টানা দরপতনের মধ্যে পরপর দুই দিনের উত্থানে বিনিয়োগকারীদের মনের চাপ কিছুটা হলেও কাটল। এর মধ্যে প্রথম দিনের তুলনায় সূচক আরও বাড়ল দ্বিতীয় দিন। এটি পুঁজিবাজারের ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত কি না, সেটি নিয়েও কথা হচ্ছে।
রমজানের প্রথম কর্মদিবস থেকেই পুঁজিবাজারে প্রায় প্রতিদিন দরপতনের কারণে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে হতাশা যখন চূড়ান্ত, তখন মঙ্গলবার আবার বড় পতন থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে ৪৭ পয়েন্ট বেড়ে শেষ হয় লেনদেন।
রোজার শুরু থেকে পতনের মধ্যে মাঝে এক দিন সূচক বাড়লেও পরে আবার পতনের ধারায় গিয়েছিল বাজার। এবার আর তা হয়নি। বুধবার শুরু থেকেই শেয়ারদর বেড়ে লেনদেন হতে থাকে। বেলা গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বড় মূলধনি কোম্পানিগুলোর শেয়ারদর বাড়ার কারণে সূচকে শেষ পর্যন্ত যোগ হয় ৭৬ পয়েন্ট, যদিও লেনদেন শেষ হওয়ার ক্ষণিক আগে তা ৮৯ পয়েন্ট বেড়ে গিয়েছিল। শেষ সময়ের সমন্বয়ে কিছুটা কমে সেখান থেকে।
দাম বেড়েছে ২৬৯টি কোম্পানির শেয়ারের, বিপরীতে কমেছে ৭৮টির আর অপরিবর্তিত থাকে ৩২টির দর।
রোজায় এই প্রথম টানা দুই দিন সূচক বাড়ল। আর এক দিনে সূচকের এই বৃদ্ধি গত প্রায় এক মাসে সর্বোচ্চ
লেনদেন ছয় কর্মদিবস পর ৬০০ কোটি টাকার ঘর অতিক্রম করল, যা চাঙা পুঁজিবাজারে আসলে আধা ঘণ্টার লেনদেন।
গত ২২ মার্চ ৭৯ পয়েন্ট সূচকের উত্থানের পর এটিই সবচেয়ে বড় উল্লম্ফন।
দুই দিনে ১২৩ পয়েন্ট বাড়লেও সূচকের অবস্থান রমজান শুরুর আগের অবস্থান থেকে অনেকটাই কম।
রোজা শুরুর আগের কর্মদিবসে সূচক ছিল ৬ হাজার ৭৫৭ পয়েন্ট, যা এখনকার অবস্থানের চেয়ে ১৫১ পয়েন্ট কম।
স্টক ডিলারদের সমিতি ডিবিএর সাবেক সভাপতি শরীফ আনোয়ার হোসেন মনে করেন, দরপতনের পর উত্থানই পুঁজিবাজারের বৈশিষ্ট্য। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বেশ কিছুদিন পতনের পরে কিছু কিনেছে। ধরুন, ৯০ টাকার শেয়ার ৮২ টাকায় নেমেছে, সেটা কিনবেই। যার কারণে কিছুটা বেড়েছে। এটা বাজারের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।’
তার মতে, দরপতনের সর্বোচ্চ সীমা ২ শতাংশ নির্ধারণ বাজারের টানা পতনের পেছনে ভূমিকা রেখেছে। তিনি বলেন, ‘আমি যদি লসে শেয়ার বিক্রি করি তো আরেকজন তো বসে আছে কম দামে শেয়ার কিনে প্রফিট করার জন্য। দরপতনের সীমা ২ শতাংশে নামিয়ে আনায় যিনি কিনবেন, তিনি আরও পড়ে কি না তা দেখার জন্য অপেক্ষায় ছিলেন। এভাবে দিনের পর দিন ক্রেতা কমছিল।’
ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের একটি সংগঠন নতুন করে সব শেয়ারের সর্বনিম্ন দাম বেঁধে দেয়া বা ফ্লোর প্রাইস দেয়ার যে দাবি করছে, তাও সমর্থন করছেন না শরীফ আনোয়ার। তিনি মনে করেন, পুঁজিবাজারের স্বাভাবিক গতিকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা কখনও ভালো হয় না।
তবে সূচক বাড়লেও বাজার এখনো ঘুরে দাঁড়ায়নি বলে মনে করেন ট্রেজার সিকিউরিটিজের চিফ অপারেটিং অফিসার মোস্তফা মাহবুব উল্লাহ। তিনি বলেন, ‘শেয়ারের দাম কমেছিল। কিছু শেয়ার কেনায় দাম কিছুটা বেড়ে সূচকে পয়েন্ট যোগ হয়েছে। আরও না বাড়া পর্যন্ত বলা যাচ্ছে না যে বাজার ঘুরে দাঁড়িয়েছে।’
