বাজেটের পর মূল্য সংযোজন কর আদায় (ভ্যাট) কার্যক্রম জোরদার করার উদ্যোগ নিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এর অংশ হিসেবে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে নিবন্ধতি সব ভ্যাটাদাতা প্রতিষ্ঠানের অনলাইনে রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।
গত সপ্তাহে সেগুনবাগিচায় রাজস্ব বোর্ডের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত ভ্যাট বিভাগের সঙ্গে এক পর্যালোচনা সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়। এ সভায় এনবিআর চেয়ারম্যান ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম সভাপতিত্ব করেন।
এ সময় এনবিআরের জ্যেষ্ঠ সদস্য ও মাঠ পর্যায়ের সকল ভ্যাট কমিশনার উপস্থিত ছিলেন।
এনবিআর চেয়ারম্যান মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বলেন, সেবার অনেক খাত রয়েছে, যেখানে ভ্যাট আদায়ের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তা হচ্ছে না। এসব খাত শনাক্ত করে একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার মাধ্যমে ভ্যাট আহরণের নির্দেশ দেন তিনি।
বৈঠকে অংশ নেয়া এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে নিউজবাংলাকে বলেন, খুচরা পর্যায়ের বড় একটি অংশ ভ্যাটের আওতার বাইরে এখনও।
পরিসংখ্যানে বলে বর্তমানে যে পরিমাণে ভ্যাট আহরণ হয়, তার মধ্যে খুচরা পর্যায় থেকে আসে মাত্র ৫ শতাংশ। ভ্যাট কর্মকর্তারা বলেন, খুচরা পর্যায়ের সকল খাতকে ভ্যাটের আওতায় আনতে পারলে এ খাত থেকে ভ্যাট আহরণ কমপক্ষে দশ গুণ বৃদ্ধি পাবে।
এ জন্য খুচরা পর্যায়ে ভ্যাট আদায়ে নজরদারি আরও বাড়ানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে বৈঠকে। বলা হয়েছে, ভ্যাট দেয়ার যোগ্য অথচ আওতায় নেই, এমন প্রতিষ্ঠানকে আওতায় এনে আদায় কার্যক্রম জোরদার করতে হবে।
বৈঠকে এনবিআরের অধীনে প্রত্যেক ভ্যাট কমিশনারেটকে এ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। বর্তমানে এনবিআরের অধীন সারা দেশে ভ্যাট কমিশনারেট অফিস রয়েছে ১২টি। এর মধ্যে রাজধানী ঢাকায় পাঁচটি।
বিদায়ী অর্থবছরে এনবিআরের মাধ্যমে মোট ভ্যাট আহরণ হয়েছে প্রায় ৭১ হাজার কোটি টাকা।
করোনা মহামারির মধ্যে ভ্যাট আদায় কার্যক্রম জোরদার করতে চায় সরকার। যোগ্য সব প্রতিষ্ঠানকে ভ্যাটের আওতায় এনে আধুনিক প্রযুক্তির মেশিন ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস চালুর পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।
এ সব উদ্যোগ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে নতুন অর্থবছরে ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকার ভ্যাট আহরণের লক্ষ্য স্থির করেছে রাজস্ব বোর্ড।
এখন পর্যন্ত অনলাইনে ভ্যাট নিবন্ধনের সংখ্যা ২ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। এর মধ্যে অনলাইনে রিটার্ন্ দাখিল করছে বছরে মাত্র ৪০ লাখ। সিংহভাগই অনলাইনের আওতার বাইরে।
