মাইক্রোট্রেড গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ইনভ্যারিয়েন্ট টেলিকম বাংলাদেশ লিমিটেড পরিচালিত একটি ই-কমার্স সাইট ধামাকা শপিং ডটকম। প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে পণ্য সরবরাহকারী সেলার বা মার্চেন্টের ভূমিকায় থেকে ব্যবসা করত ৬৫০ এসএমই উদ্যোক্তা।
চলতি বছর মার্চ থেকে জুলাই পর্যন্ত ধামাকায় পণ্য সরবরাহ করে মার্চেন্টদের পাওনা হয়েছে মোট ২০০ কোটি টাকা। বারবার ধর্ণা দিয়েও মার্চেন্টরা পাচ্ছেন না এই টাকা।
ভুক্তভোগী মার্চেন্টদের আশঙ্কা দেশে ই-কমার্স খাতে অরাজকতার সুযোগ নিয়ে ধামাকা শপিং ডটকম কর্তৃপক্ষ তাদের কষ্টার্জিত টাকা অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছে। এমনকি তারা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে পারে এমন আশংকাও রয়েছে।
কেউ যাতে দেশ ছেড়ে চলে যেতে না পারে, সে জন্য মাইক্রোট্রেড গ্রুপ ও ধামাকা শপিং ডটকমের চেয়ারম্যান ডা. এম আলী ওরফে ডা. মোজতবা আলী এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) জসীম উদ্দিন চিশতির বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞার আদেশ দিতে অনুরোধ জানিয়েছেন মার্চেন্টরা।
গত ১৬ আগস্ট বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির কাছে ৬৫০ মার্চেন্টদের পক্ষ থেকে এমন আবেদনের একটি চিঠি দেয়া হয়েছে।
চিঠিতে চেয়ারম্যান ও এমডি ছাড়াও ধামাকা শপিং ডটকমের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) সিরাজুল ইসলাম রানা, প্রধান ব্যবসা কর্মকর্তা দেবকর দে শুভ, ডিএমডি নাজিম উদ্দিন আসিফ, পরিচালক অপারেশন সাফোয়ান আহমেদ, এজিএম ও হেড অফ অ্যাকাউন্টস আমিরুল হোসাইন, ডেপুটি ম্যানেজার ও সিস্টেম ইঞ্জিনিয়ার আসিফ চিশতি, ক্যাটাগরি হেড ইমতিয়াজ হাসান, ভাইস প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম স্বপন ওরফে মিঠু খান এবং মাইক্রোট্রেড গ্রুপের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক নিরোধ বরণ রায় এফসিএ-এরও বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা আদেশ চাওয়া হয়েছে।
পাশাপাশি সবার ব্যা্ংক হিসাব জব্দ করা এবং তারা যাতে তাদের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রি করতে না পারেন, সে জন্যে নির্দেশনা জারি করতে অনুরোধ করেছেন মার্চেন্টরা। তারা আরও অনুরোধ করেছেন, তাদের পাওনা টাকা আদায়ে যেন ব্যবস্থা নেয়া হয়।
এ বিষয়ে মন্ত্রীর দপ্তরে যোগাযোগ করা হলে জানা যায়, দাপ্তরিক কাজে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি এখন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডিজিটাল ই-কমার্স সেলের প্রধান ও ডব্লিউটিও সেলের মহাপরিচালক অতিরিক্ত সচিব হাফিজুর রহমানের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি নিউজবাংলাকে জানান, ধামাকা শপিং ডটকমের সঙ্গে পণ্য সরবরাহের ব্যবসা করত এমন কিছু মার্চেন্টের একটা আবেদন পাওয়া গেছে।
তবে এ ইস্যুতে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে গেলে সমন্বিত আলোচনার বিষয় আছে। সরকারের দায়িত্বশীল সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সহযোগিতারও দরকার আছে। আমরা যত দ্রুত সম্ভব সার্বিক দিক পর্যালোচনা করে দেখব, কী করা যায়।
২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে ধামাকা শপিং ডটকমের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী পণ্য সরবরাহ করে যাচ্ছিল ৬৫০ মার্চেন্ট।
ইনভ্যারিয়েন্ট টেলিকম বাংলাদেশ লিমিটেডের সঙ্গে এই চুক্তি সম্পন্ন হয়। চুক্তি অনুযায়ী, ধামাকা শপিং ডটকম থেকে পণ্য সরবরাহের অর্ডার কপি পাওয়ার পর পণ্য সরবরাহ করা হতো। একই সঙ্গে তাদের নির্দেশিত গ্রাহকদের পণ্য দিয়ে বিল সাবমিট করা হতো।
বিল সাবমিটের ১০ কার্যদিবসের মধ্যে টাকা প্রত্যেক মার্চেন্টকে পরিশোধের কথা রয়েছে, কিন্তু চলতি বছর মার্চ থেকে হঠাৎ ধামাকা চুক্তি লঙ্ঘন শুরু করে। এর ফলে সব মার্চেন্টের ২০০ কোটি টাকা পাওনা জমা হয়েছে।
১০ কার্যদিবসের মধ্যে প্রত্যেক মার্চেন্টের পাওনা পরিশোধের কথা থাকলেও সেটি এখন ১৫০ কার্যদিবস ছাড়িয়ে গেছে।