সূচক বাড়াল যারা
সূচক বৃদ্ধিতে একক কোম্পানি হিসেবে সূচক সবচেয়ে বেশি বাড়িয়েছে রবি। কোম্পানিটির দর ৩.৮১ শতাংশ বাড়ার কারণে সূচকে যোগ হয়েছে ৯.০৪ পয়েন্ট।
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৬.৬৮ পয়েন্ট বাড়িয়েছে বেক্সিমকো লিমিটেড, যার দর বেড়েছে ৩.৭৯ শতাংশ।
এছাড়া আইসিবি ৩.০১, ওয়ালটন ২.৯২, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক ২.৭৩, গ্রামীণ ফোন ২.৫২, আইপিডিসি ২.২৯, বিএসসি ২.১৯, পূবালী ব্যাংক ১.৬৩ ও ফরচুন সুজ সূচক বাড়িয়েছে ১.৫৪ পয়েন্ট।
সব মিলিয়ে এই ১০টি কোম্পানিই সূচক বাড়িয়েছে ৩৪.৫৫ পয়েন্ট।
সার্কিট ব্রেকারের কাছাকাছি তিন কোম্পানির দর
রোজায় প্রথমবারের মতো এক দিনে একাধিক কোম্পানির শেয়ারদর সার্কিট ব্রেকার ছুঁয়ে লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৯.৯৮ শতাংশ বেড়েছে নতুন তালিকাভুক্ত কোম্পানি জেএমআই হসপিটাল। ২০ টাকায় লেনদেন শুরু করা কোম্পানিটি এক মাস যেতে না যেতেই ৭৩ হাজার ৮০ পয়সা হয়ে গেল।
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৯.৫৫ শতাংশ বেড়েছে আর্থিক খাতের কোম্পানি আইপিডিসির দর। আগের দিন দর ছিল ৪৫ টাকা। বাড়ার সুযোগ ছিল ৪ টাকা ৫০ পয়সা। সেই পর্যন্ত বেড়েও পরে সেখান থেকে ২০ পয়সা কমে ৪৯ টাকা ৩০ পয়সায় লেনদেন শেষ করেছে।
তৃতীয় সর্বোচ্চ ৯.৪৬ শতাংশ বেড়েছে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন-বিএসসির দর। এই কোম্পানিটিও সার্কিট ব্রেকার ছুঁয়ে কিছুটা কমে। আগের দিন দর ছিল ১০৫ টাকা ৭০ পয়সা। দর বাড়ার সুযোগ ছিল ১০ টাকা ৫০ পয়সা। এই পরিমাণ বেড়েও সেখান থেকে ৫০ পয়সা কমে শেষ করে লেনদেন।
এ ছাড়া বস্ত্র খাতের আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজের দর ৮.৯ শতাংশ, বিবিএসের দর ৮.৫১ শতাংশ, ঢাকা ব্যাংকের দর ৭.৫ শতাংশ, এবি ব্যাংকের দর ৫.৭১ শতাংশ, সোনালী পেপারের দর ৫.৬৪ শতাংশ, বিডি থাইয়ের দর ৫.৫৮ শতাংশ এবং ফরচুন সুজের দর ৫.৫৭ শতাংশ বেড়েছে।
শীর্ষ দশের বাইরে আরও তিনটি কোম্পানির দর ৫ শতাংশের বেশি, ১০টির দর ৪ শতাংশের বেশি, ২৫টির দর ৩ শতাংশের বেশি, ৬৬টি কোম্পানির দর বেড়েছে ২ শতাংশের বেশি।
দর পতনের সর্বোচ্চ সীমায় যেসব কোম্পানি
সবচেয়ে বেশি ১.৯৯ শতাংশ দর হারিয়েছে আরামিট ইন্ডাস্ট্রিজ। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির নির্দেশের বিপরীতে গিয়ে কোম্পানিটি পরিশোধিত মূলধন না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়ার পর থেকে দর ক্রমেই কমছে।
এই কোম্পানিটির মতোই সবচেয়ে বেশি দর হারানো ১০টি কোম্পানির মধ্যে সবগুলোই দর হারিয়েছে এক দিনে দরপতনের সর্বোচ্চ সীমা পর্যন্ত।
কোম্পানিগুলোর মধ্যে আছে, চলতি অর্থবছরের প্রান্তিক প্রতিবেদনে আয়ে ধস নামার তথ্য দেয়া সিঙ্গার বাংলাদেশ, বিমা খাতের তাকাফুল ইন্স্যুরেন্স, ডেফোডিল কম্পিউটারস, প্রান্তিক প্রতিবেদনে ব্যাপক আয় বৃদ্ধির তথ্য জানানোর পর মঙ্গলবার দামে উল্লম্ফন হওয়া ডরিন পাওয়ার, নিলামে বিক্রি হয়ে যাওয়া মিথুন নিটিং, ঋণ কেলেঙ্কারিতে ডুবে যাওয়া কোম্পানি ফাস ফাইন্যান্স, বিমা খাতের বিএনআইসিএল, প্রাইম ব্যাংক এবং পাট খাতের লোকসানি কোম্পানি জুট স্পিনার্স।