সুতার দাম নিয়ে মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে তৈরি পোশাক শিল্প ও বস্ত্রকল মালিকরা।
পোশাক শিল্প মালিকদের অভিযোগ, চাহিদা বাড়ায় ইচ্ছে করে সুতার দাম বাড়িয়ে দিয়েছে বস্ত্রকল মালিকরা। কম দামে সুতা না দিলে ভারত থেকে আমদানি করার হুমকি দিয়েছেন তারা।
আর বস্ত্রকল মালিকরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে তুলার দাম বাড়ায় তারা সুতার দাম বাড়াতে বাধ্য হয়েছেন। ‘চাহিদা বাড়লে যে কোনো জিনিসের দাম বাড়ে’ এ কথা মনে করিয়ে দিয়ে ভারতে কম দামে পেলে সেখান থেকে সুতা আনলে তাদের কোনো আপত্তি নেই বলেও জানিয়েছেন তারা।
দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান রোববার রাতে নিউজবাংলাকে বলেন, সুতার সংকটে পোশাক শিল্প নতুন সমস্যা দেখা দিয়েছে। বর্তমানে পোশাক শিল্পে প্রচুর ক্রয়াদেশ আসলেও উদ্যোক্তারা তা নিতে পারছেন না শুধুমাত্র স্থানীয় পর্যায়ে সুতার অনিশ্চিত ও অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে।
তিনি বলেন, গত কয়েক মাস ধরেই স্থানীয় বাজারে সুতার দাম বাড়ছে। এক মাসের ব্যবধানে বস্ত্রকল মালিকরা প্রতি কেজি সুতার দাম ৭০ সেন্ট থেকে ১ ডলার পর্যন্ত বাড়িয়েছে। অনেক সময় বেশি দাম দিয়েও সুতা পাওয়া যাচ্ছে না। সময়মতো তারা সুতা সরবরাহও করছে না।
ফারুক হাসান বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার অজুহাত দেখিয়ে তারা যা যা ইচ্ছা, তাই করছে। ইচ্ছেমতো দাম বাড়াচ্ছে; যেদিন সুতা দেয়ার কথা সেদিন সুতা দিচ্ছে না। অযথা দেরি করছে। এতে আমাদের খুব ক্ষতি হচ্ছে; সময়মতো ক্রেতাদের কাছে পণ্য পৌঁছাতে পারছি না।’
বিজিএমইএর সভাপতি বলেন, ‘আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই আমরা সুতার সংকট নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করব। যদি বস্ত্রকল মালিকরা আমাদের কম দামে সুতা না দেয়, তাহলে বাধ্য হয়ে ভারত থেকে আমদানি করে চাহিদা মেটাব।’
ফারুক হাসানের অভিযোগ অস্বীকার করে বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন বিটিএমএর সহ-সভাপতি আবদুল্লাহ আল মামুন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘গত কয়েক মাসে আন্তর্জাতিক বাজারে সুতার কাঁচামাল তুলার দাম ২০ শতাংশের মতো বেড়েছে। সে কারণেই আমরা সুতার দাম বাড়াতে বাধ্য হয়েছি।’
চাহিদা বাড়ায় দাম বাড়ছে জানিয়ে বলেন, ‘মুক্তবাজার অর্থনীতিতে চাহিদা বাড়লে যে কোনো জিনিসের দাম বাড়বে-এটাই স্বাভাবিক। করোনাভাইরাসের এই কঠিন সময়ে নানান প্রতিবন্ধকতার মধ্যে সুতা উৎপাদন করতে খরচ বেশি হচ্ছে। বেশি চাহিদার কারণে উৎপাদনও করতে হচ্ছে বেশি। সবকিছু মিলিয়ে দাম বাড়াতে বাধ্য হয়েছি আমরা।’
পোশাক রপ্তানিকারকদের ভারত থেকে সুতা আমদানির ‘হুমকি’ প্রসঙ্গে মামুন বলেন, ‘এখানে হুমকির কিছু নেই। তারা তো এখনও ভারত থেকে সুতা আমদানি করছে। করুক না সেখান থেকে আমদানি। যেখানে কম দাম পাবে সেখান থেকে আনবে। আমাদের কোনো আপত্তি নেই।’