চিঠিতে বলা হয়েছে, পাওনা টাকা আদায়ে মার্চেন্টরা সব রকম চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কিন্তু তাতে কোনো সুফল আসেনি। প্রথম দিকে আশ্বাস মিলেছে টাকা পরিশোধের। একাধিকবার সময়সীমা দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, ওই সময়ের মধ্যে অন্তত আংশিক টাকা পরিশোধ করা হবে। কিন্তু সময়সীমা পেরিয়ে গেলেও কোনো পাওনা পরিশোধ করা হয়নি। এখন প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক থেকে শুরু করে কোনো কর্মকর্তারই হদিস পাচ্ছেন না মার্চেন্টরা। এমনকি ধামাকা শপিং ডটকমের ৪৩ মহাখালী আকুয়া টাওয়ার (লেভেল ৮) ঢাকার অফিস কার্যক্রমও বন্ধ রয়েছে।
চিঠিতে দাবি করা হয়, মাইক্রোট্রেড গ্রুপের চেয়ারম্যান ডা. এম আলী ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক জসীম উদ্দিন চিশতি প্রতিষ্ঠানের সব কর্মকর্তা, উপদেষ্টা, ব্যবস্থাপনা টিম, পরিচালনা পর্ষদ পরস্পর যোগসাজশ করে প্রতিষ্ঠানের বিপুল অর্থ অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছেন।
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, পাওনা অর্থ উদ্ধারের জন্যে প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বরত কর্মকর্তা ও পরিচালন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বারবার যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু সাড়া পাওয়া যায়নি। সর্বশেষ চলতি বছরের ১৩ জুলাই ১২টা ২১ মিনিটে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে তারা ভার্চুয়ালি কথা বলার সুযোগ পান। তখন ব্যবস্থাপনা পরিচালক জসীম উদ্দিন চিশতি প্রতিশ্রুতি দেন, কোরবানির ঈদের আগে পাওনা টাকার অংশবিশেষ প্রদান করবেন। কিন্তু ভার্চুয়্যাল সভার পর ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা কোম্পানির মালিকপক্ষের কাউকে মার্চেন্টরা আর খুঁজে পাননি।
ঈদের দিন (২১ জুলাই) রাত ৮টায় কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফেসবুক লাইভে এসে তাদের অসহায়ত্ব প্রকাশ করেন। তিনি প্রতিশ্রুতি দেন, পাওনার ১০ শতাংশ আগস্ট মাসে পরিশোধ করা হবে। কিন্তু এখনও পাওনা পরিশোধ হয়নি।
মার্চেন্টরা দাবি করেন, নগদ অর্থ ধামাকা শপিং ডটকমে ফেলে রেখে এখন তারা চরম বিপাকে পড়েছেন। আত্মীয়-স্বজন ও ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে নগদ অর্থ খাটিয়েছেন ধামাকার পণ্য সরবরাহের ব্যবসায়। এখন টাকার অভাবে বন্ধ হয়ে গেছে তাদের ব্যবসা। পরিবার-পরিজন নিয়ে তাদের এখন রাস্তায় দাঁড়ানোর উপক্রম।
এমন পরিস্থিতির কথা জানিয়ে চিঠিতে পাওনা উদ্ধারে তারা বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির দ্রুত হস্তক্ষেপ দাবি করেছেন।
এসব অভিযোগের বিষয়ে ধামাকা শপিং ডটকম কী বলছে জানতে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হয় চেয়ারম্যান ডা. এম মোজতবা আলী ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক জসীম উদ্দীন চিশতির সঙ্গে। বারবার চেষ্টা করে এবং ম্যাসেজ পাঠিয়ে পরিচয় দিয়েও তাদের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
তবে একই পদ্ধতিতে চেষ্টা করে ধামাকা শপিং ডটকমের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) সিরাজুল ইসলাম রানাকে পাওয়া যায়।
কেন মার্চেন্টদের পাওনা পরিশোধ করা হচ্ছে না, তাদের সমস্যা কোথায়, জানতে চাইলে সিরাজুল ইসলাম রানা বলেন, ‘বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক ই-কমার্স খাতে স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (এসওপি) জারির পর তাদের হাতে নগদ টাকার সংকট তৈরি হয়েছে। আগে ৪৫ দিনে পণ্য পাঠানোর সুযোগ ছিল। টাকাও অগ্রিম পাওয়া যেত। এখন তার কোনোটিই হচ্ছে না। এ কারণে আর্থিক সংকটে পড়েছেন তারা।
‘তবে এই সংকট দূর করে কর্তৃপক্ষ চেষ্টা করছেন নতুন বিনিয়োগ ভেড়ানোর। একই সঙ্গে মার্চেন্টদের পাওনাও যতটা সম্ভব পরিশোধ করার। এ উদ্দেশ্যে আমাদের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক গত শনিবারও মার্চেন্টদের সঙ্গে ভার্চ্যুয়ালি বৈঠক করেছেন। আশ্বাস দিয়েছেন। কিন্তু কেন মার্চেন্টরা এতো অসহিষ্ণু হয়ে পড়ল, সেটি আমি বলতে পারব না।’
ধামাকায় কারা বিনিয়োগ নিয়ে আসছেন, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সেটি আমি বলতে পারব না। তা শুধু চেয়ারম্যান স্যারই জানেন।’