প্রত্যেক বাজেটে মূল্য সংযোজন করের (ভ্যাট) আওতা বাড়লেও নির্দিষ্ট কয়েকটি খাতের উপর আদায় নির্ভরশীল এখনও। সিগারেট, মোবাইল টেলিযোগাযোগসহ ১০টি খাত থেকে মোট ভ্যাটের ৮০ শতাংশ আদায় হয়।
আবার এমন অনেক খাত রয়েছে, যেসব খাত থেকে আদায় হয় মোট ভ্যাটের ১ শতাংশের কম।
ভ্যাট আহরণের দিক থেকে সবার শীর্ষে অবস্থান করছে তামাকজাত পণ্য খাত বা সিগারেট। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে মোবাইল ফোন। তার পর রয়েছে ওষুধ।
এ ছাড়া আমদানি পর্যায়ে আগাম কর, যোগানদার বা সরবরাহকারী, ওষুধ, বিদ্যুৎ বিতরণ, ব্যাংকিং সেবা, খুচরা ও পাইকারি ব্যবসা, নির্মাণখাত থেকেও উল্লেখযোগ্য ভ্যাট আদায় হয় ।
গত অর্থবছরে (২০২০-২১) এনবিআরের মাধ্যমে মোট ভ্যাট আহরণ হয় ৯৭ হাজার ৫০৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে উল্লেখিত দশ খাতের অবদান ৮০ শতাংশ। এর বাইরে উৎপাদন, সেবা, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসার শতাধিক খাত থেকে অবশিষ্ট ২০ শতাংশ আদায় হয়।
এখন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মাধ্যমে সংগৃহীত রাজস্বের ৩৯ শতাংশ আসে অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণের অন্যতম উৎস ভ্যাট থেকে। এর পর রয়েছে আয়কর খাত, ৩৫ শতাংশ। বাকি অংশ আয় হয় আমদানি শুল্ক থেকে। এই তিন উৎস থেকে রাজস্ব আদায় করে থাকে এনবিআর।
সরকারি রাজস্ব আহরণ করা এই প্রতিষ্ঠানটি জাতীয় বাজেটে ৮৫ শতাংশ অর্থের যোগান দেয়।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, আদায়যোগ্য ভ্যাটের অর্ধেকেই ফাঁকি হয়। বিশেষে করে সেবা খাতে। বর্তমানে সেবার ৬৮টি খাত আছে, যেগুলোর বেশির ভাগ থেকে নামমাত্র ভ্যাট আহরণ হয়।
দুই বছর আগে করা এনবিআরের এক সমীক্ষায় বলা হয়, সেবা খাতের আদায়যোগ্য ভ্যাটের ৭০ শতাংশই ফাঁকি হয়। মিষ্টির দোকান, কমিউনিটি সেন্টার, হোটেল-রেস্তোরাঁ, প্যাকেজিং সামগ্রী, ইটভাটা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এসব খাতে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ ভ্যাট ফাঁকি হয় এবং মোট ভ্যাটের ১ শতাংশের কম আহরণ হয়।
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে এনবিআরের সাবেক সদস্য মো. ফরিদউদ্দিন নিউজবাংলাকে বলেন,‘ভ্যাট বিভাগের দক্ষতা বৃদ্ধি, আদায় প্রক্রিয়া সহজ করা, কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণসহ পুরো ভ্যাট বিভাগকে অটোমেশনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি, খুচরা ও পাইকারি পর্যায়ে কঠোর নজরদারি আনতে পারলে ভ্যাট আদায় বর্তমানের চেয়ে দ্বিগুণ বাড়বে।’
প্রতিষ্ঠান সবচেয়ে বেশি ভ্যাট দিয়েছে
গত অর্থবছরে ভ্যাটদাতা কোম্পানিগুলোর মধ্যে বরাবরের মতোই শীর্ষে ছিল সিগারেট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ (বিএটিবি)। দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে যথাক্রমে মোবাইল ফোন অপারেটর কোম্পানি গ্রামীণফোন ও রবি।