বিজিএমইএ, বিটিএমইএ ও বিটিটিএলএমইএর বৈঠক
সুতার অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে রোববার বিজিএমইএ অফিসে বিজিএমইএ, নিট পোশাক শিল্পমালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ ও টেরিটাওয়েল রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিটিটিএলএমইএ নেতারা এক জরুরি বৈঠক করেছেন।
বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে সুতার মূল্যবৃদ্ধিতে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে সরকারের প্রতি অনুরোধ করা হয়েছে।
বৈঠকের পর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, দেশীয় বাজারে ক্রমবর্ধমানহারে সুতার দাম বেড়ে যাওয়ায় পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তাদের মধ্যে গভীর উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে। পোশাক শিল্পের প্রধান রপ্তানি বাজারগুলোতে করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে গনহারে টিকাদান কার্যক্রম নেয়ায় এসব দেশে দোকানপাট খুলছে।
‘যার ফলশ্রুতিতে বর্তমানে পোশাক শিল্পে প্রচুর ক্রয়াদেশ আসলেও উদ্যোক্তারা তা নিতে পারছেন না শুধুমাত্র স্থানীয় পর্যায়ে সুতার অনিশ্চিত ও অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে।’
সভায় উপস্থিত ছিলেন বিজিএমইএ এর সহসভাপতি শহিদউল্লাহ আজিম, সহসভাপতি (অর্থ) খন্দকার রফিকুল ইসলাম, পরিচালক আসিফ আশরাফ, মহিউদ্দিন রুবেল, আবদুল্লাহ হিল রাকিব, রাজিব চৌধুরী, সাবেক পরিচালক আশিকুর রহমান তুহিন, বিকেএমইএর জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম, পরিচালক ফজলে শামীম এহসান এবং বিটিটিএলএমইএ এর চেয়ারম্যান এম শাহাদাত হোসাইন।
সভায় তিন সংগঠনের নেতারা জানান, বর্তমানে স্থানীয় মিলগুলো সুতার দাম বাড়িয়েই যাচ্ছে; যা এক কথায় অসহনীয়। নূন্যতম সময়ের মেয়াদ দিয়ে প্রোফর্মা ইনভয়েস (পিআই) দিচ্ছে, যে সময়ের মধ্যে এলসি খোলা দুরূহ। অথচ ক্রেতাদের সঙ্গে অর্ডার কমফার্ম হতেও তার থেকে অনেক গুণ বেশি সময় লেগে যায়। এ কারণে অনেক উদ্যোক্তা অর্ডার ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন।
অন্যদিকে, অনেকে লোকসান দিয়ে অর্ডার নিচ্ছেন শুধুমাত্র কারখানা চালু রাখতে। আর ক্রেতারা শুধুমাত্র এফওবি দেখছেন, মূল্য বাড়াচ্ছেন না, যার ফলশ্রুতিতে আন্তর্জাতিক বাজারে পোশাক শিল্প প্রতিযোগী সক্ষমতা ক্রমেই হারাচ্ছে বলে জানান তারা।
সুতার দাম বাড়ায় পোশাক শিল্পে যে সমস্যাগুলো সৃষ্টি হয়েছে সেগুলো কীভাবে সমাধান করা যেতে পারে, সে বিষয়ে সভায় বিস্তারিত আলোচনা হয়। সভায় সিদ্ধান্ত হয়, খুব শিগগিরই সংবাদ সম্মেলন করে সুতার মূল্যবৃদ্ধির কারণে পোশাক শিল্পে কী ধরনের সংকট দেখা দিয়েছে, তা তুলে ধরা হবে।
সেইসঙ্গে যৌক্তিক দামে সুতার প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে সরকারকে অবগত করা হবে।