বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ও সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) কর্মকাণ্ডে ব্যাপক ক্ষোভ জানিয়েছেন মাসখানেক আগে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়া শামসুল আলম।
তিনি বলেছেন, ‘সিপিডি-সানেমের কথা শুনলে বাংলাদেশ এতটুকু এগুতো না। তারা সব সময় বাংলাদেশকে নিয়ে নেতিবাচক কথা বলেছে। ফোনে কিছু সংখ্যক মানুষের সঙ্গে কথা বলে তারা জানিয়েছে, করোনার কারণে দারিদ্র্যের হার বেড়ে ৪২ শতাংশ হয়েছে। এটা কোনো অবস্থাতেই বস্তুনিষ্ঠ তথ্য নয়। এমন তথ্য আমরা (সরকার) প্রত্যাখ্যান করছি।’
রাজধানীর এফডিসির একটি মিলনায়তনে শনিবার ‘এলডিসি চ্যালেঞ্জ উত্তরণে সরকারের প্রস্তুতি’ বিষয়ক ছায়া সংসদ বিতর্ক প্রতিযোগিতায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ কথা বলেন প্রতিমন্ত্রী। ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি এ প্রতিযোগিতার আয়োজন করে।
শামসুল আলম গত ১৮ জুলাই পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক টানা ১২ বছর পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য ছিলেন করেন। ২০০৯ সালে এই পদে দায়িত্ব পান তিনি। এরপর কয়েক বার তার চুক্তিভিত্তিক মেয়াদ বাড়ানো হয়। গত ৩০ জুন চুক্তিভিত্তিক চাকরির মেয়াদ শেষ হয়।
প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার পর মন্ত্রণালয়ের বাইরে কোনো অনুষ্ঠানে শনিবারই প্রথম বক্তব্য রাখেন তিনি।
শামসুল আলম বলেন, ‘বাংলাদেশ সত্যিকার অর্থেই এগিয়ে চলেছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আমরা ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছিলাম। মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে কিছুটা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সব বাধা-বিপত্তি হটিয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে এবং যাচ্ছে।’
‘আমি স্বীকার করছি, কোভিডের কারণে দেশে দারিদ্র্যের হার কিছুটা বেড়েছে। অনেক লোক কাজ হারিয়েছে, কিন্তু সরকারের নানা ধরনের প্রণোদনা কর্মসূচির মাধ্যমে সেটা নিয়ন্ত্রণ করা গেছে। এখন আর সেটা নেই।
‘দারিদ্র্য উঠানামা চলমান একটি প্রক্রিয়া। কোভিডে দারিদ্র্য বেড়েছে আমরা স্বীকার করছি, কিন্তু সানেম-সিপিডি ৪০/৪২ শতাংশের যে তথ্য দিচ্ছে, তা সঠিক নয়। তারা ফোনে কথা বলে যে পদ্ধতিতে গবেষণা করে তথ্য প্রকাশ করছে সেটা কোনো অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য গবেষণা হতে পারে না।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষের বাস্তবতা হচ্ছে এমন-সকালে কারও সঙ্গে ফোনে কথা বললে, বলবে ভালো নেই। বিকেলে আবার সেই লোকের সঙ্গে কথা বললে, বলবে খুব ভালো আছি ভাই। এভাবে ফোনে কথা বলে কোনো গবেষণা হতে পারে না।’
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খানা আয় ও ব্যয় জরিপ ২০১৬ অনুযায়ী, তখন দারিদ্র্যের হার ছিল ২৪ দশমিক ৫ শতাংশ। ২০১৯ সাল শেষে অনুমিত হিসাবে তা নেমে আসে ২০ দশমিক ৫ শতাংশে। এর পর দারিদ্র্যের হার নিয়ে আর কোনো নতুন তথ্য প্রকাশ করেনি বিবিএস।
ছায়া সংসদ বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারীদের পুস্কার দিচ্ছেন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী
