ব্যাংকে আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষায় এবার হস্তক্ষেপ করল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংকে টাকা রাখলে এখন থেকে মূল্যস্ফীতির চেয়ে কম হারে সুদ দেয়া যাবে না।
আমানতের সুদহার কমতে কমতে দেড় থেকে দুই শতাংশে নেমে আসার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক এক আদেশে জানিয়েছে, আমানতের সুদহার মূল্যস্ফীতির চেয়ে বেশি রাখতে হবে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সবশেষ হিসাব অনুযায়ী, জুন শেষে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ৫.৬৪ শতাংশ। আর ১২ মাসের গড় হিসাবে মূল্যস্ফীতির হার এখন ৫.৫৬ শতাংশ। অর্থাৎ আমানতের সুদহার এখন থেকে কমপক্ষে ৫.৬৫ শতাংশ হতে হবে।
তিন মাস বা তার বেশি মেয়াদের জন্য ঘোষিত আমানতের ক্ষেত্রে এ নির্দেশনা কার্যকর হবে।
তবে আমানতের সুদহারে ব্যাংকগুলোকে বেশি খরচ করতে হলেও ঋণের সুদহার তারা নির্ধারিত সীমার চেয়ে বেশি বাড়াতে পারবে না। ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার ৯ শতাংশে থাকবে। অবশ্য এখন ৬ থেকে ৭ শতাংশেও ঋণ পাওয়া যাচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ সিদ্ধান্তের বিষয়ে জানতে চাইলে ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান এইচ মনসুর নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি মনে করি যদি বাংলাদেশ ব্যাংক বাজারব্যবস্থার ওপর বিশ্বাস করে, তাহলে লিমিট টু দি মার্কেট (বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়া উচিত)। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি ইন্টারেস্ট রেট বাড়াতে চায়, তাহলে বাজার থেকে অতিরিক্ত তারল্য তুলে নিতে হবে।’
তবে বিষয়টি আমানতকারীদের জন্য সুখবর মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘এখন মূল্যস্ফীতির হার কমাতে হবে। না হলে নতুন নির্দেশনায় মূল্যস্ফীতির চেয়ে আমানতে সুদ বেশি পাবে গ্রাহক। ফলে মূল্যস্ফীতি কমানোর চেষ্টা করতে হবে।’
আমানতের সুদহার ক্রমেই কমছে, টাকা রাখলে ‘কমে যায়’ ব্যাংকে
সম্প্রতি ব্যাংকিং খাতে আমানতের সুদ বা মুনাফার হার ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। ব্যাংকে আমানতের গড় সুদহার এখন ৪.১৩ শতাংশ। তবে এগুলো পুরোনো বেশি সুদের আমানত ধরে। এখন কোনো কোনো ব্যাংক দেড় থেকে ২ শতাংশ সুদ দিচ্ছে।
মূল্যস্ফীতি এর চেয়ে বেশি হওয়ায় এক বছর পর সুদ যোগ হলেও প্রকৃতপক্ষে আমানতের টাকার মূল্যমান কমে যাচ্ছে।
করোনাকালে বিনিয়োগে ভাটা পড়ায় ব্যাংকগুলোতে এখন টাকা উপচে পড়ছে। একেবারেই কোনো নড়চড় নেই, এমন অলস টাকা জমেছে ৬২ হাজার কোটি।
এ অবস্থায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই অলস টাকা তুলে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ব্যাংকগুলোকে বাংলাদেশ ব্যাংক বিলে বিনিয়োগ করতে বলা হয়েছে। সোমবার থেকে নিলাম হবে। আর এই বিলের বিপরীতে ব্যাংকগুলো একটি হারে সুদ পাবে।
এতে ব্যাংকে অলস টাকা কমে যাওয়ায় তারা আমানত সংগ্রহে আবার মনোযোগী হবে বলে আশা করা হচ্ছে। আর এই পরিস্থিতিতে রোববার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ আমানতের সুদহার বাড়ানোর বিষয়ে সার্কুলারটি জারি করে।
