বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারের দর সর্বোচ্চ উচ্চতায় উঠেছে। রোববার আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলারের জন্য ৮৫ টাকা ১০ পয়সা গুণতে হয়েছে।
এর আগে কখনই এক ডলারের জন্য এতো টাকা খরচ করতে হয়নি। গত বছর দেশে করোনাভাইরাস মহামারি দেখা দেয়ার আগে ফেব্রুয়ারিতে ডলারের দর ৮৪ টাকা ৯৫ পয়সায় উঠেছিল, যা ছিল এ যাবৎকালের ডলারের সবচেয়ে শক্তিশালী অবস্থান।
রোববার সে রেকর্ড ভেঙে বাংলাদেশি মুদ্রা টাকাকে দুর্বল করে দিয়ে আরও শক্তিশালী হয়েছে ডলার। গত দুই সপ্তাহ ধরে প্রতিদিনই টাকার মান কমেছে; শক্তিশালী হয়েছে ডলার।
তবে এতে উদ্বেগের কোনো কারণ নেই বলে মনে করছেন অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলছেন, টাকার মান কমার এই প্রবণতা রেমিট্যান্স ও রপ্তানি বাণিজ্যের জন্য ভালো। বাংলাদেশ ব্যাংক বাজারে হস্তক্ষেপ করে ‘একদম’ ঠিক কাজটি করছে। আরও আগেই এই কাজটি করা উচিৎ ছিল।
আর রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্পমালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেছেন, ডলারের বিপরীতে টাকা আরও খানিকটা অবমূল্যায়িত হলে করোনার এই কঠিন সময়ে রপ্তানি বাণিজ্য ঘুরে দাঁড়াতে সহায়তা হতো।
এক বছরেরও বেশি সময় ধরে যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারের বিপরীতে টাকার মান একই জায়গায় স্থির ছিল। আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলারের জন্য গুণতে হতো ৮৪ টাকা ৮০ পয়সা।
আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বাড়তে শুরু করে। এখন প্রতিদিনই বাড়ছে। খোলাবাজারের পাশাপাশি ব্যাংকগুলোতেও দর বাড়ছে।
গত দুই সপ্তাহের ব্যবধানে ডলারের বিপরীতে ৩০ পয়সা দর হারিয়েছে টাকা। গত ৫ আগস্ট আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে এক মার্কিন ডলারের জন্য ৮৪ টাকা ৮০ পয়সা খরচ করতে হয়েছে। রোববার সেই ১ ডলারের জন্য ৮৫ টাকা ১০ পয়সা খরচ করতে হয়েছে।
রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক রোববার ৮৭ টাকা দরে ডলার বিক্রি করেছে। কিনেছে ৮৪ টাকা ৬০ পয়সায়। জনতা ব্যাংক কিনেছে ৮৪ টাকা ৫০ পয়সায়। বিক্রি করেছে ৮৭ টাকায়। অগ্রণী ব্যাংক ৮৬ টাকা ৯০ পয়সায় ডলার বিক্রি করেছে; কিনেছে ৮৪ টাকা ৫০ পয়সা দিয়ে।
রোববার খোলাবাজারে প্রতি ডলার বিক্রি হয়েছে ৮৭ টাকা ৮০ পয়সায়। ক্রয় মূল্য ছিল ৮৭ টাকা ২০ পয়সা।
গত বছর দেশে করেনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার পর সংক্রমণ ঠেকাতে দেশব্যাপী লকডাউন ঘোষণার একদিন আগে ২৫ মার্চ আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে টাকা-ডলারের বিনিময় হার ছিল ৮৪ টাকা ৯৫ পয়সা। ৩০ জুন তা কমে ৮৪ টাকা ৮০ পয়সায় নেমে আসে। এরপর থেকে ৪ আগস্ট পর্যন্ত ১ ডলারের জন্য ৮৪ টাকা ৮০ পয়সাই লেগেছে।
করোনা মহামারির এই কঠিন সময়ে ডলারের দর বাড়েওনি, কমেওনি। এর আগে বাংলাদেশে কখনও এতো দীর্ঘ সময় ধরে টাকা-ডলারের বিনিময় হার একই থাকেনি।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআইবি) নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান এইচ মনসুর নিউজবাংলাকে বলেন, আমদানি বাড়ায় ডলারের দাম বাড়তে শুরু করেছে। গত অর্থবছরে প্রচুর রেমিট্যান্স আসায় ডলারের সরবরাহ বেড়ে গিয়েছিল। চলতি অর্থবছরে তেমনটি থাকবে বলে মনে হয় না। ইতোমধ্যে তার লক্ষণও দেখা যাচ্ছে। অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে রেমিট্যান্স বাড়েনি। চলতি আগস্ট মাসেও ধীরগতির আভাস পাওয়া যাচ্ছে। অন্যদিকে আমদানি অনেক বেড়ে গেছে।
তিনি বলেন, ‘সবমিলিয়ে ডলারের চাহিদা বেড়ে গেছে। আর চাহিদা বাড়লে যে কোনো পণ্যের দাম যেমন বাড়ে; ডলারের দামও তেমনি বাড়ছে। এটাই স্বাভাবিক। আর এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক বাজারে হস্তক্ষেপ করে ডলারের দাম বাড়ার সুযোগ করে দিয়ে ঠিক কাজটিই করছে বলে আমি মনে করি।