রাজস্ব আদায় বাড়াতে নিবন্ধিত সকল ভ্যাটযোগ্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে বাধ্যতামূলক অনলাইনের আওতায় আনা হচ্ছে।
আগে প্রচলিত প্রথায় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ভ্যাট নিবন্ধন দেয়া হতো। যার অংক বা ডিজিট ছিল ১১। তিন বছর আগে অনলাইনে যে ভ্যাট নিবন্ধন চালু করা হয় তার ডিজিট ৯।
এখন ৯ ডিজিটের নাম্বারকে বলা হয় বিজনেস আইডেনটিফিকেশন নাম্বার বা বা ই-বিআইএন।
মাসিক ভ্যাট রিটার্ন্ দাখিল করতে হলে ৯ ডিজিটিরে ই-বিআইএন অবশ্যই উল্লেখে করতে হয়। তা না হলে রিটার্ন গ্রহণ করা হয় না।
রিটার্নের ওপর ভিত্তি করেই ভ্যাট আদায় করা হয়। রিটার্নে প্রতিষ্ঠানের বিক্রি বা লেনদেনের তথ্য উল্লেখ করা হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এনবিআরের ভ্যাট বিভাগের এক কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে বলেন, অনেক প্রতিষ্ঠান আছে, যারা নিয়ম অনুযায়ী ভ্যাট পরিশোধ করার যোগ্য, কিন্তু তাদের ভ্যাটের নিবন্ধন নেই।
সম্প্রতি বিভিন্ন মার্কেট পরিদর্শন করে তারা দেখেছেন, অনেক প্রতিষ্ঠান ভ্যাটের নিবন্ধন নেয়নি। প্রতিষ্ঠানগুলোর যে পরিমাণ বার্ষিক কেনাবেচা হয়, তাতে তাদের ভ্যাট দেয়ার সার্মথ্য রয়েছে। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানকে নিবন্ধনের আওতায় আনা হবে এবং বাধ্যতামূলক রিটার্ন জমা দিতে হবে।
তিনি আরও জানান, রাজধানী ঢাকাসহ অন্যান্য বড় বড় শহরে অনেক মার্কেট আছে, যেখানে অধিকাংশ দোকান ভ্যাটের নিবন্ধন নেয়নি। এসব দোকানকে ভ্যাটের আওতায় আনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
এসব দোকানে বসানো হবে ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি)। এরই মধ্যে সুপারশপগুলোতে এই মেশিন বসানো হয়েছে বলে জানান তিনি।
বৈঠকে বলা হয়, ভ্যাটের রিটার্ন অনলাইনে দাখিলের নিয়ম চালু করা হলেও অধিকাংশ ভ্যাট কমিশনারেটে এখনও শতভাগ রিটার্ন অনলাইনে দাখিল হচ্ছে না।
ঢাকার তুলনায় ঢাকার বাইরে অনলাইনে রিটার্ন দাখিল তুলনামূলক বেশি। যদিও ঢাকায় মোট রিটার্নের সংখ্যা বেশি।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ঢাকা উত্তরে সবচেয়ে কম ২৭ শতাংশ ভ্যাট রিটার্ন অনলাইনে দাখিল হচ্ছে। অথচ, রংপুরে ৯৮ শতাংশ রিটার্ন অনলাইনে দাখিল করা হচ্ছে।
আবার অনেক প্রতিষ্ঠানের সিএ রিপোর্ট পরীক্ষা করে দেখা যাচ্ছে, প্রকৃত তথ্য রিপোর্টে উপস্থাপিত হয়নি।
গত মে মাসে বিভিন্ন কমিশনারেটে ২২৫টির বেশি সিএ রিপোর্ট পরীক্ষা করা হয়েছে।
তাতে দেখা গেছে, বেশিরভাগ রিপোর্টে প্রকৃত বিক্রির তথ্য গোপন করা হয়েছে। এতে বিপুল পরিমাণ ভ্যাট ফাঁকি দেয়া হচ্ছে বলে বৈঠকে বলা হয়।
সভায় ভ্যাট ফাঁকি বন্ধে অভিযান কার্যক্রম আরও জোরদার করার জন্য সংশ্লিষ্ট কমিশনারেটকে নির্দেশ দেয়া হয়। পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের ভ্যাটের রিফান্ড (আগাম পরিশোধ করা ভ্যাট ফেরত দেওয়া) দাবি দ্রুত নিষ্পত্তির কথা বলা হয়।