গত কয়েক বছর ধরেই দেশের বিনিয়োগে মন্দা চলছে। জাতীয় বিনিয়োগ (বর্তমান মূল্যে) জিডিপির ৩০ থেকে সাড়ে ৩১ শতাংশের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল। করোনাভাইরাস মহামারিতে সেটি ৩০ শতাংশের নিচে নামিয়ে এনে বাংলাদেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতিকে ‘মহামন্দার’ দিকে ঠেলে দিয়েছে।
এই বিনিয়োগ গত পাঁচ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে জাতীয় বিনিয়োগ জিডিপির ৩০ দশমিক ৫১ শতাংশ ছিল। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তা বেড়ে ৩১ দশমিক ২৩ শতাংশে ওঠে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা আরও বেড়ে ৩১ দশমিক ৫৭ শতাংশে ওঠে; যা ছিল জিডিপির হিসাবে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ।
করোনাভাইরাস মহামারির ছোবলে ২০১৯-২০ অর্থবছরে বিনিয়োগের পরিমাণ কমে জিডিপির ৩০ দশমিক ৪৭ শতাংশে নেমে আসে। গত ২০২০-২১ অর্থবছরে তা আরও কমে ২৯ দশমিক ৯২ শতাংশে নেমে এসেছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) বৃহস্পতিবার ২০২০-২১ অর্থবছরের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির প্রবৃদ্ধির যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে বিনিয়োগের করুণ এ চিত্র পাওয়া যায়।
অর্থনীতির গবেষক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর নিউজবাংলাকে বলেন, ‘গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেকটা এগিয়েছে; রেমিট্যান্স, রপ্তানি আয়, বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভসহ অর্থনীতির অন্যান্য সূচক ভালো অবস্থায় আছে। বিনিয়োগে কিন্তু কোনো উন্নতি হয়নি। চার-পাঁচ বছর জিডিপির ৩০ থেকে ৩১ দশমিক ৫ শতাংশের মধ্যে আটকে ছিল বিনিয়োগ। কোভিডের ধাক্কায় এখন তা ৩০ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে।’
‘এ সময়ে সরকারি বিনিয়োগ কিছুটা বাড়লেও বেসরকারি বিনিয়োগ বেশ কমেছে। মহামারির আগে বেসরকারি বিনিয়োগ জিডিপির ২৩ দশমিক ৫৪ শতাংশ ছিল। এখন তা ২ দশমিক ৩ শতাংশ পয়েন্ট কমে ২১ দশমিক ২৫ শতাংশে নেমে এসেছে।’
‘আমাদের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি হচ্ছে বেসরকারি খাত। এই খাতে বিনিয়োগ না বাড়াতে পারলে কোভিড-১৯ পরবর্তী পরিস্থিতিতে টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারা বজায় রাখতে পারব না।’
আহসান মনসুর বলেন, ‘অর্থনীতিকে মহামারির প্রভাব থেকে বের করে আনার জন্য সরকারের একমাত্র পথ হচ্ছে টিকাদান কর্মসূচির গতি বাড়ানো। যেহেতু লকডাউন আমরা সফল করতে পারি না; সেহেতু সেটা নিয়ে আর সময় নষ্ট করার প্রয়োজন নেই। এখন টিকাতেই সর্বশক্তি নিয়োগ করতে হবে সরকারকে।’
‘ভ্যাকসিনের বিষয়টি অবজ্ঞা করে বিনিয়োগ বা প্রবৃদ্ধির কথা বলে লাভ নেই,’ বলেন ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান মনসুর।
আরেক অর্থনীতিবিদ বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের (সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের হার কমে যাওয়ার পেছনে নিশ্চিতভাবেই কাজ করেছে কোভিড-১৯-এর কারণে সৃষ্ট নজিরবিহীন মন্দা।
তিনি বলেন, ‘বিনিয়োগের হার কমে যাওয়ার পরিমাণটি বিবিএসের হিসাবের চেয়েও বেশি হতে পারে। কেননা, বিবিএস যে হিসাব দিয়েছে, তা নয় মাসের (২০২০ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২১ সালের ৩০ মার্চ) হিসাব কষে দিয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরের শেষ মাস জুলাইয়ের পুরোটা সময় ধরে কড়া লকডাউনের কারণে অর্থনীতির যে আরও বেশি ক্ষতি হয়েছে, তা কিন্তু প্রতিফলিত হয়নি।’
‘বিবিএস যখন চূড়ান্ত হিসাব দেবে, তখন হয়তো দেখা যাবে দেশে বিনিয়োগ পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে।’
বিবিএসের হিসাব অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছর শেষে দেশের মোট জিডিপির আকার দাঁড়িয়েছে (বর্তমান বাজারমূল্যে) ৩০ লাখ ১১ হাজার ৬৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে বিনিয়োগ অঙ্ক হচ্ছে ৩ লাখ ৮৭ হাজার ৪৫৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ জিডিপির ২৯ দশমিক ৯২ শতাংশ বিনিয়োগ হয়েছে।