‘এর ফলে রপ্তানি খাতের ব্যবসায়ীরা সুবিধাজনক অবস্থায় আছেন। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সেও ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। টাকার মান বেড়ে গেলে অর্থনীতির এই দুই সূচকে নেতিবাচক প্রভাব পড়ত।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, শিল্পের কাঁচামাল, মূলধনী যন্ত্রপাতি – সব ধরনের পণ্যের আমদানি বাড়ছে। ইউরোপ-আমেরিকাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসছে। বাংলাদেশে করোনানার মধ্যেই পুরোদমে উৎপাদন কর্মকাণ্ড চলছে। সব মিলিয়ে আমদানি বাড়াটাই স্বাভাবিক। আর এটা অর্থনীতির জন্য মঙ্গল।
তিনি বলেন, ‘সব মিলিয়ে ডলারের চাহিদা বাড়ায় দাম বাড়ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারের চাহিদা অনুযায়ী, ডলার বিক্রি করছে। এতোদিন বাজার স্থিতিশীল রাখতে ডলার কেনা হয়েছিল, এখন সেই একই কারণে বিক্রি করা হচ্ছে। এই কাজটি বাংলাদেশ ব্যাংক সব সময়ই করে থাকে। যখন যেটা প্রয়োজন, সেটাই করা হয়।’
খোলাবাজারের ডলার ব্যবসায়ী মোহাম্মদ রিপন নিউজবাংলাকে বলেন, কোরবানির ঈদের পর লকডাউন তুলে নেয়ার পর থেকেই ডলারের দাম বাড়ছে। ৮৬ টাকা থেকে বাড়তে বাড়তে ৮৭ টাকা ৮০ পয়সায় উঠেছে।
ডলার বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক
রেমিট্যান্স বাড়ায় ও আমদানি কমায় বাজারে ডলারের সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় গত ২০২০-২১ অর্থবছরে ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে সবমিলিয়ে প্রায় ৮ বিলিয়ন (৮০০ কোটি) ডলার কিনেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক, যা ছিল অতীতের যে কোনো বছরের চেয়ে বেশি।
মহামারির মধ্যে ব্যবসায় মন্দাজনিত কারণে আমদানি কমে যায়। পাশাপাশি, প্রাবসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের উল্লম্ফন এবং রপ্তানি আয় বাড়ার কারণে দেশের ব্যাংকিং খাতে প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত ডলার জমা হতে থাকে। এ পরিস্থিতিতে বাজার স্থিতিশীল রাখতে ডলার কেনার এই রেকর্ড গড়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এর আগে, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৫ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার কিনেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। গত অর্থবছরের আগে সেটিই ছিল সর্বোচ্চ ডলার কেনার রেকর্ড।
অথচ এখন ডলার না কিনে উল্টো বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চাহিদা বাড়ায় বাজার স্বাভাবিক রাখতেই ডলার বিক্রি করা হচ্ছে।
সিরাজুল ইসলাম বলেন, গত বৃহস্পতিবার ৫ কোটি ডলার বিক্রি করা হয়েছে। চাহিদা পূরণে যতো ডলার প্রয়োজন হবে, ততোটাই বিক্রি করা হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, ২০১৪ সালের আগস্টে ডলারের আন্তঃব্যাংক মুদ্রা বিনিময় হার ছিল ৭৭ টাকা ৪০ পয়সা। ২০১৫ সালের আগস্টে এই দর বেড়ে হয় ৭৭ টাকা ৮০ পয়সা। ২০১৬ সালে আগস্টে ডলারের দর ছিল ৭৮ টাকা ৪০ পয়সা।
২০১৭ সালের আগস্টে ডলারের দর বেড়ে হয় ৮০ টাকা ৭০ পয়সা। ২০১৮ সালের আগস্টে ডলারের দর ৮৩ টাকা ৭৫ পয়সা হয়।
২০১৯ সালের ১২ জানুয়ারি ডলারের দর ছিল ৮৪ টাকা ৯০ পয়সা। তবে এর পরপরই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপে ডলারের দর আবার আগের অবস্থানে ফিরে আসে।
তবে ওই বছরের ডিসেম্বর নাগাদ ডলারের দর একটু একটু করে বেড়ে আবার ৮৪ টাকা ৯০ পয়সায় উঠে আসে।
তবে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত ডলারের দর ছিল ৮৪ টাকা ৯৫ টাকা। জুন মাসে ওই দর কমে ৮৪ টাকা ৮৫ পয়সায় নেমে আসে। এর পর থেকে ডলারের দর চলতি বছরের ৪ আগস্ট পর্যন্ত ৮৪ দশমিক ৮০ টাকায় স্থির ছিল।