বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ব্যাংকে রাখলে টাকা কমে?

  •    
  • ৫ আগস্ট, ২০২১ ০৮:২১

বর্তমানে ব্যাংকের সুদহার এত কমে গেছে যে, টাকা রেখে যে সুদ আসছে, তা দিয়ে মূল্যস্ফীতির ঘাটতিই মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। বর্তমানে আমানতের সুদহার সর্বোচ্চ ৬ শতাংশ বেঁধে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর ওপর বিভিন্ন মাশুল কাটার পর গড় সুদহার দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ১৩ শতাংশ।

অল্প দিন হলো বিয়ে করেছেন আরিফ ও সুস্মিতা। দুজনই চাকরিজীবী। আগামীর নিরাপত্তায় সংসারের শুরু থেকে সঞ্চয় করতে আগ্রহী এই দম্পতি, কিন্তু সঞ্চয়ের জন্য উপযুক্ত মাধ্যম কোনটি? ব্যাংক এবং সঞ্চয়পত্রের স্কিম যাচাই-বাছাই নিয়ে তৈরি হয়েছে দ্বিধাদ্বন্দ্ব।

তারা বলেন, প্রতি মাসে নির্ধারিত হারে অর্থ জমা করতে চান তারা। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকে নিরাপত্তা আছে, কিন্তু মুনাফার হার খুবই কম। আর জমানো কিছু টাকা আছে, সেটা রাখার ক্ষেত্রে সঞ্চয়পত্রে তুলনামূলকভাবে মুনাফার হার বেশি, তবে টিআইএনসহ নানা ক্ষেত্রে ঝক্কিঝামেলার শেষ নেই।

আরিফ এবং সুস্মিতার মতোই সিদ্ধান্তহীনতায় বেসরকারি চাকরিজীবী আনিসুর রহমান। নতুন চাকরি তার। এ জন্য মাসে যে বেতন পান, তা থেকে সঞ্চয় করতে চান কিছু টাকা। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকই তার কাছে ভরসার জায়গা। কিন্তু মুনাফার হার খুবই কম। তিনি বলেন, কয়েক বছর ধরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিনিয়োগ করে পাঁচ বছর পর যে মুনাফা পাওয়া যাবে, তা আকাঙ্ক্ষার চেয়ে খুবই কম। অথচ কয়েক বছর আগেও মুনাফার হার ছিল বেশি, যা বিপদ-আপদে নিশ্চিত করত জীবনের নিরাপত্তা।

ব্যাংক খাতে আমানতের সুদহার নিয়ে বাড়ছে হতাশা।

বর্তমানে ব্যাংকের সুদহার এত কমে গেছে যে, টাকা রেখে যে সুদ আসছে, তা দিয়ে মূল্যস্ফীতির ঘাটতিই মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। বর্তমানে আমানতের সুদহার সর্বোচ্চ ৬ শতাংশ বেঁধে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর ওপর বিভিন্ন মাশুল কাটার পর চলতি বছরের জুন শেষে ব্যাংক খাতে আমানতের গড় সুদ হার দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ১৩ শতাংশ। অবশ্য ব্যাংকভেদে এর চেয়ে সামান্য বেশি সুদ পাওয়া যায়। অথচ পাঁচ বছর আগেও সুদহার ছিল ৬ দশমিক ৮০ শতাংশ।

দেশে গত জুন শেষে গড় মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৫৭ শতাংশ।

এর অর্থ হলো, ব্যাংকে টাকা রাখলে তা কমে যায়।

ধরুন, ব্যাংকে কেউ ১০০ টাকা জমা রেখেছেন। সুদের হার ছয় ভাগ হলে বছর শেষে তিনি ১০৬ টাকা পাবেন। কিন্তু মূল্যস্ফীতির হারও যদি ছয় ভাগ হয়, তাহলে ১০০ টাকায় এখন যে পণ্য বা সেবা পাওয়া যায়, বছর শেষে তার জন্য ১০৬ টাকা খরচ করতে হবে। সে ক্ষেত্রে ব্যাংকে টাকা জমা রেখে সেই টাকা থেকে প্রকৃতপক্ষে কোনো আয় হবে না আমানতকারীদের।

আর সুদের হার ছয়ের নিচে নামা মানেই মূল্যস্ফীতি ও টাকার ক্রয়ক্ষমতা বিবেচনায় বছর শেষে মূল টাকা কমে যাচ্ছে।