ভ্যাট ভোক্তা দিয়ে থাকে। তাই একে ভোক্তা করও বলা হয়। বিভিন্ন কোম্পানি ভোক্তার কাছ থেকে সেই ভ্যাট সংগ্রহ করে সরকারি কোষাগারে জমা দেয়।
বিএটিবি গত অর্থবছরে ২৪ হাজার ৯১১ কোটি টাকা ভ্যাট দিয়েছে, যা আগের বারের চেয়ে ২০ শতাংশ বেশি।
করোনাকালে যে কয়টি খাত থেকে বেশি ভ্যাট আদায় হয়েছে, তার মধ্যে টোবাকো বা তামাকজাত পণ্য অন্যতম।
করোনায় সেবার অন্যতম খাত মোবাইল ফোনে কথা বলা বেড়েছে। আবার ভিডিও কল, অনলাইন ক্লাস, জুম মিটিংসহ দৈনন্দিন নানা কাজে এখন মোবাইল সেবার ব্যবহার হচ্ছে বেশি। ফলে মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে আগের চেয়ে ভ্যাট আদায় বেড়েছে।
গত অর্থবছরে ভ্যাটদাতা শীর্ষ পাঁচ কোম্পানির মধ্যে তিনটিই মোবাইল ফোন অপারেটর। এর মধ্যে দ্বিতীয় স্থানে আছে গ্রামীণফোন। এই কোম্পানি গত অর্থবছরে ৪ হাজার ৪৮৫ কোটি টাকা ভ্যাট দিয়েছে, যা আগের বছরের চেয়ে ২৩ শতাংশ বেশি।
এর পর রয়েছে মোবাইল অপারেটর রবি। এই কোম্পানি আগের বারের চেয়ে প্রায় ৪৮ শতাংশ বেশি ভ্যাট দিয়েছে। রবি সব মিলিয়ে ভ্যাট দিয়েছে ২ হাজার ৩৪৪ কোটি টাকা।
ঢাকা টোব্যাকো কোম্পানি মোট ভ্যাট দিয়েছে ২ হাজার কোটি টাকার মতো।
বাংলালিংক দিয়েছে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, যা আগের চেয়ে প্রায় ৩১ শতাংশ বেশি।
এ ছাড়া ইউনিলিভার ৬৫৫ কোটি টাকা, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক ৫৭৯ কোটি টাকা, পেট্রোবাংলা ৫৭৮ কোটি টাকা, পিডিবি ৫৪০ কোটি টাকা এবং স্কয়ার ফার্মা ৫১০ কোটি টাকা ভ্যাট দিয়েছে সমাপ্ত হওয়া ২০২০-২১ অর্থবছরে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এনবিআরে ভ্যাট বিভাগের এক কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে বলেন,‘করোনার বছরে সার্বিকভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা থাকলেও কর্মকর্তারা তদারকি বাড়িয়েছেন। এ জন্য শুল্ক-কর আদায় আগের বছরের চেয়ে বেড়েছে। বড় কোম্পানিগুলোর ব্যবসাও তুলনামূলক ভালো ছিল।’
দেশের বড় কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে ভ্যাট আদায় করে এনবিআরের ভ্যাট বিভাগের বৃহৎ করদাতা ইউনিট বা এলটিইউ। এলটিইউতে ১১০টি কোম্পানি নিবন্ধিত।
গত অর্থবছরে মোট ৯৭ হাজার ৫০৯ কোটি টাকা আদায় করেছে ভ্যাট বিভাগ। এর মধ্যে এলটিইউর ওই ১১০টি কোম্পানিই অর্ধেকের বেশি ভ্যাট দিয়েছে। তাদের দেয়া ভ্যাটের পরিমাণ প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা।
সার্বিকভাবে সিগারেট খাত থেকে সবচেয়ে বেশি প্রায় ২৭ হাজার কোটি টাকা, মোবাইল ফোন খাতে ৮ হাজার ৪৬৬ কোটি টাকা এবং ওষুধ খাত থেকে এসেছে ৩ হাজার ১৩৩ কোটি টাকা।