আমানতের সুদহার মূল্যস্ফীতির চেয়ে কম হতে পারবে না বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করছে ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীরা। তারা সুদহার বাজারের চাহিদার ওপর ছেড়ে দেয়ার পক্ষে জোরাল অবস্থান নিয়েছে।
প্রজ্ঞাপন জারির তিন দিন পর বুধবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে এক সভায় (ব্যাংকার্স বৈঠক) বিষয়টি নিয়ে তীব্র আপত্তি তোলেন ব্যাংকাররা।
মহামারির কারণে সাড়ে ৬ মাস পর ব্যাংকগুলোর এমডিদের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের এই সভা হয়েছে বুধবার। গভর্নর ফজলে কবিরের সভাপতিত্বে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এমডিরা এতে যোগ দেন।
গত রোববার কেন্দ্রীয় ব্যাংক এক সার্কুলারে জানায়, ব্যাংকে আমানতের সুদহার কোনোভাবেই মূল্যস্ফীতির চেয়ে কম হতে পারবে না। এ ক্ষেত্রে তিন মাস আগের মূল্যস্ফীতি হিসাব করতে হবে।
বিনিয়োগ মন্দায় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে এখন টাকার পাহাড় জমে আছে। আর টাকা নিতে অনীহা দেখানো ব্যাংকগুলো আমানতের সুদহার ইতিহাসের সর্বনিম্ন পর্যায়ে নামিয়ে এনেছে। কোনো কোনো ব্যাংক বার্ষিক দেড় থেকে দুই শতাংশ সুদ অফার করছে।
এই অবস্থায় ব্যাংকে টাকা রাখলে বছর শেষে আসলে তার মূল্য কমে যাচ্ছে। কারণ, মূল্যস্ফীতির হার এখন সাড়ে ৫ শতাংশের মতো। অর্থাৎ এক বছর আগের ১০০ টাকায় যে পণ্য পাওয়া যেত, এখন সেই পণ্য বা সেবা কিনতে খরচ হচ্ছে ১০৫.৫০ টাকার মতো, কিন্তু ব্যাংক সুদ দিচ্ছে এরচেয়ে কম।
এই অবস্থায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক দুটি ব্যবস্থা নিয়েছে। তারা ‘বাংলাদেশ ব্যাংক’ বিল ছেড়ে ব্যাংকের অতিরিক্ত টাকা বিনিয়োগের সুবিধা তৈরি করেছে।
এরই মধ্যে তিনটি নিলাম হয়েছে। গত সোমবার ৭ ও ১৪ দিনের বিলে দুই হাজার ৬০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে ব্যাংকগুলো। আজ হয়েছে ৩০ দিন মেয়াদি বিলের নিলাম। এখানে কত বিনিয়োগ হলো, তা এখনও জানানো হয়নি।
এই ধরনের আরও ৬টি নিলাম হবে আগামী কয়েক দিনে।
দ্বিতীয় যে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, সেটা হলো আমানতের সর্বনিম্ন সুদহার মূল্যস্ফীতির নিরিখে নির্ধারণ। কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করছে, ব্যাংকের হাতে অতিরিক্ত টাকা যদি তারা ‘বাংলাদেশ ব্যাংক বিলে’ বিনিয়োগ করে, তাহলে তারা আমানত সংগ্রহ করতে চাইবে।
এর আগে গত বছর কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার ৯ শতাংশ বেঁধে দেয়। প্রথমে এটি কার্যকর করা নিয়ে ব্যাংকাররা নানা প্রতিবন্ধকতার কথা তুলে সেটি কার্যকর করতে চাইছিল না। তবে এখন ৭ থেকে ৮ শতাংশ ঋণ পাওয়া যায়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে সভায় ব্যাংকের এমডিরা ঋণ ও আমানতের সুদহারের সীমা তুলে দেয়ার দাবি, মেয়াদি আমানত নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা প্রত্যাহার বা পরিমার্জন কিংবা ঋণ ও আমানতে উভয়ক্ষেত্রে সুদহারের সীমা তুলে দেয়ার দাবি জানানো হয়। তবে এ বিষয়ে নির্দেশনার কোনো পরিবর্তন হবে না বলে জানিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা।
ব্যাংকার্স সভার কার্যপত্র থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
সভায় উপস্থিত বেসরকারি ব্যাংকের একজন এমডি নাম প্রকাশ না করার শর্তে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ঋণে ৯ শতাংশ সুদ বেধে দেয়া হলেও করপোরেট ঋণে ৭ শতাংশের বেশি সুদ পাচ্ছি না। সেক্ষেত্রে আমানতে মূল্যস্ফীতির সমান সুদ দিলে ব্যাংক চাপের মুখে পড়বে। এজন্য আমানতে সুদহার পরিমার্জন, সংশোধনের জন্য জোরালো দাবি জানানো হয়েছে।’
তবে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, মূল্যস্ফীতির কম সুদ আমানতকারীদেরকে দেয়া যাবে না। এতে ব্যাংক খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। পরে ব্যাংকারদের পক্ষ থেকে ধাপে ধাপে আমানতের সুদহার বাস্তবায়নের প্রস্তাব দেয়া হয়।
তারা বলছেন, ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারীদের ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতির কম সুদ দেয়া হবে না। যারা বড় আমানতকারী আছেন, তাদেরকে যেন নিয়মে সুদ দিতে দেয়া হয়। এমডিদের এ প্রস্তাবনা কেন্দ্রীয় ব্যাংক পর্যালোচনা করবে বলে আশ্বাস দিয়েছে।
অন্যান্য বিষয়
সভায় করোনার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংকগুলোর বিশেষ সিএসআর নিয়ে আলোচনা হয়।
২০২০ সালে ব্যাংকগুলো ১০ হাজার ৭৭৬ কোটি টাকার নিট মুনাফা করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনার আলোকে এর এক শতাংশ হিসেবে ১০৮ কোটি টাকা বিশেষ সিএসআর করতে হচ্ছে।
প্রণোদনার আওতায় দ্বিতীয় বছরে বড় শিল্পে ৩৩ হাজার কোটি টাকা এবং সিএমএসএমই খাতে ২০ হাজার কোটি টাকা বিতরণ লক্ষ্যমাত্রা নিয়েও সভায় আলোচনা হয়।
সিএমএসএমই খাতে প্রথম বছর ১৫ হাজার ৩৮৭ কোটি টাকা বিতরণ হয়েছে, যা মোট লক্ষ্যমাত্রার ৭৬ দশমিক ৯৩ শতাংশ। শতভাগ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনকারী ১২টি ব্যাংককে সভায় প্রশংসাপত্র দেয়া হয়। আর ৪০ শতাংশের কম বিতরণ করা ব্যাংকগুলোকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়ার হয়েছে।