ব্যাংকসংশ্লিষ্টরা জানান, কয়েক বছর আগেও ব্যাংকে মেয়াদি আমানত রেখে ৯ থেকে ১২ শতাংশ সুদ পাওয়া যেত। তবে ব্যাংকগুলোর কাছে প্রচুর অলস অর্থের কারণে হাতে গোনা দু-একটি ব্যাংক ছাড়া ৫ থেকে ৬ শতাংশের বেশি সুদ মিলছে না।

ব্যাংকভেদে বর্তমানে ৫ লাখ টাকায় বছরে ব্যাংক সুদ দেয় ৩০ থেকে ৩২ হাজার টাকা। এর মধ্যে কর শনাক্তকরণ (টিআইএন) নম্বর থাকলে কেটে নেয়া হয় ৩ হাজার টাকা। টিআইএন না থাকলে কাটা হয় সাড়ে ৪ হাজার টাকা। আর বছরে হিসাব পরিচালনার জন্য কাটা হয় ২৫০ টাকা। চেক বইয়ের জন্য আরও ৩০০ টাকা। এর ওপর কাটা রয়েছে ১৫ শতাংশ কর, যা ৮২ টাকা ৫০ পয়সা। আর প্রতিবছর সরকার আবগারি শুল্ক কেটে নেয় ৫০০ টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সুদহার নির্দিষ্ট করে দেয়ার কারণে ক্ষুদ্র আমানতকারীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। দরিদ্র, মধ্যবিত্তদের মূল সম্পদ হচ্ছে টাকা। সামান্য টাকা তারা নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে ব্যাংকে রাখেন। কিন্তু সুদ এত কম যে, তাদের টাকা কমে যাচ্ছে। ফলে সঞ্চয়ের অভ্যাস কমে যাবে।’

ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আরফান আলী বলেন, ‘বর্তমানে আমানতে যে সুদ দেয়া হচ্ছে, তা মূল্যস্ফীতির চেয়ে কম। এর চেয়ে বেশি সুদ দেয়ার সুযোগও নেই। যারা আমানতের সুদের ওপর নির্ভরশীল, তাদের চলা আসলেই কঠিন হয়ে পড়েছে।’

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘ঋণের সুদহার নির্দিষ্ট করে দেয়ায় ব্যাংকগুলো আমানতে বেশি সুদ দিতে পারছে না। এ জন্য যারা সুদের ওপর নির্ভরশীল, তাদের সমস্যা হচ্ছে। অনেকেই অন্যত্র চলে যাচ্ছেন। সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করছেন। কিন্তু ব্যাংকে টাকা রাখা যত সহজ, সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ তত সহজ নয়। ফলে মানুষ ঘুরেফিরে ব্যাংকেই ফিরে আসছেন।’

কোন ব্যাংকে কত সুদ

জুন শেষে রাষ্ট্রীয় মালিকানার সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বেসিক ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের গড় সুদহার ৪ দশমিক ৩৫ শতাংশ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সুদ বেসিক ব্যাংকে ৬ দশমিক ১০ শতাংশ।

বিশেষায়িত কৃষি, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ও প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের গড় সুদহার ৫ দশমিক ৭৩ শতাংশ। এর মধ্যে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক আমানতে ৭ দশমিক ৭০ শতাংশ সুদ দিচ্ছে।

বেসরকারি ব্যাংকগুলোর গড় সুদহার ৪ দশমিক ১৯ শতাংশ। এসব ব্যাংকের মধ্যে আমানতকারীদের বেশি সুদ দিচ্ছে পদ্মা ব্যাংক ৭ দশমিক ৬৮ শতাংশ, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ৭ দশমিক ১০ শতাংশ ও ন্যাশনাল ব্যাংক ৭ শতাংশ।

এ ছাড়া ইউনিয়ন ব্যাংক ৬ দশমিক ৫৫ শতাংশ, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক ৫ দশমিক ৮৮ শতাংশ , সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক ৫ দশমিক ৮৪, মেঘনা ৫ দশমিক ৫৯, এনআরবি ৫ দশমিক ৩৩, মধুমতি ব্যাংক ৫ দশমিক ২৪ ও মার্কেন্টাইল ব্যাংক ৫ দশমিক ০৯ শতাংশ আমানতে সুদ দিচ্ছে।