সব ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা প্রধান নির্বাহী দেশে কার্যরত সব তফসিলি ব্যাংককে এটি পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।
ব্যাংক আর আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংক
কেন্দ্রীয় ব্যাংক যা বলছে
নির্দেশনায় বলা হয়, ‘ব্যক্তি পর্যায়ের মেয়াদি আমানত এবং বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকতা-কর্মচারীদের প্রভিডেন্ট ফান্ড, অবসরোত্তর পাওনাসহ বিভিন্ন পাওনা পরিশোধের লক্ষ্যে গঠিত তহবিলের যেকোনো পরিমাণের মেয়াদি আমানতের ওপর সুদহার কোনোভাবেই মূল্যস্ফীতির চেয়ে কম নির্ধারণ করা যাবে না। তবে প্রাতিষ্ঠানিক আমানতের ক্ষেত্রে এ নিয়ম প্রযোজ্য হবে না।’
এতে বলা হয়, ‘৩ মাস ও তদূর্ধ্ব মেয়াদি আমানতের ওপর সুদহার নির্ধারণের ক্ষেত্রে এ নির্দেশনা মানতে হবে। যে মাসের সুদহার নির্ধারণ করা হবে, তার তিন মাস আগের ১২ মাসের গড় মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নিতে হবে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারে আরও বলা হয়, ব্যাংকের তহবিলের প্রধান উৎস আমানতকারীদের থেকে সংগৃহীত অর্থ। আমানতের ওপর সুদহার অতিমাত্রায় কমলে ভবিষ্যতে ব্যাংকের আমানতের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। ফলে ব্যাংকের দায়-সম্পদ ব্যবস্থাপনায়ও ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হতে পারে।
ব্যাংক থেকে পাওয়া বিবরণী পর্যালোচনায় দেখা যায়, অধিকাংশ ব্যাংক মেয়াদি আমানতের ওপর মূল্যস্ফীতির হারের চেয়ে কম সুদ দিচ্ছে। ক্ষুদ্র আমানতকারীসহ অন্য আমানতকারীদের একটি অংশ তাদের জীবিকা নির্বাহের জন্য ব্যাংকে রক্ষিত আমানতের সুদের ওপর নির্ভরশীল।
কিন্তু ব্যাংকে রক্ষিত মেয়াদি আমানতের ওপর মূল্যস্ফীতির হারের চেয়ে কম সুদ দেয়ায় আমানতকারীদের ক্রয়ক্ষমতা কমছে। এতে করে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
এ ছাড়া মেয়াদি আমানতের ওপর সুদহার অত্যধিক হ্রাস জনসাধারণের সঞ্চয় প্রবণতাকে নিরুৎসাহিত করে। ফলে আমানতকারীরা তাদের সঞ্চিত অর্থ ব্যাংকে রাখার পরিবর্তে ঝুঁকিপূর্ণ খাতসহ বিভিন্ন অনুৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগের প্রবণতা বাড়ছে।
গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের এক নির্দেশনায় জানানো হয়, ২০২০ সালের ১ এপ্রিল থেকে ক্রেডিট কার্ড ছাড়া সব ঋণে সর্বোচ্চ সুদহার হবে ৯ শতাংশ। তবে আমানতে সুদহার নির্ধারণের ক্ষমতা ব্যাংকগুলোর ওপর ছেড়ে দেয়া হয়। এরপর নিজেদের মুনাফা ধরে রাখতে ব্যাংকগুলো আমানতের সুদ ব্যাপক কমাতে শুরু করে।
এর মধ্যে করোনা শুরু হওয়ায় ব্যাংকগুলোর সিআরআর দেড় শতাংশ কমানো, প্রণোদনার আওতায় ঋণ বিতরণের জন্য প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন তহবিলসহ বিভিন্ন নীতি সহায়তার কারণে বাজারে তারল্য বেড়েছে।
আবার গত অর্থবছর রেমিট্যান্সে রেকর্ড ৩৬ দশমিক ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়।
এসব কারণে ব্যাংকগুলোর হাতে উদ্বৃত্ত তারল্য ব্যাপক বেড়েছে। অথচ গত জুন পর্যন্ত বেসরকারি খাতে ঋণ বেড়েছে মাত্র ৮ দশমিক ৩৫ শতাংশ। এসব কারণে গত জুন শেষে ব্যাংকগুলোর অলস তারল্য দাঁড়িয়েছে ৬২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। আর ২ লাখ ৩১ হাজার কোটি টাকা উদ্বৃত্ত রয়েছে। ফলে বেশির ভাগ ব্যাংক এখন আমানত নিতেই অনীহা দেখাচ্ছে।