স্রোতের মতো আসছে বিদেশি ঋণসহায়তা; স্বস্তিতে সরকার। এর মধ্যে হয়েছে ঋণসহায়তায় নতুন রেকর্ড।
চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে প্রায় ৬৮০ কোটি (৬.৮০ বিলিয়ন) ডলারের ঋণসহায়তা পেয়েছে বাংলাদেশ।
বর্তমান বিনিময়হার হিসাবে (প্রতি ডলার ৮৬ টাকা ২০ পয়সা) টাকার অঙ্কে এই অর্থের পরিমাণ প্রায় ৫৮ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৫৫ দশমিক ১৬ শতাংশ বেশি।
এর আগে ৯ মাসে এত বেশি বিদেশি ঋণসহায়তা কখনই আসেনি দেশে।
শ্রীলঙ্কায় অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের পর বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ নিয়েও নানা কথা হচ্ছে, যদিও দুই দেশের কোনো তুলনাই চলে না। বাংলাদেশে জিডিপির তুলনায় এই ঋণ এখনও ১৩ শতাংশের নিচে, আর শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রে তা ৫০ শতাংশের কাছাকাছি।
অর্থ সচিব আব্দুর রউফ তালুকদার ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব ফাতিমা ইয়াসমিন নিউজবাংলাকে বলেন, বাংলাদেশের বিদেশি ঋণের সুদের হার খুবই কম। বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি খুবই ভালো অবস্থায় আছে; প্রতিটি সূচক ঊর্ধ্বমুখী। শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তান মিলিয়ে যা রিজার্ভ আছে, বাংলাদেশের তার দ্বিগুণেরও বেশি আছে। শ্রীলঙ্কার ভুল একটাও করেনি বাংলাদেশ। তাই বিদেশি ঋণ নিয়ে কোনো সমস্যা নেই বাংলাদেশের। কম সুদের বিদেশি ঋণ যত বাড়বে, বাংলাদেশের উন্নয়ন ততই ত্বরান্বিত হবে।
ইআরডি সোমবার বিদেশি ঋণসহায়তার প্রতিশ্রুতি ও ছাড়ের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশকে ৫৪৩ কোটি ১০ লাখ ৩০ হাজার (প্রায় ৫.৪৩ বিলিয়ন) ডলার ছাড় করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল দাতারা। পাওয়া গেছে ৬৭৯ কোটি ৬৮ লাখ ৩০ হাজার (প্রায় ৬.৮০ বিলিয়ন) ডলার।
এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, জুলাই-মার্চ দাতারা বাংলাদেশকে যে ঋণ দিতে চেয়েছিল তার থেকেও ২৫ দশমিক ১৫ শতাংশ বেশি ছাড় করেছে। বিদেশি ঋণসহায়তা প্রাপ্তিতে এমনটা খুব কমই দেখা যায়।
ছাড় করা ঋণের মধ্যে ৬৬১ কোটি ৬০ লাখ ডলার পাওয়া গেছে প্রকল্প সাহায্য হিসেবে। ১৮ কোটি ৮ লাখ ১০ হাজার ডলার পাওয়া যায় অনুদান। এর মধ্যে ২৫ লাখ ৩০ হাজার ডলার খাদ্য অনুদান এবং ১৭ কোটি ৮২ লাখ ৮০ হাজার ডলার প্রকল্প অনুদান হিসেবে পাওয়া গেছে।
২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে ৪৩৮ কোটি ৬ লাখ ১০ হাজার (৪.৩৮ বিলিয়ন) ডলার ছাড় করে দাতারা। সে হিসাবেই এই ৯ মাসে বিদেশি ঋণসহায়তা বেড়েছে ৫৫ দশমিক ১৬ শতাংশ।
প্রতিশ্রুতি বেড়েছে ৩৬.৫১ শতাংশ
ইআরডির তথ্যে দেখা যায়, গত অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে ৩৯৭ কোটি ৮৪ লাখ ৮০ হাজার (৩.৯৮ বিলিয়ন) ডলারের ঋণসহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল দাতারা। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে সেই প্রতিশ্রুতির চেয়ে ৩৬ দশমিক ৫১ শতাংশ বাড়িয়ে ৫ দশমিক ৪৩ বিলিয়ন ডলার করেছে।