বিদেশি মালিকানার নয়টি ব্যাংকের আমানতে গড় সুদহার মাত্র দশমিক ৯৩ শতাংশ।

সুফল নেই সঞ্চয়ে

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সব মিলিয়ে দেশে ব্যাংক খাতে আমানতের বিপরীতে গড় সুদহার ৪ দশমিক ১৩ ভাগ। অন্যদিকে একই মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হারও দাঁড়িয়েছে সাড়ে পাঁচ ভাগের বেশি। সুদহার যতটুকু, তার সবটাই আবার হাতে আসে না। কেটে রাখা হয় ব্যাংকের চার্জ ও সরকারের শুল্ক। এর মানে টাকার মূল্যমানের অবচয় বিবেচনায় আমানতকারী যে পরিমাণ টাকা রাখছেন, বছর শেষে পাচ্ছেন তার চেয়ে কম।

এ কারণে ব্যাংকে টাকা রেখে সঞ্চয়কারীরা এখন আর প্রকৃত অর্থে লাভবান হতে পারছেন না। বরং তাদের জমা করা টাকার মূল্যমান বা আয় কমে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে।

ব্যাংকের সুদহারের সাথে বড় ধরনের তফাতে গত কয়েক বছরে সাধারণ মানুষের টাকা জমা রাখার নির্ভরযোগ্য মাধ্যম হয়ে উঠেছিল সঞ্চয়পত্র। ব্যাংকের বাইরে এখন সঞ্চয়পত্রে টাকা রাখতে বেশি আগ্রহী আমানতকারীরা। তবে এখানে বিনিয়োগে নানা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। বিশেষ করে কেউ সঞ্চয়পত্র কেনার পর এক বছরের মধ্যে ভাঙালে কোনো সুদ পান না। তবে সুদহার বেশি হওয়ার কারণে গত কয়েকটি অর্থবছরে এর বিক্রি সরকারের বাজেটে ধরা লক্ষ্যমাত্রাকে ছাড়িয়ে যেতে থাকে। ফলে বাড়তে থাকে সরকারের সুদব্যয়।

এমন অবস্থায় সঞ্চয়পত্র বিক্রির রাশ টানতে গত বছরের জুলাই থেকে সঞ্চয়পত্র কেনার ক্ষেত্রে টিআইএন ও ব্যাংক হিসাব বাধ্যতামূলক করে দেয় সরকার। অনলাইনে আবেদনের পাশাপাশি উৎসে করের হার পাঁচ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়।

ব্যাংক ও সঞ্চয়পত্রের বাইরে বিনিয়োগের একটি বড় জায়গা সরকারের বিল ও বন্ড। তবে এখানে টাকা রেখে গত জুনে শূন্য দশমিক ৬৫ শতাংশ থেকে ২ দশমিক ৪৪ শতাংশ সুদ মিলেছে। এখানে বিনিয়োগ সুবিধার বিষয়ে সাধারণ মানুষের বেশির ভাগই জানেন না।

আর ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানে এখনও ৮ থেকে ১১ শতাংশ পর্যন্ত সুদ পাওয়া গেলেও কিছু প্রতিষ্ঠানের অবস্থা রুগ্ণ হওয়ায় এ ধরনের প্রতিষ্ঠানে সঞ্চয়ের প্রবণতা কম।

পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ সবার জন্য উন্মুক্ত থাকলেও পুঁজি হারানোর ভয়ে সেখানে যান না অনেকে।

সুদ যত কমই হোক, এই মুহূর্তে ব্যাংকে টাকা রাখা ছাড়া মানুষের সামনে আর কোনো সুযোগ নেই বলে মনে করেন সালেহউদ্দিন আহমেদ৷ তিনি বলেন, ‘মানুষ তো ঘরে টাকা ফেলে রাখবেন না। বিকল্প সঞ্চয়ের মাধ্যমও তেমন নেই। একটি অংশ বেশি লাভের আশায় এমএলএম কোম্পানি, কো-অপারেটিভসহ এ ধরনের প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করে পুরো টাকা খোয়ানোর ঝুঁকিতে পড়েছেন। ফলে ঘুরেফিরে ব্যাংকই সাধারণ মানুষের ভরসা। ব্যাংকে টাকা রেখে তাৎক্ষণিক তোলার সুযোগ, জমানো টাকা অনলাইন ও কার্ডে ব্যবহার, ফেরত পাওয়ার নিশ্চয়তাসহ বিভিন্ন কারণে ব্যাংকেই টাকা রাখতে বেশি আগ্রহী মানুষ’।

এ বিভাগের আরো খবর