সঞ্চয়পত্র থেকে গত অর্থবছরে ৪২ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে সরকার। এই অঙ্ক মূল বাজেটের লক্ষ্যের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি; সংশোধিত বাজেটের চেয়ে বেশি ৩২ শতাংশ। আর আগের অর্থবছরের চেয়ে বেশি প্রায় তিন গুণ।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মহামারি করোনাভাইরাসের মধ্যেও সঞ্চয়পত্রের বিক্রি অস্বাভাবিভাবে বেড়ে যাওয়ায় বাধ্য হয়েই সরকারকে ঋণ নিতে হয়েছে। এর মধ্যে সরকারের ভবিষৎ ঋণের বোঝা বেড়ে গেছে। প্রতি মাসে সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকদের মোটা অঙ্কের সুদ দিতে হবে, যা দেশের অর্থনীতির জন্য মোটেই ভালো ফল বয়ে আনবে না।
এ থেকে রেহাই পেতে পেনশনার ও পরিবার সঞ্চয়পত্র ছাড়া অন্য সব সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানোর পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর বৃহস্পতিবার সঞ্চয়পত্র বিক্রির হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, গত ২০২০-২১ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪১ হাজার ৯৫৯ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। এ নিয়ে ৩০ জুন পর্যন্ত সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রির পরিমাণ ৩ লাখ ৪৪ হাজার ৯৪ কোটি টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। এই বিশাল অঙ্কের টাকার সুদ বা মুনাফা গুণতে হবে এখন সরকারকে।
২০২০ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ৩ লাখ তিন লাখ ২ হাজার ১৩৪ কোটি টাকা।
২০১৯-২০ অর্থবছরে সরকার সঞ্চয়পত্র থেকে ১৪ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল। ২০২০-২১ অর্থবছরের মূল বাজেটে সঞ্চয়পত্র থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা ধার করার লক্ষ্য ধরেছিল সরকার। বিক্রি বেড়ে যাওয়ায় ৩ জুন ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার সময় সেই লক্ষ্য বাড়িয়ে ৩০ হাজার ৩০২ কোটি টাকা করা হয়।
কিন্তু বছর শেষে দেখা যাচ্ছে, সরকার সঞ্চয়পত্র থেকে মূল বাজেটের দ্বিগুণেরও বেশি ঋণ নিয়েছে। সংশোধিত বাজেটের চেয়ে বেশি নিয়েছে ৩২ শতাংশ। আর আগের অর্থবছরের চেয়ে বেশি নিয়েছে প্রায় তিন গুণ।
বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল ২০১৬-১৭ অর্থবছরে। ওই বছরে নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ৫২ হাজার ৪১৭ কোটি ৪৮ কোটি টাকা।
তার পরের বছরে (২০১৭-১৮) বিক্রির পরিমাণ ছিল ৪৬ হাজার ৫৩০ কোটি টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে নিট বিক্রির অঙ্ক ছিল ৪৯ হাজার ৯৩৯ কোটি টাকা।
দেড় বছরের মহামারিতে মানুষের আয় কমে গেছে। তা ছাড়া মুনাফার ওপর করের হার বৃদ্ধি এবং নানা ধরনের কড়াকড়ি আরোপের পরও সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে কেন এই উল্লম্ফন, অর্থনীতিবিদরা তার সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না।
করোনাভাইরাস মহামারির এই সঙ্কটের মধ্যে সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে এই উল্লম্ফন দেখে অবাক হয়েছেন অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুর ও জায়েদ বখত। তাদের প্রশ্ন, মহমারিতে মানুষের আয়-রোজগার কমে গেছে। শুধু গরীব মানুষ নয়; নিম্নমধ্যবিত্ত-মধ্যবিত্তরাও সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে। অনেকে সঞ্চয় ভেঙ্গে খাচ্ছেন। তাহলে সঞ্চয়পত্র কিনছেন কারা?