সুদ পরিশোধ বেড়েছে ১০.২৫ শতাংশ
এই ৯ মাসে আগে নেয়া ঋণের আসল ও সুদ পরিশোধের পরিমাণ বেড়েছে ১০ দশমিক ২৫ শতাংশ। এ সময়ে সরকার আসল ও সুদ বাবদ উন্নয়ন সহযোগীদের ১৫৯ কোটি ৫৪ লাখ ডলার শোধ করেছে। গত অর্থবছরে একই সময়ে এই অঙ্ক ছিল ১৪৪ কোটি ৭০ লাখ ডলার।
ইআরডির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে ৭১০ কোটি (৭.১ বিলিয়ন) ডলার ঋণসহায়তা পেয়েছিল বাংলাদেশ। তার আগে ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বিদেশি ঋণ আসে বাংলাদেশে। ওই বছর ৭৩৮ কোটি (৭.৩৮ বিলিয়ন) ডলার ঋণ পাওয়া গিয়েছিল।
বাংলাদেশে বিদেশি ঋণ বাড়তে থাকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে। ওই বছরই এক লাফে অর্থছাড় ৩০০ কোটি থেকে ৬৩৭ কোটি ডলারে উন্নীত হয়। তারপর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এসেছিল ৬৫৪ কোটি ডলার।
‘বাংলাদেশ কখনই শ্রীলঙ্কা হবে না’
বাংলাদেশ কেন শ্রীলঙ্কা হবে না- তার পক্ষে যুক্তি ও তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরেন অর্থ সচিব রউফ তালুকদার। তিনি বলেন, “গত ১৩ বছরে বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় আছে। তার সুফল অর্থনীতি পাচ্ছে। আমাদের অর্থনীতির ‘থ্রি আর’ আরএমজি, (তৈরি পোশাক), রেমিট্যান্স এবং রাইস (চাল বা ধান) চমক দেখিয়ে চলেছে। বছরের পর বছর ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। তৈরি পোশাকের রপ্তানি বেড়েছে ৪০ শতাংশ। রেমিট্যান্সও ইতিবাচক ধারায় আছে। এই তিন খাতেই শ্রীলঙ্কা নাজুক অবস্থায় আছে, সংকটে আছে। সে কারণেই তাদের এই বিপদ এসেছে।”
তিনি বলেন, ‘মহামারি করোনার ধাক্কা দ্রুত কাটিয়ে উঠেছি আমরা। পৃথিবীর অনেক দেশই তা পারেনি। গত অর্থবছরে আমরা ৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছি। চলতি অর্থবছরে ৭ দশমিক ২ শতাংশের বেশি অর্জিত হবে। রাজস্ব আদায়ে ১৫ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বেড়ে ১১ শতাংশে উঠেছে।
‘সব মিলিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি শক্ত মজবুত ভিক্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থায় আছে বাংলাদেশের অর্থনীতি।’
ইআরডি সচিব ফাতিমা ইয়াসমিন শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে বলেন, ‘আমাদের বিদেশি ঋণ জিডিপির ১২ শতাংশ; আর শ্রীলঙ্কার ৪৮ শতাংশ। আমাদের ঋণের সুদের হার মাত্র ১ দশমিক ৪ শতাংশ। শ্রীলঙ্কার ১২ শতাংশ। শ্রীলঙ্কার বিদেশি ঋণের পরিমাণ ৩৫ বিলিয়ন ডলার। আমাদের ৫০ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশের ঋণ ঝুঁকিমুক্ত। শ্রীলঙ্কাকে প্রতি বছর সুদ-আসল বাবদ ৭ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতে হয়। আমাদের করতে হয় আড়াই বিলিয়ন ডলার।’
আরেকটি বিষয় হচ্ছে, আমাদের কোনো সভরেন বন্ড ঋণ নেই, বাণিজ্যিক ঋণ নেই। আমাদের ঋণ পরিশোধ নিয়ে কোনো ঝুঁকি নেই। আগামী ১০ বছর ঋণ পরিশোধে কোনো সমস্যা নেই বাংলাদেশের। অথচ শ্রীলঙ্কার এক কিস্তি শোধ করারও ক্ষমতা নেই।’