়সায়। আগের দিন শেয়ারদর ছিল ৩৩ টাকা ৯০ পয়সা।
এরপরেই আইডিসি ও এনআরবিসি ব্যাংকের দর বেড়েছে ৭ শতাংশ করে। আইপিডিসির প্রতিটি শেয়ার গতকাল লেনদেন হয় ৪৯ টাকা ৩০ পয়সায়। আজকে ৫৩ টাকা ৪০ পয়সায় বেচাকেনা হলেও শেষ পর্যন্ত দর দাঁড়িয়েছে ৫২ টাকা ৯০ পয়সায়।
আর এনআরবিসি ব্যাংকের শেয়ারদর সাত শতাংশ বেড়ে ২৪ টাকা ১০ পয়সায় হাতবদল হয়েছে। গতকাল এটি লেনদেন হয়েছে ২৩ টাকা ৯০ পয়সায়।
মোজাফ্ফর স্পিনিংয়ের ৬.৮২ শতাংশ, ইস্টার্ন লুব্রিক্যান্টসের ৬.২৫ শতাংশ, লঙ্কাবাংলা ফাইন্যান্সের ৫.৯৬ শতাংশ, এসইএমল লেকচার ইক্যুয়িটি ফান্ডের ৫.৮৮ শতাংশ দর বেড়েছে।
পাঁচ শতাংশের ওপর দর বেড়েছে এশিয়া প্যাসিফিক ইন্স্যুরেন্স, ইনটেক ও আমরা টেকনোলজিসের।
দর পতনের শীর্ষ ১০
এই তালিকার শীর্ষে প্রিমিয়ার ব্যাংককে দেখালেও আসলে এর দাম অতটা কমেনি।
পাঁচ শতাংশের বেশি দর কমার সুযোগ না থাকার পরও এই পরিমাণ দর কমার কারণ এর লভ্যাংশ সমন্বয়ের ইস্যু।
কোম্পানিটি এবার ১০ শতাংশ বোনাসের পাশাপাশি সাড়ে ১২ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে। বুধবার রেকর্ড ডেটে দাম ছিল ১৬ টাকা ২০ পয়সা। বোনাস সমন্বয়ে দাম হয় ১৪ টাকা ৬০ পয়সা। দর কমার সুযোগ ছিল ৬০ পয়সা। এই পরিমাণই কমেছে দাম।
ফলে ১৩.৫৮ শতাংশ দাম কমার বিষয়টি দেখালেও আসলে কমেছে ৩.৭০ শতাংশ।
দরপতনের দ্বিতীয় স্থানে দেখানো প্রাইম ব্যাংকের দরই আসলে সবচেয়ে বেশি ৪.৯৭ শতাংশ কমেছে। এই ব্যাংকটির বিনিয়োগকারীদের জন্য ঘোষণা করা শেয়ার প্রতি ১ টাকা ৭৫ পয়সা লভ্যাংশের রেকর্ড ডেট গেছে বুধবার।
সেদিন দর ছিল ২২ টাকা ১০ পয়সা। নগদ লভ্যাংশের ক্ষেত্রে দর সমন্বয়ের কিছু না থাকলেও দেশের পুঁজিবাজারে দাম কমার প্রবণতা দেখা যায়। এমনও দেখা যায়, যে পরিমাণ লভ্যাংশ দেয়ার ঘোষণা করা হয়, দাম কমে যায় তার চেয়ে বেশি। ফলে নগদ লভ্যাংশ নিলে শেষ পর্যন্ত বিনিয়োগকারীর আসলে লাভ হয় না।
তৃতীয় ও চতুর্থ অবস্থানে থাকা আইসিবিআই ব্যাংক ও ফ্যামিলি টেক্সটাইলের দর কমেছে ২০ পয়সা করে। ৫ টাকার নিচে লেনদেন হওয়ার কারণে এই কোম্পানি দুটির দর গত ৯ মার্চের পর থেকে কমতে পারেনি। আর দরপতনের সীমা পাঁচ শতাংশ হওয়ার পর এখন দর কমার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
শীর্ষ দশের অন্য কোম্পানিগুলো হলো বিআইএফসি, জিলবাংলা সুগার, ফরচুন সুজ, দুলামিয়া কটন, মেঘনা পেট ইন্ডাস্ট্রিজ, মেঘনা মিল্ক ও সোনারগাঁও টেক্সটাইল।
এই ১১টি কোম্পানির দরই কেবল ২ শতাংশের বেশি কমেছে।