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান জায়েদ বখত নিউজবাংলাকে বলেন, ‘নিট বিক্রি ৪২ হাজার কোটি টাকা। মোট বিক্রি ১ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। আমার কাছে অস্বাভাবিক লাগছে এই তথ্য। এই মহাসংকটের সময়ে কেন বাড়ছে, তা আমি পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারছি না।
‘মহামারিতে মানুষের আয়-উপার্জন কমে গেছে। অনেকে সঞ্চয় ভেঙে সংসার চালাচ্ছেন। এর মধ্যেও সঞ্চয়পত্রের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি সত্যিই বিস্ময়কর।’
সঞ্চয়পত্র বিক্রি বাড়ায় সরকারের জন্য একটি বিপদ হয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘বিক্রির এই উল্লম্ফনের ফলে সরকারকে গ্রাহকদের প্রচুর সুদ দিতে হচ্ছে। বেড়ে যাচ্ছে সরকারের ভবিষ্যৎ ঋণের বোঝা। এই “বোঝা” কমাতে সরকার নানা সময়ে নানা উদ্যোগ ও কড়াকড়ি আরোপ করলেও সঞ্চয়পত্র বিক্রির লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না।’
ব্যাংকে সঞ্চয়পত্র কিনতে গ্রাহকদের ভিড়। ছবি: সাইফুল ইসলাম
জায়েদ বখত বলেন, ‘আমার এ বিষয়ে একটি মত আছে। আগেও অনেক বার বলেছি: সঞ্চয়পত্রের সুদের হার অনেক বেশি। এটি কমানো ছাড়া বিক্রি কমানো যাবে না। পরিবার ও পেনশনার সঞ্চয়পত্র ছাড়া অন্য সব সঞ্চয়পত্রের সুদের হার এখনই কমানো উচিত বলে আমি মনে করি। এ ছাড়া সঞ্চয়পত্র বিক্রির চাপ কোনোভাবেই কমানো যাবে না।’
সঞ্চয়পত্র বেশি বিক্রি হওয়ায় ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ নেয়ার প্রয়োজন হয়নি বলে জানান তিনি।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘এই কঠিন সময়ে মানুষ টাকা পাচ্ছে কোথায়? বুঝতে পারছি না।’
তবে এর দুটি কারণ থাকতে পারে বলে মনে করেন আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, প্রথমত প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের একটি অংশ দিয়ে মানুষ সঞ্চয়পত্র কিনছে। আগেও কিনত। তবে এখন রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ায় এই অঙ্ক বেড়েছে। এ ছাড়া অন্য যে কোনো সঞ্চয় প্রকল্পের চেয়ে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার যেহেতু বেশি, সবাই এখানেই বিনিয়োগ করছে।
তিনি বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংক আমানতের সুদের হার একেবারেই কম; কোনো ব্যাংক ৩/৪ শতাংশও দিচ্ছে। সঞ্চয়পত্র কিনলে ১১/১২ শতাংশ মুনাফা পাওয়া যায়। পুঁজিবাজারে ঝুঁকি আছে। সব কিছু হিসাবনিকাশ করে যার যতোটুকু সঞ্চয় আছে-তা দিয়ে সঞ্চয়পত্রই কিনছে।’
সঞ্চয়পত্র বিক্রির ক্ষেত্রে সরকার এখন জাতীয় পরিচয়পত্র এবং টিআইএন (কর শনাক্তকরণ নম্বর) বাধ্যতামূলক করেছে। তা ছাড়া ব্যাংক হিসাব ছাড়া সঞ্চয়পত্র কেনা যায় না। এখন আর কেউ ভুয়া নামে বা একই ব্যক্তি বিভিন্ন নামে সঞ্চয়পত্র কিনতে পারেন না।
বিক্রির চাপ কমাতে ২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে সঞ্চয়পত্রে মুনাফার ওপর উৎসে করের হার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়। একই সঙ্গে ১ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র কিনতে টিআইএন বাধ্যতামূলক করা হয়। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট না থাকলে সঞ্চয়পত্র বিক্রি না করার শর্ত আরোপসহ আরও কিছু কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার ফলে কমতে শুরু করে সঞ্চয়পত্রের বিক্রি।
কিন্তু ২০২০-২১ অর্থবছরের শুরু থেকেই তা আবার বাড়তে শুরু করে। শেষ পর্যন্তও তা অব্যাহত ছিল।
আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধের পর যেটা অবশিষ্ট থাকে, তাকে বলা হয় নিট বিক্রি। ওই অর্থ সরকারের কোষাগারে জমা থাকে এবং সরকার তা রাষ্ট্রীয় কর্মসূচি বাস্তবায়নে কাজে লাগায়। বিনিময়ে সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকদের প্রতি মাসে সুদ দিতে হয়। এ কারণে অর্থনীতির পরিভাষায় সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রিকে সরকারের ‘ঋণ’ বা ‘ধার’ হিসেবে গণ্য করা হয়।
বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকার ২০২০-২১ অর্থবছরের মূল বাজেটে সঞ্চয়পত্র থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্য ধরেছিল। বিক্রি অস্বাভাবিক বাড়ায় সংশোধিত বাজেটে তা বাড়িয়ে ৩০ হাজার ৩০২ কোটি টাকা করা হয়।
২০১৯-২০ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে ২৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্য ধরেছিল সরকার। বিক্রি কমায় বছরের মাঝামাঝিতে এসে সেই লক্ষ্য কমিয়ে ১১ হাজার ৯২৪ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়।
কিন্তু ওই অর্থবছরের শেষ মাস জুনে হঠাৎ করেই বিক্রি বেড়ে যাওয়ায় সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের পরিমাণ অর্থবছর শেষে ১৪ হাজার ৪২৮ কোটি ৩৫ লাখ টাকায় গিয়ে ঠেকে।
বর্তমানে দেশে চার ধরনের সঞ্চয়পত্র প্রচলিত আছে। এর মধ্যে পরিবার সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ১১ দশমিক ৫২ শতাংশ। পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ, তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ১১ দশমিক ০৪ শতাংশ এবং পেনশনার সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
২০১৫ সালের ২৩ মে থেকে এ হার কার্যকর রয়েছে। তার আগে সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ছিল ১৩ শতাংশেরও বেশি।
চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে সঞ্চয়পত্র থেকে ৩২ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্য ধরেছে সরকার।