আগের ২০১৯-২০ অর্থবছরে জিডিপির আকার ছিল ২৭ লাখ ৩৯ হাজার ৩৩২ কোটি টাকা। বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ৮০ হাজার ৭২৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ জিডিপির ৩০ দশমিক ৪৭ শতাংশ টাকা বিনিয়োগে এসেছে।
বেসরকারি বিনিয়োগ ১৪ বছরে সর্বনিম্ন
পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, গত ২০২০-২১ অর্থবছরে জিডিপি অনুপাতে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ একেবারে তলানিতে নেমে এসেছে। এ বিনিয়োগের হার দাঁড়িয়েছে ২১ দশমিক ২৫ শতাংশ, যা গত ১৪ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম।
২০০৭-০৮ অর্থবছরের বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের হার ছিল ২১ দশমিক ৩৫ শতাংশ। এর পরের বছরগুলোতে এই হার ২২ শতাংশের ওপরে ছিল। ২০১১-১২ অর্থবছরে ছিল ২২ দশমিক ৫০ শতাংশ। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ছিল ২২ দশমিক ৯৯ শতাংশ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ছিল ২৩ দশমিক ৫৪ শতাংশ; যা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি।
করোনার ধাক্কায় ২০১৯-২০ অর্থবছরে এই বিনিয়োগ ২২ দশমিক ০৬ শতাংশে নেমে আসে। ২০২০-২১ অর্থবছরে তা আরও কমে ২১ দশমিক ২৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
বেসরকারি বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘করোনা দুর্যোগের কারণে সবকিছুই কঠিন হয়ে গেছে। বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগে যাওয়ার অপেক্ষাও বেড়ে যাচ্ছে। যার প্রভাবই দেখা যাচ্ছে সার্বিক বিনিয়োগে।
তিনি বলেন, ‘এমনিতেই করোনার আগে থেকেই বেসরকারি বিনিয়োগের অবস্থা খুব বেশি ভালো ছিল না। উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনে জিডিপির ৩০ শতাংশের মতো বেসরকারি বিনিয়োগ দরকার। অথচ করোনার আগের বছরগুলোতেও বেসরকারি বিনিয়োগ জিডিপির ২২ থেকে ২৩ শতাংশের মধ্যে ঘোরাফেরা করছিল।
‘আর করোনার অনিশ্চয়তার কারণে শুরু হওয়া অনেক বিনিয়োগও ধরে রাখা যায়নি। প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন ক্ষমতা ব্যবহার করা যাবে কি না, সেটা নিয়ে বিনিয়োগকারীরা নিশ্চিত হতে পারছেন না। অনিশ্চয়তার কারণে উৎপাদনক্ষমতা বাড়ানোরও উদ্যোগ নিচ্ছেন না অনেকে।’
শিল্পঋণ বিতরণ কম
বেসরকারি বিনিয়োগ পরিস্থিতি বোঝার অন্যতম সূচক হচ্ছে শিল্পঋণ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে আগের অর্থবছরের তুলনায় শিল্পঋণ বিতরণ কমে যায় ৮ শতাংশের বেশি। আর গত ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় শিল্পঋণ বিতরণ কমেছে প্রায় ৩১ শতাংশ।
অন্যদিকে গত অর্থবছরে বেসরকারি খাত ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৮ দশমিক ৩৫ শতাংশ। শিল্প স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় মূলধনী যন্ত্রপাতি (ক্যাপিটাল মেশিনারি) আমদানি কমেছে ১৫ শতাংশের মতো।
সরকারি বিনিয়োগে কিছুটা স্বস্তি
মহামারির মধ্যেও সরকারি খাতে বিনিয়োগে খুব নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি; উল্টো কিছুটা বেড়েছে।
বিবিএসের ১০ বছরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১১-১২ অর্থবছরে সরকারি খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল জিডিপির ৫ দশমিক ৭৬ শতাংশ। ধারাবাহিকভাবে বাড়তে বাড়তে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে তা ৬ দশমিক ৬৬ শতাংশে দাঁড়ায়। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা ৮ শতাংশের ‘ঘর’ অতিক্রম করে ৮ দশমিক ০৩ শতাংশে ওঠে।
করোনার মধ্যেও ২০১৯-২০ অর্থবছরে সরকারি বিনিয়োগ বেড়ে ৮ দশমিক ৪১ শতাংশে দাঁড়ায়। সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরে তা আরও বেড়ে ৮ দশমিক ৬৭ শতাংশে উঠেছে।