তবে গত ২৩ জুন ‘দারিদ্র্য ও জীবিকার ওপর করোনাভাইরাস মহামারির প্রভাব’ শীর্ষক এক গবেষণা তথ্য প্রকাশ করে সানেম বলেছে, ‘করোনাভাইরাস মহামারির অর্থনৈতিক প্রতিঘাতে বাংলাদেশের দারিদ্র্যের হার দ্বিগুণ বেড়ে ৪২ শতাংশ হয়েছে।’
তার আগে ১০ জুন সিপিডি বলেছিল, ‘করোনার কারণে আয় কমে যাওয়ায় দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। ফলে সার্বিকভাবে দারিদ্র্যের হার ৩৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।’
নতুন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শনিবার বলেন, ‘মহামারির মধ্যেও ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশের ৩ দশমিক ৫১ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে। বিশ্বব্যাংক-আইএমএফসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং সিপিডি-সানেমসহ দেশের সব সংস্থাও এই তথ্যকে গ্রহণযোগ্য বলেছে।
‘আমার প্রশ্ন হচ্ছে, জিডিপিতে প্রবৃদ্ধি হলে দারিদ্র্য বাড়ে কী করে? প্রবৃদ্ধি হলে দারিদ্র্য কমতেই হবে, অর্থনীতি সেটাই বলে। দারিদ্র্যের হার বেড়ে ৪২ শতাংশ হয়েছে বলে যে তথ্যের কথা বলা হচ্ছে, সেটা যদি হয়, তাহলে তো জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশ কমার কথা, কিন্তু আমাদের প্রবৃদ্ধি তো ৩ দশমিক ৫১ হয়েছে।
‘এতে, এটিই প্রমাণিত হয় যে, সানেম-সিপিডি দারিদ্র্য বাড়ার যে তথ্য দিচ্ছে, তা সঠিক তথ্য নয়।’
আগামী বছর পদ্মা সেতু চালু হলে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ৩ শতাংশ বাড়বে বলে আশা জানান শামসুল আলম।
সিপিডি-সানেমের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘কোভিড শুরু হওয়ার পর থেকেই এই দুই সংস্থা বলছে, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় একেবারে কমে যাবে। অথচ আমরা কী দেখতে পাচ্ছি, গত ২০২০-২১ অর্থবছরে রেমিট্যান্স বেড়েছে ৩৬ শতাংশের বেশি; রপ্তানি আয় বেড়েছে ১৫ দশমিক ১৫ শতাংশ।’
শামসুল আলম বলেন, ‘সানেম সরকারের অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (২০২১ থেকে ২০২৫ সালের জন্য) বন্ধ রেখে করোনা মোকাবিলায় আলাদা পরিকল্পনা করার কথা বলেছে।
‘আমি মনে করি, সানেম এই প্রস্তাব করে সংবিধান বিরোধী কথা বলেছে। আমি তাদের বলেছি, এ ধরনের কথা তারা বলতে পারে না; এটা সংবিধান বিরোধী কথা।
‘সরকার দেশের উন্নয়নের লক্ষ্যে পাঁচ বছরের জন্য একটি পরিকল্পনা নিয়ে থাকে। সেই সুন্দর পরিকল্পনা মাফিক বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা করোনাকে মাথায় রেখেই করা হয়েছে। তাহলে, সেই পরিকল্পনা বন্ধ বা স্থগিত রাখতে হবে কেন?’
শামসুল আলম, ‘সরকার দরিদ্র মানুষকে সহায়তার জন্য সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে। ২০২৫ সালের মধ্যে দেশের সব দরিদ্রকে এই সামাজিক সুরক্ষায় নিয়ে আসার যে পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে সেটাও অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার একটি কর্মসূচি।’
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ।
প্রতিযোগিতায় নর্দান ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশকে পরাজিত করে বিজয়ী হন ইউনিভার্সিটি অফ সাউথ এশিয়ার বিতার্কিকরা। পরে অংশগ্রহণকারী দলকে ক্রেস্ট, ট্রফি ও সনদপত্র দেয়া হয়।